আঠারবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন। রাত বাজে বারোটা।
ট্রেন লাইনচ্যূত হয়েছে নীলগঞ্জে। গৌরীপুরের বুকাইনগরে লাইন তুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। একেই বলে মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ। সব কিছু ঠিক হয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হতে লাগবে ছ’সাত ঘণ্টা। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠবে।
মানুষ আরো আগেই হয়ত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেত। পারেনি। একে তো ধর্মঘট; সেই সঙ্গে বেরসিক টিপটিপ বৃষ্টি। “আধুনিক যুগে মানুষের এতটা অসহায়ত্ব ভাবতেই পারছি না। ” বললেন, একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। আশপাশের নির্জীব বসে থাকা মানুষগুলো যেন সোনা-রুপার জিয়ন কাঠির স্পর্শে জেগে ওঠে। গিজগিজ মানুষের জায়গাতে গমগম মুখরতা থাকাটাই নিয়ম। তবে, আজকের রেলস্টেশনে হয়েছে তার উল্টোটা। মানুষের মুখে দেখা দিয়েছিল ভাষার অভাব! একটু আগে। এখন সবাই কথা বলতে শুরু করেছে। কেউ সরকারের চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধারে নেমেছেন। কেউ রেল কর্তৃপক্ষের বারোটা বাজাচ্ছেন। একটু আতেল টাইপ যারা, তারা বাঙালি জাতির চারপুরুষের ঐতিহাসিক ভুলের খতিয়ান খুলে দিচ্ছেন। আলাপ মুখ থেকে মুখ হয়ে ছুটে চলছে এমাথা থেকে ওমাথায়। রাজনীতির প্রথম পাঠ নেওয়া যুবকটি পিণ্ডি চটকাচ্ছে পুঁজিবাদের। একটু বেশি মনোযোগ চাওয়া শিক্ষিত ছেলেটি বলছে, বুর্জোয়া রাজনীতি, শ্রেণি সংগ্রাম আর প্রলেতারিয়েত জনতার কথকথা।
নিজের লেখক সত্তা জাহির করার জন্য কথা বলছে একজন। তার বক্তব্যের শ্রোতাও বেশি। কোথায়, কবে তিনি সমাজের কোন অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছিলেন তার ফিরিস্তি জানিয়ে দিচ্ছেন। তার কথা সবাই বিশ্বাস করছে এমনটাও মনে হচ্ছে না শ্রোতাদের মুখ দেখে। এই অবিশ্বাসটা সেই মধ্যবয়সী ধরে ফেলেছেন। এখন তিনি তার ঝোলা থেকে বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং বের করে প্রমাণসহ কথা বলছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় প্রত্রিকার কাটিংগুলোও ভালো বোঝা যাচ্ছে না। একজন সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোত্থেকে যেন একটা টর্চলাইট যোগাড় করে নিয়ে এসেছেন। লেখক ভদ্রলোকটির উৎসাহ বেড়ে গেছে। দেশের নানাবিধ সমস্যার জন্য তিনি কর্পোরেট সভ্যতাকে দায়ী করছেন। বেশ ভালো একটা মজমার মতো জমে গেছে। স্টেশনের সব মানুষের দৃষ্টি এখন এই লেখক ভদ্রলোকের দিকে। তিনি এখন বেশ জনপ্রিয় নেতার মতো বক্তব্য দিচ্ছেন—
নিজের লেখক সত্তা জাহির করার জন্য কথা বলছে একজন। তার বক্তব্যের শ্রোতাও বেশি। কোথায়, কবে তিনি সমাজের কোন অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছিলেন তার ফিরিস্তি জানিয়ে দিচ্ছেন। তার কথা সবাই বিশ্বাস করছে এমনটাও মনে হচ্ছে না শ্রোতাদের মুখ দেখে। এই অবিশ্বাসটা সেই মধ্যবয়সী ধরে ফেলেছেন। এখন তিনি তার ঝোলা থেকে বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং বের করে প্রমাণসহ কথা বলছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় প্রত্রিকার কাটিংগুলোও ভালো বোঝা যাচ্ছে না। একজন সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোত্থেকে যেন একটা টর্চলাইট যোগাড় করে নিয়ে এসেছেন।
“দেখুন, কর্পোরেট কুলাঙ্গাররা আমাদের জীবন থেকে সব সুখ হরণ করেছে। আমাদের মধ্যে চাহিদা উত্থান ঘটিয়ে লোভী বানিয়ে দিয়েছে। ক্ষুদ্র যত ব্যবসা বাণিজ্য আছে সব এখন বড় বড় কর্পোরেট হাউজগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। সেজন্যই আমাদের ক্ষুদ্র-কুটির শিল্পগুলো মার খেয়ে গেছে। তাই আমরা এখন সবাই শহরমুখো। শহরে না গেলে ভাত জোটে না। এই ধরুন, একসময় মফস্বলে ছিল মোমের কারখানা, কলমের কারখানা, কয়েলের কারখানা, লজেন্স বানানোর কারখানা। সেখানো কাজ করত গ্রামীণ শ্রমিকরা। এখন এইসব পণ্যের উৎপাদক হয়ে গেছে বড় কোম্পানিগুলো। সেজন্যই আমাদের আজকের এই অসহ্য দীর্ঘ অপেক্ষা। ”—মানুষের সমর্থনের আশায় তিনি আশপাশে চেয়ে দেখেন। কয়েকটি যুবক চিৎকার করে ‘ঠিক’ বলে ওঠে। তিনি আরো কিছু বলতে চাইছিলেন। এমন সময় পূর্ব দিক থেকে একটি তীব্র আলো এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
আলোটা দেখে সবার মধ্যেই একটা ভয়ের শিহরণ নেমে আসে। ডাকাত আসছে এমন একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে পুরো প্লাটফর্মে। নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শুরু হয় চাপা কান্নার গমক। যুবকদের মধ্যে দেখা যায় প্রতিরোধের একটা প্রস্তুতি। পুরো স্টেশন একটা কারবালা হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদল অবিবেচক বলাবলি করছে, আঠারবাড়ীর ডাকাতরা খুব ভয়ঙ্কর হয়। এরা লুটতরাজের পাশাপাশি মানুষকে অনর্থক মারধর করে। সমাজের একদল লোক আছে যারা কখনোই মানুষকে আশাবাদী করতে বা সান্ত্বনা দিতে পারে না। সবসময় মানুষকে হতাশ করে আর ভয় দেখায়। এরা সব জায়গায় থাকে। আছে স্টেশনেও।
কারো হাত গোটানো দেখে মুরুব্বি গোছের কেউ আবার বলছেন, “খালি হাতে ডাকাতের মোকাবিলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্টেশনে জিআরপি পুলিশ আছে। চলো পুলিশের কাছে খবর দেই। ” আশপাশের অনেকেই মুরুব্বির কথায় সায় দেন। পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যে গিয়ে দেখা যায় দুজন মাত্র কনস্টেবল আছে। বাকিরা কোথায়, তারা বলতে পারে না। “আরে ভাই, স্টেশনে ডাকাত আসছে। আপনাদের কোনো দায়িত্ব নাই?” একজন যুবক চিৎকার করে বলে।
“অ্যাই পুলা এত গরম দেখাস কেন? বেশি ভাব ধরলে তোরেও ডাকাতি মামলায় হান্দায়া দিমু। ” বলে কনস্টেবল।
“দেখেন আপনি আইনের মানুষ। এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনি একটা দায়িত্বশীল মানুষ। এত এত মানুষ স্টেশনে আটকে আছে। একটা বিপদ আসন্ন। আপনাদের কাজ হলো জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া। আপনারাই যদি হুমকি দেন তাহলে আমরা কোথায় যাব। ” বললেন, লেখক ভদ্রলোক।
পুলিশ ফাঁড়ির চারপাশে মানুষের ভিড় জমে গেছে। লেখকের কথায় সেই কনস্টেবল কিছু একটা বলতে চাইলে পাশের পুলিশটি তার কানে কানে কী যেন বলে। সে আর মুখ খোলে না। পাশের পুলিশটি বলে, “চলুন আমরা পুলিশ জনতা সবাই মিলে প্রতিরোধ করি। ” তার কথায় সবাই সায় দেয়। ‘কথা ঠিক! কথা ঠিক!!’—একটা রব ওঠে চারদিকে।
আলোটা অনেক্ষণ ধরেই আসছে। ক্রমশ বড়ও হচ্ছে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরেই আসছে। মানুষের ভেতর ভয় আর উদ্বেগের ধুকপুকানি বাড়ছেই। কেউ কেউ স্টেশন মাস্টারের কাছে যাচ্ছে তাদের টাকা পয়সা ও অলঙ্কারগুলো মাস্টারের—পাশের বাসায় জমা রাখতে। “বিপদের সময় মানুষের বিশ্বাস কি আসলেই বেড়ে যায়? না হলে স্বাভাবিক অবস্থায় সম্পদ দিয়ে রেলস্টেশনে কাউকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ তো নেই আমাদের দেশে!” বললেন একজন প্রবীণ। স্টেশন মাস্টার পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মানুষের টাকা অলঙ্কার রাখবেন? নাকি ‘পারব না’ বলে ফিরিয়ে দেবেন! এমন সময় মাথায় তার বুদ্ধি আসে। “আরে আপনাদের মোবাইল ফোন নাই? পুলিশ ফাঁড়ি তো রায়বাজারেই। একটা ফোন দেন। চার মিনিট লাগবে পুলিশ আসতে। ” কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এতক্ষণের অপেক্ষায় গেমস খেলে আর নেট ব্রাউজ করে কারো মোবাইলেই চার্জ নেই। এমনকি স্টেশন মাস্টারের মোবাইলেও নেই। টেলিফোন লাইন কবে যে নষ্ট হয়েছে তার কোনো হিসেব মাস্টার নিজেও রাখেন না।
লেখক সাহেব এবার হেসে উঠলেন। তার হাসি দেখে সবাই রেগে গেল। স্টেশন মাস্টার বললেন, “আরে ভাই, আপনি লেখক মানুষ হয়ে মানুষের এই বিপদে হাসতেছেন!”
“আসলে এমনিতেই হাসি চলে এসছে। কারণও একটা আছে। দেখুন, বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে, ততই মানুষ অসহায় হয়ে যাচ্ছে। আজকে যদি হণ্টন যুগ থাকত। মানুষজন এতক্ষণে নিরাপদে তাদের ঘরে ফিরে যেত। যদি বিদ্যুৎ না থাকত তাহলে সবাই নিজ নিজ ব্যস্থায় আলো জ্বালাতো। যদি সাদাকালো মেবাইলের যুগ থাকত তাহলে কারো মোবাইলই চার্জের অভাবে বন্ধ হতো না। অ্যান্ড্রয়েডের যুগ এসে যেমন ভেলকি লাগিয়ে দিয়েছে, তেমনি মানুষকে কিছুটা অসহায়ও করে দিয়েছে বৈকি। অবশ্য শহরে হলে সবাই এক্সট্রা পাওয়ার সেভার রাখত। কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে মোবাইলই ছিল সবার সঙ্গী। যে কারণে স্টেশন ছিল শান্ত। যেই মোবাইলগুলো চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল, ওমনি সবাই আবার কথায় জেগে উঠল। ঠিক আছে, আমার সেই নুহু যুগের মেবাইলটাই নিন! থানায় একটা ফোন করুন। ”—বলেই তিনি পুরনো আমলের মোবাইলটা বের করে দিলেন। কমপক্ষে তিনদিন পর্যন্ত অনায়াশে যেটার চার্জ থাকে।
এমন সময় পূর্ব দিক থেকে একটি তীব্র আলো এগিয়ে আসতে দেখা যায়। আলোটা দেখে সবার মধ্যেই একটা ভয়ের শিহরণ নেমে আসে। ডাকাত আসছে এমন একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে পুরো প্লাটফর্মে। নারী-শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শুরু হয় চাপা কান্নার গমক। যুবকদের মধ্যে দেখা যায় প্রতিরোধের একটা প্রস্তুতি। পুরো স্টেশন একটা কারবালা হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদল অবিবেচক বলাবলি করছে, আঠারবাড়ীর ডাকাতরা খুব ভয়ঙ্কর হয়। এরা লুটতরাজের পাশাপাশি মানুষকে অনর্থক মারধর করে।
লেখকের কথায় সবাই কেমন যেন নড়েচড়ে উঠল। আবারও একটা ফিসফিসানি বাতাসে। সবাই বলছে, “আসলে লেখক মানুষ তো। সব দিকেই খেয়াল রাখেন। ” কেউ আবার নেতিবাচক ভাবল, বলল, “নিজেকে জাহির করার জন্য মানুষ কতকিছুই তো করে! আর লেখকদের বড় একটা অংশই জনপ্রিয়তাকাতর। ” কয়েকজন প্রতিবাদ করে উঠল, “রাখেন আপনাদের ফাউ প্যাঁচাল। পুরো ইস্টিশনে একটা মেবাইলও অন নাই। সেই সময় তিনি সাহায্য করলেন; আর আপনারা তাকে নিয়ে বাজে কথা বলেন!”
“লাগ লাগ ভেলকি লাগ! বুড়া মাইনষের আডুত লাগ! পুলাপানের চউক্ষ লাগ! মাইয়া মাইনষের কপালে লাগ...”— বয়স্ক অনেকেই মৃদু হেসে তাকায় আওয়াজের উৎসের দিকে। কিশোর-কিশোরীরা হচকিয়ে যায়। শহুরে নারীরা ভয়ে সিঁটিয়ে যান। স্টেশন মাস্টার বলেন, “আর ফোন করার দরকার নেই। ইস্টিশনে চলে এসেছে মনা জাদুকর। আপনাদের কোনো সমস্যা নেই। ”
“আরে জাদু দিয়ে কি ডাকাত ফিরবে। এসব কী বলছেন! স্টেশনে এতএত মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা সংকটে ভুগছে। আর আপনি বলছেন কোন বেটা জাদুকর চলে এসেছে! সমস্যা নাই। আসলে আপনার মাথায় সমস্যা আছে মনে হয়। ” বলল এক যুবক।
“আরে বাবা! পুরো কাহিনী শুনে তারপর রাগ দেখাও। এত রেগে গেলে তো চলবে না। রেগে গেলে তো হেরে গেলে!”
“আরে! একজন স্টেশন মাস্টার এত ধৈর্য দেখাতে পারে! এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে! দেশ আসলেই এগিয়ে যাচ্ছে। ”—একজন বুড়ো মতো মানুষের কণ্ঠে এই কথা শুনে সবাই তাঁর দিকে তাকায়।
“আপনারা যে আলোটা এতক্ষণ দেখছেন সেটা এই মনা জাদুকরের হ্যাজাকের আলো। মনে হয় স্টেশনে এত মানুষের সারারাতের অপেক্ষার খবর শুনে জাদু দেখাতে চলে এসেছে। ডাকাত-ডুকাত কিছু না। ”
স্টেশন মাস্টারের কথায় সবার গলায় জমে থাকা শুকনো শুকনো অনুভূতিটা কমতে শুরু করে। তবুও কারো কারো সন্দেহ দূর হয় না। কিন্তু স্টেশনের উত্তর দিকের খালি জায়গায় তাকিয়ে সবারই মনে নেমে আসে স্বস্তি। যখন স্টেশন মাস্টারের কামরা থেকে অভিযোগকারী দলটা বের হয়ে আসে; তখন পুরো স্টেশন জুড়ে একটা শান্তি শান্তি আবহাওয়া বয়ে চলছে। চকিত মানুষের মন থেকে ভয়-ডর-উদ্বেগ উধাও।
হ্যাজাক লাইটের আলো আর মনা জাদুকরের কথার জাদুতে সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। জাদুকর বলতে থাকে, “গত আট-দশ বছর আগেও আমি এই স্টেশনে নিয়মিত জাদু দেখাতাম। এখন পারি না। এখন খেলা দেখায়া পেট চলে না। মানুষ আইজকাইল ইস্টিশনে আইসা বইসা থাকে না। বাস আছে, সিএনজি আছে। চলে যায়। যাগোর রেলগাড়ি ছাড়া উপায় নাই। তাগোর আছে মোবাইল। ইস্টিশনের দোকানগুলোতে আছে টেলিভিশন। কার ঠেকা পড়ছে আমার মতো এই গেরাইম্যা জাদুকরের খেলা দেখে! এইসব ভেলকিবাজির এখন কোনো দাম আছে? টেলিভিশন খুললেই দেখা যায় দুইন্যার বড় বড় জাদুকরের জাদু। কম্পিউটারে খেলা যায় কত রকমের খেলা। আমার নাতি কয়, ‘দাদা! তোমার জাদুর থিকা আমার কাছে আরো বড় জাদু আছে। তুমি কি ভেলকি লাগাইবা! আসো আমি তোমাকে ভেলকি দেখাই’। আমি তার কাণ্ডকারখানা দেখে সত্যিই ভেলকি খেয়ে যাই। আরে! রং নাই, কলম নাই, খাতা নাই তবুও সে লেখে, ছবি আঁকে! আমি পুরাই টাস্কি খায়া যাই! সে কম্পিউটারের টেলিভিশনে গাড়ির খেলা দেখায়। আমি বেক্কল হইয়া যাই। কইনছেন আপনারা, এইসব মজার মজার খেলা রাইখ্যা কে যায় মনা জাদুকরের মান্দাতা আমলের জাদু দেখতে?”—মনা জাদুকর চারপাশে ঘুরেঘুরে তাকিয়ে মানুষের উত্তরের অপেক্ষা করে।
“আরে! আপনি আজকে আমাদের খেলা দেখাবেন। আমরা আপনার খেলা দেখব। আমরা সারা জীবন জেনে আসছি ক্যানভাসার, স্ট্রিট ম্যাজিসিয়ান, আর ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কেনাকাটা করে তাদের আমরা সাহায্য করি। কিন্তু আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি আপনি একজন স্ট্রিট ম্যাজিসিয়ান আমাদের সাহায্য করছেন। আপনার এই হ্যাজাক বাতির আলো আমাদের দীর্ঘ অন্ধাকারযাপন থেকে রক্ষা করল। আপনার জাদুকরী আমাদের সময় কাটাতে সাহায্য করবে। আপনাকে ধন্যবাদ। ” বললেন লেখক সাহেব।
“আমি যখন আমার ছেলের কাছে শুনলাম, আজ সারা রাত ইস্টিশনে মানুষ থাকবে। কারো কোথাও যাওয়ার সুযোগ নাই। তখন হ্যাজাকের খোঁজে বাইর হইলাম। হ্যাজাক কি আর পাওয়া যায়! চার্জ লাইট আর কারেন্টের কারণে গ্রামেও এখন আর কেউ হ্যাজাক রাখে না। তারপরও আমার পুরান একটা আর মাতবর সাবের একটা—এই দুইটা জ্বালায়া চলে আসলাম আপনাদের একটু মজা দিতে। আবার আন্দাইরটাও কাটাতে। তাইলে শুরু হয়ে যাক”...
“যদি কেউ আমার খেলায় কোনো গণ্ডগোল পাকাতে চেষ্টা করে; তাহলে এই লাউ বিচিগুলো এখানেই মাটিতে লাগামু! পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাছ হবে। দশমিনিটের মধ্যে লাউ হবে। সেই লাউ হাতের ছুরি দিয়ে এক কোপে দুই টুকরো করব। তারপর কিন্তু সেই বাছাধনও দুই টুকরা হয়ে যাবে! যে আমার জাদুর মধ্যে প্যাঁচ লাগাবে। তাই, জিনি জাদু জানেন, তিনি চুপ করে দেখবেন। আর যিনি সূরা ইয়াসিন জানেন তিনি দয়া করে এই খেলার মধ্যে সেই সূরার কোনো আয়াত পাঠ করবেন না। ”
মনা জাদুকর মনে করতে পারছেন না, শেষ কবে এত মানুষের সামনে জাদু দেখিয়েছেন। গ্রাম্য, শহুরে, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কিশোর-কিশোরী, নারী-পুরুষ সব মিলিয়ে তিনি বেশ মজায় আছেন। হাতের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখও চলছে। কে, কোথায়, কবে তার জাদু দেখে প্রশংসা করেছিল, কবে, কোথায়, কে তাকে পুরস্কার দিয়েছিল; সব বর্ণনা করছে। তার বর্ণনার মধ্যেও জাদু আছে। আবার চিরাচরিত অভ্যাস মতো বলছে, যদি কেউ তার জাদু নষ্ট করতে চায়, তাহলে তার বারোটা বাজিয়ে দেবে। হাতে কয়েকটি লাউ বিচি দেখিয়ে বলছে, “যদি কেউ আমার খেলায় কোনো গণ্ডগোল পাকাতে চেষ্টা করে; তাহলে এই লাউ বিচিগুলো এখানেই মাটিতে লাগামু! পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাছ হবে। দশমিনিটের মধ্যে লাউ হবে। সেই লাউ হাতের ছুরি দিয়ে এক কোপে দুই টুকরো করব। তারপর কিন্তু সেই বাছাধনও দুই টুকরা হয়ে যাবে! যে আমার জাদুর মধ্যে প্যাঁচ লাগাবে। তাই, জিনি জাদু জানেন, তিনি চুপ করে দেখবেন। আর যিনি সূরা ইয়াসিন জানেন তিনি দয়া করে এই খেলার মধ্যে সেই সূরার কোনো আয়াত পাঠ করবেন না। ”
যদিও সে জানে আজকে কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করবে না। তবুও জাদু মানেই তো কিছুটা অতিপ্রাকৃত অনুভূতি। কিছুটা ভয়। কিছুটা শিহরণ। সেটা তারা শুরুতেই কথার মায়াজালে অনেকটাই বাড়িয়ে নেন। কথা শেষ করেই মনা জাদুকর তার ঝোলা থেকে একটা বল বের করে।
বলটা দেখিয়ে সবাইকে বলল, “এটা কী দেখছেন?”
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলল, “বল!...”
বলেই সবাই অবাক! ‘বল’ বলে শেষ করেই তাকিয়ে দেখে এটা একটা ছাগলের বাচ্চা হয়ে গেছে। আবার ম্যাঁ ম্যাঁ শব্দও করছে। ততক্ষণাৎই আবার ছাগলের বাচ্চাটা নাই হয়ে গেল। মনা জাদুকর কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে প্রথমে সবাই এটাকে মজা ধরলেও একসময় ভয় পেয়ে যাওয়ার মতোই কান্না শুরু করে দিল। দর্শকরা সবাই অবাক। যখন সবাই নিশ্চিত হয়েছে যে, মনার কিছু একটা হয়েছে, তখনই লেখকের ঝোলার ভেতর ছাগলের বাচ্চাটা ম্যাঁ ম্যাঁ করে উঠল। মনা দৌড়ে গিয়ে লেখককে বলল, “আরে! আপনে তো আমার চেয়ে বড় জাদু জানেন। আমার ছাগল আপনি নিয়ে লুকিয়েছেন আপনার ব্যাগে!” উপস্থিত সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। করতালিতে চারপাশ মুখরিত হলো! লেখক বললেন, “আরে! এটা কী হলো। ছাগল আমার ব্যাগের মধ্যে কেন?”
“স্যার, শুধু আপনার ব্যাগের মধ্যেই না। আরো অনেকের ব্যাগের মধ্যেই আমার জিনিস চলে গেছে। আমার হাত ঘড়িটা কে নিয়েছেন? তাড়াতাড়ি বের করে দেন। ” বলল, মনা।
কিন্তু কেউই কথা বলছে না। এমন সময় জাদুকর একজন মধ্যবয়ষ্ক মহিলাকে তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলতে বলল। মহিলা তো রাগে লজ্জায় অস্থির। কোনো মতেই তার ব্যাগের চেইন খুলবে না। এমন সময় মনা বলে, “ঠিক আছে। আমি বের করছি। ” তখন মনা তার ঝোলা থেকে একটা পাখির বাচ্চা বের করে বলে, “যা পাখি আপার ব্যাগ থেকে আমার ঘড়ি বের করে নিয়ে আয়। ” ওমনি পাখি ভ্যানিটি ব্যাগের কাছে উড়ে আসে। সবাই অবাক হয়ে দেখে ব্যাগের ভেতর থেকে জাদুকরের ঘড়ি বের হয়ে আসছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। আবার তুমুল হাততালি। এভাবে প্রায় কয়েকঘণ্টা চলে মনার জাদু। হঠাৎ স্টেশনঘরের ঘণ্টা বেজে ওঠে। মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যের কথা ভেবে উঠে দাঁড়ায়। মজমা ভেঙ্গে যায়। প্রতিটা কিশোর কিশোরীর মুখে মুখে চলতে থাকে, “লাগ লাগ ভেলকি লাগ! বুড়া মাইনষের আডুত লাগ! পুলাপানের”...
অনতি দূরে দেখা যায় লেখক সাহেব মনা জাদুকরের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৫