ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

টেন্ডার | তুষার আবদুল্লাহ

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
টেন্ডার | তুষার আবদুল্লাহ

গণশৌচাগারের কাজটা অনুভবরা পেয়ে গেছে। শহরের গণশৌচাগারের পরিচ্ছন্নতা দেখভাল করবে ওদের ঠিকাদার কোম্পানি।

টেন্ডারে ওরা জিতবে কি জিতবে না এ নিয়ে অনুভব ছাড়া সবার মাঝে সংশয় ছিল। ওদের সিইও নিজেই আশাবাদী ছিলেন না। অনুভব কেবল বলে গেছে কাজটা আমরাই পাচ্ছি। কিভাবে ও এতটা নিশ্চিত জানতে চাইলে বলেছে শুধু—“গিট্টু, এমন গিট্টু মেরে রেখেছি, আমাদের না দিয়ে উপায় নেই। ”

হলোও তাই, সর্বনিম্ন দর দিয়েছে যারা কাজ তারা পেল না। সর্বোচ্চ দর দেয়ার পরেও কাজটা ওদের কোম্পানিকেই দেয়া হলো। কেন দেয়া হলো রহস্যটা কেউই জানতে পারল না। কোম্পানিতে ওর সহকর্মীরা তো বটেই, টেন্ডারে অংশ নেয়া অন্য কোম্পানির কাছেও বিষয়টা খোলাসা হলো না। অনুভব কেবল শুকনো হাসি দিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন পত্রিকার পাতায় নতুন দরপত্র প্রকাশ হলেই, পেপার কাটিং চলে আসছে অনুভবের কাছে। সহকর্মীরা ফোন করে সরসভাবে জানতে চায়—কোনটা ওরা পাচ্ছে কিংবা কোনটা পাচ্ছে না। অনুভব নিজেও কেমন যেন এক নেশার মধ্যে পড়ে গেছে, পত্রিকায় দরপত্র দেখলেই মনে মনে হিসেব কষে ফেলে, টেন্ডারে অংশ নেয়া লাভের হবে নাকি লোকসানের।

আজ এক অদ্ভুত দরপত্র অনুভবের হাতে এসেছে। কোনো মালামাল সরবরাহ করা কিংবা দেখভালের কাজ নয়, সরবরাহ করতে হবে গল্প। নিজের ক্যারিয়ারে তো বটেই, ঠিকাদারির ইতিহাসেও টেন্ডার ডেকে গল্প নেওয়ার নজির নেই। যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি গল্প চাচ্ছে, তাদের প্রতি তিনমাস অন্তর নতুন গল্প দিতে হবে। পাঁচ বছরের চুক্তি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ওদের বিশটি গল্প দিতে হবে। কোনো ব্যাপারই না। প্রতিদিন গল্প দিতে হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান গল্প দিয়ে কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারছে না অনুভব।

প্রতিষ্ঠানটি সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। সড়কের সঙ্গে তিনমাস অন্তর নতুন গল্প বানানোর কী সম্পর্ক—অনুভব বুঝতে পারে না। তাই দরপত্র তৈরির প্রস্তুতি নিতে একদিন ঐ প্রতিষ্ঠানে যায় সে। দরপত্রের নিচে যার স্বাক্ষর, তার নাম হোসনে আরা, দেখে ও ভেবেছিল কোনো নিরস ধরনের মহিলা হবেন। ধারণা পাল্টে গেল রুমে ঢোকার পর। শুধু ধারণা নয়, বলা যায় ধাক্কাই খেয়েছে ও। হোসনে আরা কেন এই মহিলার নাম হবে—এ নিয়েই তো জনস্বার্থে মামলা করা যায়। খাকি রঙের ফাইলের অন্ধকারে বাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন হোসনে আরা। নীল শাড়ি আর নীল টিপের হোসনে আরাকে দেখে কম্পন বোধ করে অনুভব। ওর থমকে যাওয়াটা টের পান হোসনে আরা। অনুভবকে বসতে বলেন। ও চেয়ার সরিয়ে বসে পড়ে আর ভাবে ওর নাম কেন অপরাজিতা হলো না। নীলাম্বরী কিংবা নীলখাম হলেও মন্দ হতো না।



আজ এক অদ্ভুত দরপত্র অনুভবের হাতে এসেছে। কোনো মালামাল সরবরাহ করা কিংবা দেখভালের কাজ নয়, সরবরাহ করতে হবে গল্প। নিজের ক্যারিয়ারে তো বটেই, ঠিকাদারির ইতিহাসেও টেন্ডার ডেকে গল্প নেওয়ার নজির নেই। যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি গল্প চাচ্ছে, তাদের প্রতি তিন মাস অন্তর নতুন গল্প দিতে হবে। পাঁচ বছরের চুক্তি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ওদের বিশটি গল্প দিতে হবে। কোনো ব্যাপারই না। প্রতিদিন গল্প দিতে হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান গল্প দিয়ে কী করবে, তা বুঝে উঠতে পারছে না অনুভব।



হোসনে আরাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব বেশিদিন হয়নি তার চাকরির বয়স। অনুভব জানতে চায়, “সড়ক মেরামতে গল্পের কী প্রয়োজন, সড়ক বুঝি গল্প শুনতে চায়?”
হোসনে আরা বলেন, “সড়কে সড়কেই তো কত গল্প ছড়িয়ে থাকে। সড়কের গল্পের অভাব নেই। ”
অনুভব জানতে চায়, “আপনি সড়কের গল্প জানেন?”
হোসনে আরা অফিস সহকারি ডেকে চা-সিঙারা দিতে বলেন। তারপর ফিরে অনুভবের উত্তরে—“সড়কের প্রতিটি নুড়ি পাথরের কাছে গল্প আছে। সড়কে যাতায়াতকারী প্রতিটি যাত্রী তো একেকটি উপন্যাস। বাজার-হাট মহাকাব্য। ”
অনুভব স্বভাবসুলভ নোটবুকে মুখোশ আঁকছে আবার কেটে দিচ্ছে। কোনোটার চোখ পছন্দ হয় না, কোনোটার ঠোঁট, আবার কোনোটার চুল। তবে হোসনে আরার সবই ওকে মুগ্ধ করেছে। ও নিজেই কলম তুলে নেয় নোটবুক থেকে। যদি হোসনে আরা ভেবে থাকে অনুভব তাকেই আঁকছে! ধরা পড়ে গিয়েও ধরা পড়ল না—এমনভাবে চোখ রাখে হোসনে আরার দিকে।
হোসনে আরা টের পায় বিষয়টা, বলে, “এভাবে যাদের আঁকার অভ্যেস তারা অন্যকে আঁকতে পারে না। নিজেকেই আঁকে। আপনি চাইলেও আমাকে আঁকতে পারবেন না। ”
অনুভব চোখ তুলে জানতে চায়, “কেন?”
কাপ থেকে পিরিচে চা ঢেলে নিয়ে হোসনে আরা বলেন, “মানুষ তখন ঈর্ষায় থাকে। এই যেমন আপনি ভাবছেন আপনি কিংবা আপনার প্রিয় কোনো মানুষ কেন আমার মতো সুন্দর হলো না। উল্টোটাও হয়। মানে করুণা। আমি কেন সুন্দর হলাম না। হলে আলাপটা অনেকদূর টেনে নিয়ে যাওয়া যেত। ”

এই আলোচনা থেকে বেরুতে চায় অনুভব। দরপত্রের ফটোকপি হোসনে আরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “গল্প সরবরাহের বিষয়টা মাথায় ঢুকছে না। আপনারা তো কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নন, তথ্যচিত্র বানানোর কাজও আপনাদের না। তাহলে গল্প দিয়ে কী করবেন। ”
হোসনে আরা ঠোঁটে হাসি এনে বলে, “মানুষকে গল্প শোনাব। ”
অনুভব বলে, “মানুষকে নাকি পথকে?”—উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলে, “এমন অদ্ভুত দরপত্র আমি কখনোই দেখিনি। গল্পের জন্য টেন্ডার। ”
হোসনে আরা বলেন, “কখনো আর কোনো প্রতিষ্ঠানের মাথায় এই অদ্ভুত চিন্তা আসে নাই তো দেখবেন কী করে?”
অনুভব জানতে চায়, “আপনাদের মস্তিষ্কটা কে? তাকে দেখার সাধ জেগেছে। ”
হোসনে আরা বলেন, “আমরা যেভাবে লতায় পাতায় আছি বলা মুশকিল কোন মস্তিষ্ক থেকে এটা প্রসব হয়েছে। ”
অনুভব জানতে চায়, “লতায়পাতায় মানে?”
উত্তর আসে—“আমলাতন্ত্র। রাষ্ট্রতন্ত্র। এখানে কোথায় কখন কিভাবে কোন চিন্তা মাশরুমের মতো গজিয়ে ওঠে টেরও পাওয়া যায় না। গল্পের ভাবনাটি এভাবেই হয়ত হাঁটতে হাঁটতে আমার টেবিলে এসেছে। ”

হোসনে আরার চোখে কিছুক্ষণ চোখ রাখে অনুভব, তারপর জানতে চায়, “কেমন গল্প চান আপনারা? আমার ধারণা আপনারা হয়ত সড়ক ব্যবহারের সচেতনতা তৈরি করতে কোনো তথ্যচিত্র তৈরি করবেন নিয়মিতভাবে। কোনো প্রকল্পের আওতায়। অনুদান পেয়েছেন হয়ত কোথাও থেকে। ”
হোসনে আরা পাশে রাখা বোতল থেকে পানি খেয়ে নেন ঢক ঢক করে। তারপর বলেন, “নারে ভাই, এসব কিছু না। সব গল্প প্রেসনোটের জন্য। ”
শুনে অনুভব অবাক হয়ে তাকায় হোসনে আরার  দিকে—“প্রেসনোটের গল্প আমদানি করতে হবে কেন? আমলারা তো এক্ষেত্রে সেরা, জনপ্রিয় লেখক। ”
হোসনে আরা পেপারওয়েট নিয়ে যেন খেলছেন। বলেন, “বুড়িয়ে গেছে আমলাতন্ত্র। জং ধরেছে মস্তিষ্কে। এখন আর নতুন গল্প বের হয় না। একই গল্প প্রতিদিন বলে যাচ্ছে। দুটি গাড়ি ওভারটেক করতে গিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ। কিংবা সিগনাল অমান্য করে ঢুকে পড়ায়, রেল ও গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ। এ গল্পগুলোই তো নিয়মিত প্রেসনোটে লেখা হচ্ছে। আমরা পাঠাচ্ছি, গণমাধ্যম সেগুলো বলে যাচ্ছে তোতা পাখির মতো। শুনতে শুনতে কেউ এখন প্রেসনোটের এসব গল্প আর বিশ্বাস করে, বলেন?”

অনুভব একটু গভীর হয়েই জানতে চায়, “সেই গল্প এখন বাইরে থেকে নেবেন?”
হোসনে আরা মাথা ঝাঁকায়।
অনুভব বলে, “সেই গল্প তো আপনাদের দেয়া ছক মতোই বানাতে হবে। লাভ কী। তারচেয়ে নিজেরাই বানান। ”
হোসনে আরা বলেন, “এটাও আরেক তন্ত্র। নিজেরাই গল্প বানাবে। শুধু টেন্ডারবক্সে জমা পড়বে আপনার বা আপনাদের নামে।
অনুভব বলে, “এটাই তো অনেক ভালো গল্প। কী দরকার সড়ক নিয়ে আলাদা গল্প ফাঁদার?”
হোসনে আরা বলেন, “দেখুন প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। কত মানুষ মারা যাচ্ছে। নানা সড়কে নানা রকম কারণ। অথচ গল্প কিন্তু একটাই। ”
অনুভব ‘বুঝেছি’ বলে উঠে দাঁড়ায়, তারপর বলে, “আচ্ছা উনারা নিজেরাও তো দুর্ঘটনার শিকার হন। সেই কথা তো প্রেসনোটের গল্পে উঠে আসে না?”
হোসনে আরা জানতে চান, “আপনি কি টেন্ডার বাক্সে গল্প ফেলবেন? ফেলুন না। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। মনে হচ্ছে আপনি ভালো গল্প ফাঁদতে পারবেন। ”

অনুভব উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, “আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। নিজেদের কেন আড়ালে রাখে গল্প থেকে?”
হোসনে আরাও উঠে দাঁড়ান—“বাহ গল্পে যদি তারা আসেন তাহলে বানোয়াট কাহিনীটা সবার সামনে প্রমাণ হয়ে যাবে, তাই না? সেই সঙ্গে নিজেদের অসহায়ত্ব, অপারগতার দিকটা তো আছেই। বাদ দেন। আপনি গল্প লিখুন। মনে হচ্ছে আপনার গল্প প্রেসনোটে সাহিত্যের সুগন্ধ বিলিয়ে দিতে পারবে। আর আমি তো আছিই। ”
ঘুরে দাঁড়িয়ে অনুভব দরজার দিকে এগোতে থাকে, তারপর ফিরে আসে আবার। হোসনে আরার তিনদিকের উঁচু ফাইলের দেয়ালে ফাইলে হাত বুলাতে থাকে। তারপর বলে, “এই লালফিতায় কত যে মিথ্যে গল্প বন্দি হয়ে আছে! কোনোদিন যদি পুরনো ফাইলগুলো নিলামে তোলেন, জানাবেন। আমি ঐ টেন্ডার জিততে চাই সর্বস্ব দিয়ে। ”



বাংলাদেশ সময়: ১৯০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।