পর্ব ৬ পড়তে ক্লিক করুন
লোলা মনটেজ |
১৮৩৯ সালের নভেম্বর মাস। মিসেস জেমস ভারতে এসে এক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে বিয়ে করে রীতিমতো সংসার ধর্ম পালন করছিলেন।
“দেখো, একটা কথা আগেই বলে নিই। তুমি ভারতে এসেছো কেন? হুম? উন্নত জীবনের জন্য, তাই না? তোমার এর জন্যে কী চাই? প্রচুর টাকা, তাই না? তাহলে? তোমার সব কিছু আছে। সুন্দর একটা চেহারা, রূপ, যৌবন, বয়স। সব তোমার আছে। এখন শুধুমাত্র তোমাকে আমি যা করতে বলব তা করবে। ব্যাস! তোমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। বছর পাঁচেক পর বিলেতে গিয়ে আজীবন রানী ভিক্টোরিয়ার মতোই সময় কাটাতে পারবে। ”
“এইভাবে জেমসের সাথে থাকা তোমার ঠিক হবে না। তুমি বরং তার কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে নাও। এটাই হবে তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো এবং একমাত্র পথ। ”—কেরি বড় বড় চোখ করে মিসেস জেমসের দিকে তাকায়।
“ডিভোর্স করব জেমসকে!”—মিসেস জেমসের চোখ কপালে ওঠে।
“হ্যাঁ, ডিভোর্স, তারপর গোটা ভারত তোমার হাতে। ভুলে যাবে না তুমি একজন সুন্দরী বিলাতি নারী। তোমার কিসের অভাব? জানো তুমি কত কত টাকা আয় করতে পারবে? তারপর সেই টাকায় জীবনের শেষ বয়সে বিলেতে গিয়ে বাড়ি গাড়ি, নাম প্রতিপত্তি সব হবে। ”—কেরির চোখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ।
“আমি কিভাবে টাকা আয় করব? কী বলতে চাও কেরি? সব খুলে বলো। ”—মিসেস জেমস এবার উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়লেন।
“তোমাকে কিছুই করতে হবে না। তুমি যদি রাজি থাকো সব ব্যবস্থা আমিই করব। কাল বিকেলবেলা তৈরি থেকো। তোমাকে নিয়ে আমি এক জায়গায় বেড়াতে যাব। ভালোভাবে সেজেগুজে থাকবে কিন্তু। অবশ্য তুমি এমনিতেই যেমন সুন্দরী, না সাজলেও চলবে। ”—কেরির ঠোঁটে, বাঁকা চোখে একটা হেয়ালীর হাসি ফুটে উঠল।
বিকেলটা মন্দ নয়। কেরির অপেক্ষায় মিসেস জেমস তার বোম্বের ছোট বাড়িটার বারান্দায় পায়চারি করছেন। কিন্নর নামের এক ভারতীয় আয়া এক মগ চা বানিয়ে দিয়ে গেল। চায়ের সঙ্গে শক্ত বিস্কিট। নভেম্বর মাসেও শীতের একটা পরশ গায়ে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। মিসেস জেমস বিলেত থেকে নিয়ে আসা মোটা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বিছানার এক কোণায় চুপ করে বসে রইলেন। তার ভাবনা তখন অসম্ভব এলোমেলো। সত্যি তো। কেরি ঠিক কথা বলেছে। বিলেত থেকে এই ভারত নামের জঙ্গলে আসার মানেটা কী? আমার রূপ আছে আর সেই সাথে আছে যোগ্যতা। জেমসকে আমিও দেখিয়ে দিতে চাই আমিও তার থেকে কোনো অংশেই কম না। কিন্তু কেরি কোথায়? কিন্নরকে আগে থেকেই কেরির কথা বলা আছে। কেরির কথা ভাবতে থাকা অবস্থায় কিন্নর হেলেদুলে ‘মেমসাব, মেমসাব’ চিৎকার করতে করতে মিসেস জেমসের ঘরে ঢুকল। কিন্নরের পেছনেই কেরি দাড়িয়ে। মিসেস জেমস কেরির গালে তার গাল ছোঁয়াল।
“কী? রেডি?”—কেরির চোখেমুখে যেন আগুন। আজ কেরিকে দারুণ লাগছে। কেরি ব্রাডি মূলত আইরিশ। কিন্তু ওর বাবা অনেক দিন থেকেই বিলেতের সেনাবাহিনীতে কাজ করার কারণে তারা এখন কায়দা কানুন এবং ভাষায় একেবারেই বিলাতি হয়ে গেছে।
“আমরা যাবটা কোথায়? এবার খুলে বলো দেখি?”—মিসেস জেমসের চোখে বিস্ময়।
“দেখো, একটা কথা আগেই বলে নিই। তুমি ভারতে এসেছো কেন? হুম? উন্নত জীবনের জন্য, তাই না? তোমার এর জন্যে কী চাই? প্রচুর টাকা, তাই না? তাহলে? তোমার সব কিছু আছে। সুন্দর একটা চেহারা, রূপ, যৌবন, বয়স। সব তোমার আছে। এখন শুধুমাত্র তোমাকে আমি যা করতে বলব তা করবে। ব্যাস! তোমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। বছর পাঁচেক পর বিলেতে গিয়ে আজীবন রানী ভিক্টোরিয়ার মতোই সময় কাটাতে পারবে। ”—খুব ধীরস্থিরভাবে কথাগুলো বলল কেরি ব্রাডি।
মিসেস জেমস চুপ করে সব কথা শুনল এবং চুপ হয়ে বিছানায় বসে রইল। বোঝা যায়, মনের সাথে তার বেশ বোঝাপড়া চলছে। কেরি তা বুঝতে পারে। আলতো করে সে মিসেস জেমসের কাঁধে হাত রাখে। তারপর শক্ত করে তার হাত ধরে বলে, “কোনো চিন্তা করো না। আমি তো তোমার পাশে সবসময়ই আছি। এবার হাসো তো লক্ষ্মীমানিক আমার। ”
“আচ্ছা তোমার নতুন সুন্দর একটা নাম দিলে কেমন হয়? লোলা মনটেজ? কী, কেমন লাগে?”—কেরির চোখে বাঁকা হাসি।
“লোলা মনটেজ? আমার নতুন নাম? বাহ! মন্দ না। কিন্তু এই নামটা তুমি কোথায় পেলে?”
“আয়ারল্যান্ডে আমাদের এক সুন্দরী বোন আছে। তাকে আমরা ডাকি লোলা বলে। তোমার মতোই সুন্দরী। তাই তোমার নাম রাখলাম লোলা মনটেজ। ”
শুরু হলো লোলা মনটেজের নতুন জীবন। বলাই বাহুল্য লেফটেন্যান্ট স্বামী জেমসের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর লোলা মনটেজ ব্রিটিশ ভারতের উচ্চ মহলে বেশ পরিচিতি লাভ করলেন। যেনতেন প্রকারের দেহ ব্যবসাই শুধু নয়, পরবর্তীতে লোলা এই ব্যবসাকে উচ্চ স্থানীয় বিলাতি সমাজেও ধ্রুপদী পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন এবং বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। যদিও সেই সময় বিলেতের রক্ষণশীল সমাজে ভারতে বিলাতি নারীর এই হীন কর্মের অনেক সমালোচনা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালের ১৭ জুন মেমারেন্ডাম ২১ নামে পরিচিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, ভারতের সেনা ছাউনীতে যে বিলাতি সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের মনোরঞ্জনের জন্যে ভারতীয় গণিকা নিয়োগ দিতে বিলেত সরকারের কোনো অসুবিধা নেই। তবে এই গণিকাদের রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। রেজিস্ট্রার্ড গণিকাদের প্রতি সপ্তাহেই শারীরিক চিকিৎসা নেওয়াও বাধ্যতামূলক। উল্লেখ্য, সেই সময় প্রতি এক হাজার বিলাতি সেনার জন্য মাত্র পনের জন ভারতীয় গণিকা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালে ভারতের মিশনারিতে কর্মরত দুই আমেরিকান মহিলা কেথারিন বাসনিল এবং এলিজাবেথ এনড্রিও বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন এবং এটাকে চরম গর্হিত কাজ বলে উল্লেখ করেন। (http://www.mainstreamweekly.net/article2142.html)
কিন্তু আদি এই পেশায় নিমজ্জিত বিলাতি নারীরা থেকে গেলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। লোলা মনটেজ ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন উচ্চপদস্থ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং বিলাতি সেনাবাহিনীর একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিত্ব।
পর্ব ৮ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৫