ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ৩ কিস্তি ১৮) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

অনুবাদ উপন্যাস ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫
১৯৮৪ | জর্জ অরওয়েল (খণ্ড ৩ কিস্তি ১৮) || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

George_Orwell_inner১৯৮৪ (নাইনটিন এইটি ফোর)—বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েলের অমর গ্রন্থ। ১৯৪৯ সালে তার মৃত্যুর এক বছর আগে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

২০০৪ সালে ‘দি গার্ডিয়ান’র জরিপে উপন্যাসটি বিশ্বের চিরায়ত গ্রন্থের তালিকায় উঠে আসে সবার উপরে। ইংরেজি ভাষার এই উপন্যাসটি কালজয়ী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। যাতে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তির প্রেক্ষাপট। বাংলানিউজের জন্য বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন মাহমুদ মেনন। উল্লেখ্য, জর্জ অরওয়েলের মূল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালের ১৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের মথিহারিতে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন লন্ডনে ১৯৫০ এর ২১ জানুয়ারি। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘দি রোড টু উইগ্যান পাইয়ার’, ‘হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া’, ‘এনিম্যাল ফার্ম’।

___________________________________

শুরু থেকে পড়তে ক্লিক করুন

তৃতীয় খণ্ডের ১৭ম কিস্তি
___________________________________


ইনস্টনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছিলেন তিনি। এতটাই কাছে যে তার মুখটি বিশাল বলে মনে হচ্ছিল, আর আরো কদাকার, কারণ নিচ থেকে সে ওটি দেখছিল। উপরন্তু তাতে মেখেছিল এক ধরনের পরমানন্দ আর পাগলাটেপনা। এতে উইনস্টনের হৃদয়খানি সংকুচিত হলো। হতে পারে এই বিছানাতেই সে গলে যাবে। অনেকটা নিশ্চিত করেই যেন বুঝতে পারছে ও’ব্রায়েন স্রেফ খেয়ালিপনায় আবার টেনে দেবেন ডায়ালের কাঁটা। তবে সেটা না করে ঠিক তখনই ও’ব্রায়েন পেছনে ঘুরলেন। এক-দুই পা আসা যাওয়া করলেন। আর অতঃপর কিছুটা কম উগ্রতায় ফের বলতে শুরু করলেন:



আর এমনকি মৃতদেরও আমরা আমাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার সুযোগ দেই না। উত্তরপুরুষ তোমার জন্য ন্যায্যতা এনে দেবে সে অলীক কল্পনা তোমায় বন্ধ করতেই হবে, উইনস্টন। উত্তরপুরুষরা তোমার কথা জানতেই পাবে না। ইতিহাসের স্রোত থেকে তোমাকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে। আমরা তোমাকে গ্যাসে পরিণত করব আর আন্তর-আকাশে মিলিয়ে দেব। তোমার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, রেজিস্ট্রারে থাকবে না, জীবন্ত কোনো মস্তিষ্কেই থাকবে না কোনো স্মৃতি। অতীতে এবং ভবিষ্যতে দুইয়েই তুমি বিলীন হয়ে যাবে। তুমি কখনোই বিরাজিত ছিলে না, নেই, থাকবে না।



‘প্রথমেই তোমাকে বুঝতে হবে এটা এমন এক জায়গা যেখানে শাহাদৎ লাভের কোনো সুযোগ নেই। অতীতের ধর্মীয় নিপীড়নের কথা তুমি পড়েছো। মধ্যযুগের বিচারসভার কথাও জানো। ওসব কিছুরই কোনো মানে এখানে নেই। ওদের কাজ ছিল উৎপথগামিতার অবসান, আর কেবল অবসানই নয়, পুরোপুরি বিস্মৃত করে ছাড়া। প্রতিটি উৎপথগামিতায় তখন মৃত্যুআজ্ঞাপ্রাপ্তকে বেঁধে রাখা খুঁটিসমেত পুড়িয়ে দেওয়া হতো, আর তাতে অবদমিত হতো আরো হাজারো উৎপথগামী। কেন জানো? কারণ শত্রুদের প্রকাশ্যেই হত্যা করা হতো, আর তাদের এমন সময় হত্যা করা হতো যখনও তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অননুতপ্ত। সেই অননুতপ্ততাই হতো তাদের মৃত্যুর কারণ। মানুষগুলোও মৃত্যুকে বরণ করে নিত কারণ তারা তাদের সত্যিকারের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকত। আর স্বাভাবিকভাবেই যত যশ তাও ওই ভুক্তভোগীর পক্ষেই যেত আর ঘৃণা বা লজ্জাই জুটত বিচারকর্তার কপালে যারা তাকে পুড়িয়ে মারত। এরপর, বিংশ শতকে, এলো সমগ্রতাবাদীরা। হ্যাঁ ওই নামেই তাদের ডাকা হতো। জার্মানির নাৎসি আর রাশিয়ার সাম্যবাদীরাও ছিল। রুশরা উৎপথগামীদের বিচার করত ধর্মযাজকদের চেয়েও নিষ্ঠুরতায়। তারা মনে করত, অতীত থেকেই তাদের শিক্ষা, তারা জানত, যেভাবেই হোক কারো শহীদান লাভের সুযোগ দেওয়া হবে না। প্রকাশ্য বিচারে তারা যখন কোনো অপরাধীর সাজা দিত, তখন ইচ্ছা করেই তাদের মর্যাদার শেষ তলানিটুকুও খর্ব করে ছাড়ত। নির্যাতনে নির্যাতনে ওদের জর্জরিত করে দিত, যতক্ষণ না পর্যন্ত মাটিতে শুয়ে পড়ে, যা কিছু স্বীকার করে নিতে বলা হতো তাই ওদের মুখে ফুটত, নিপীড়নে, আঘাতে, অপদস্থতায় ওরা একজন অন্যজনের পেছনে লুকোত আর বিড়বিড় উচ্চারণে কেবল ক্ষমা চেয়েই চলত। এর কয়েক বছর পর একই ঘটনা আবারও ঘটত। তখন মৃত ব্যক্তিটি পেত শহীদের মর্যাদা, তাদের অপকৃষ্টতার কথাও সবাই ভুলে যেত। এরপর আবারও, কেন এমন হতো? প্রথমত কারণ তারা যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল তা ছিল ভয় দেখিয়ে আদায় করা আর নিঃসন্দেহেই অসত্য। আমরা এ ধরনের কোনো ভুল করি না। এখানে যে স্বীকারোক্তি উচ্চারিত হয় তার সবই সত্য। আমারাই তাকে সত্যে পরিণত করি। আর এমনকি মৃতদেরও আমরা আমাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার সুযোগ দেই না। উত্তরপুরুষ তোমার জন্য ন্যায্যতা এনে দেবে সে অলীক কল্পনা তোমায় বন্ধ করতেই হবে, উইনস্টন। উত্তরপুরুষরা তোমার কথা জানতেই পাবে না। ইতিহাসের স্রোত থেকে তোমাকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে। আমরা তোমাকে গ্যাসে পরিণত করব আর আন্তর-আকাশে মিলিয়ে দেব। তোমার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, রেজিস্ট্রারে থাকবে না, জীবন্ত কোনো মস্তিষ্কেই থাকবে না কোনো স্মৃতি। অতীতে এবং ভবিষ্যতে দুইয়েই তুমি বিলীন হয়ে যাবে। তুমি কখনোই বিরাজিত ছিলে না, নেই, থাকবে না। ’

তাহলে কেন আমাকে এত নির্যাতন? এক লহমার তিক্ততায় ভরা ভাবনা উইনস্টনের। ও’ব্রায়েন থমকালেন, যেন উইনস্টনের ভাবনার কথাটি সশব্দে বেজেছে তার কানে। তার বৃহৎ কদাকার মুখটি, কিছুটা সংকুচিত চাহনি নিয়ে ক্রমেই কাছে আসতে লাগল।

‘তুমি ভাবছো, আমরা যদি তোমাকে ধ্বংসই করে দেই, তাহলে তুমি যা বলছো বা করছো তাতে কিছুই যেয়ে আসে না। আর তাই যদি হয়, কেনই আমরা তোমার ওপর এত কষ্টের জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছি? সেটাই তো তো তুমি ভাবছো, নয় কি?’

‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।

ইষৎ হাসলেন উইনস্টন। ‘তুমি একটা ঝামেলার মানুষ, উইনস্টন। তুমি একটা কলঙ্ক যা মুছে ফেলতেই হবে। একটু আগেই তোমাকে বললাম না, অতীতের যন্ত্রণাদাতাদের মতো নই আমরা? নেতিবাচক আনুগত্যে আমাদের আস্থা নেই, এমনকি সর্বান্তকরণ সমর্পণের পরেও নয়। সবশেষে তুমি যখন আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তখন তোমাকে নিজের ইচ্ছাতেই করতে হবে। আমরা উৎপথগামীকে ধ্বংস করে দেই না, কারণ সে আমাদের প্রতিহত করে। যতদিন সে প্রতিহত করতে থাকে ততদিন আমরা তাকে ধ্বংস করি না। আমরা তাকে পাল্টে দেই। তার ভেতরের মনটাকে কব্জা করি, তাকে নতুন একটা গড়ন দেই; ভেতরের সকল দুষ্টু চিন্তাকে পুড়িয়ে দেই, আর ভেতর থেকে সকল ভ্রম বের করে আনি; আমরা তাকে পুরোপুরি আমাদের পক্ষে নিয়ে আসি, দেখানোয় নয়, বাস্তবে, মনে আর প্রাণে। আমরা তাকে আমাদেরই একজন করে ফেলি কারণ আমরা তাকে হত্যা করি। বিশ্বের কোথাও একটি ভ্রান্ত ভাবনা টিকে থাকুক তা আমাদের কাছে সহনীয় নয়, হোক সে গোপনে কিংবা অক্ষমতায়—যে কোনোভাবে। একই মৃতের ক্ষেত্রেও আমরা কোনো ব্যত্যয় মেনে নেই না। আগের উৎপথগামীরা মৃত্যু দুয়ারের দিকে এগিয়ে যেত একজন উৎপথগামী হিসেবেই, নিজেদের অবস্থান ঘোষণা দিতে দিতে, উল্লসিত ভঙ্গিমায়। রুশ শুদ্ধিকরণ অভিযানের যারা শিকার তারাও মাথায় বুলেটবিদ্ধ হওয়ার জন্য পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময়ও মস্তিষ্কে বিদ্রোহের আগুনই বহন করত। কিন্তু আমরা মস্তিষ্কটি উড়িয়ে দেওয়ার আগে সেটিকে শুদ্ধ করেই ছাড়ি। অতীতের অসীম ক্ষমতাধারীদের নির্দেশ ছিল “তুমি করবে না” সমগ্রতাবাদীদের নির্দেশ ছিল “তুমি করবে”। আমাদের নির্দেশ হচ্ছে, “তুমি রপ্ত করবে”। এই পর্যন্ত এইখানে আমরা যাদেরই এনেছি তাদের কেউই  আমাদের বিরুদ্ধে থাকে নি। প্রত্যেককেই ধুয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। এমনই সেই তিন হতভাগা ষড়যন্ত্রী, যাদের তুমি নির্দোষ বলেই একদা ভাবতে—জোন্স, অ্যারনসন, আর রাদারফোর্ড—তারাও শেষমেষ এখানে মাথাকুটে পড়েছিল। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে আমি নিজেই অংশ নেই। আমি ওদের ধীরে ধীরে ভাঙতে দেখেছি, গুমড়াতে দেখেছি, আত্মমর্যাদা ভুলে দয়াভিক্ষা চাইতে দেখেছি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি—শেষে আর ব্যথা কিংবা ভয়ে নয়, স্রেফ ধৈর্যশীলতায় তারা ওসব চালিয়ে গেছে। আর ওদের সঙ্গে আমাদের কাজ যখন শেষ হলো তখন ওরা মানুষের কাঠামো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাদের মধ্যে দুঃখবোধ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আর সেই দুঃখবোধ ছিল তাদের কৃতকর্মের জন্য আর বিগ ব্রাদারের প্রতি ভালোবাসার জন্য। ওরা তাকে যতটা ভালোবেসেছিল তা ছিল মর্মগ্রাহী। তখন তাদের একটাই প্রার্থনা ছিল, তাদের মন পরিষ্কার থাকতে থাকতে, ফের কলুসিত হওয়ার আগেই যেন তাদের গুলি করা হয়।

তৃতীয় খণ্ডের ১৯ম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।