পর্ব ৯ পড়তে ক্লিক করুন
ফ্লোরেন্স ম. উইলড |
১৯০৯ সালের অক্টোবর মাস। ত্রিশ বছর বয়সী বিলাতি নারী মিস ফ্লোরেন্স উইলডকে হায়াদ্রাবাদের মাউন্ট চার্লস স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইংল্যান্ডে গিয়ে এডিথের উপলব্ধি—ভারতে শিখে আসা তার যাবতীয় জ্ঞানবিদ্যা সবকিছুই যেন ভুল। কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে আদব কায়দা—সব কিছুই এডিথ ডিকসনকে বিলেতের নতুন পরিবেশে নতুন করে শিখতে হলো। দূর থেকে বিলেতকে অনেক আধুনিক এবং সুন্দর একটি শহর মনে হলেও এডিথ সেখানে পৌঁছে বিষণ্ণভাবে দিন কাটাতে লাগলেন। এডিথের ভাষায়, “সবাই বলত যে, বিলেত কতই না সুন্দর! তখন আমি মনে মনে ভাবতাম কী সেই সুন্দর? কোনো সুন্দরই আমার চোখে ধরা পড়ছে না। ইংল্যান্ডে সুন্দরকে খুঁজে পেতে আমার অনেকদিন লেগেছিল। ইংল্যান্ডকে আমার কাছে সবসময় ধূসর, ছোট, উদ্দীপনাহীন একটা দেশ মনে হয়েছে। সেই তুলনা ভারত কতই না বৈচিত্র, উষ্ণতা আর আনন্দে ভরপুর একটা দেশ”
তবে এতসব ঝামেলার পরও মিস ফ্লোরেন্স ভেঙে পড়েননি। তিনি ক্লাসে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করলেন। এলাকার গণ্যমান্য সবার সাথে মেশার চেষ্টা করলেন। স্কুলে এলাকার রাজনৈতিক নেতা এবং ধর্মীয় ইমামদের দাওয়াত দিলেন এবং স্কুলটা কিভাবে ভালো করে শুরু করা যায় সে ব্যাপারে সবার সহযোগিতা চাইলেন। তার এই সামাজিক যোগাযোগের কারণে ক্লাসে ধীরে ধীরে ছাত্র সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। ক্লাসে ছাত্ররা নিজেদের খাতা কলম নিয়ে আসার অভ্যাসটিও রপ্ত করল। মিসেস ফ্লোরেন্স তার স্কুলে ইংরেজি, পিয়ানো এবং খেলাধুলার মাধ্যমে শব্দ শেখার বিভিন্ন রকম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সময় তার ক্লাসের দুজন ভারতীয় ছাত্রী খুব ভালো পিয়ানো বাজিয়ে বেশ নাম করেছিল। তবে মুসলিম ভারতীয় এ দুই নারীকে পিয়ানো শেখানো ফ্লোরেন্সের জন্যে মোটেও সহজ কোনো কাজ ছিল না। প্রথম পিয়ানো পরীক্ষাতেই বাধ সাধলেন ছাত্রীদ্বয়ের বাবা-মা। তারা চান তাদের মেয়েরা হাত মোজা পরে পিয়ানো বাজাক। উন্মুক্ত হাতে পুরুষের সামনে পিয়ানো বাজানোর ব্যাপারে তাদের বাবা-মা কিছুতেই রাজি ছিলেন না। মিস ফ্লোরেন্স হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। তিনি অনেক বুঝিয়ে ছাত্রীদের অভিভাবকদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, শুধু পরীক্ষায় পাস করার জন্য তাদের খালি হাতেই পিয়ানো বাজাতে হবে। এদিকে মিস ফ্লোরেন্সে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেলেন। ততদিনে ছাত্রীদের চোখে তিনি ‘মিস মা’। ততদিনে স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে চল্লিশে উত্তীর্ণ হয়েছে। ১৯১৮ সালে স্কুলটি মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জনকারীদের উদ্দেশ্যে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করে। সেখানে স্কুলের ছাত্রীদের দিয়ে ‘মিড সামার নাইট’স ড্রিম’ নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয় এবং উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ উৎসাহ তৈরি হয়।
এখানে ভারতীয় নারীদের শিক্ষার পাশাপাশি বিলাতি নারীদের শিক্ষা নিয়েও দুটো কথা বলা প্রয়োজন। বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান অভিভাবকগণ ভারতে তাদের সন্তানদের সঠিক কায়দায় বড় করে শিক্ষিত করে তুলতে ভয় পেতেন। তাই সন্তানদের বিলেতে পাঠিয়ে পড়াশোনা করানো তাদের কাছে ছিল স্বপ্ন। বিলেত ছিল তাদের চোখে ’হোম’। এডিথ ডিকসনের বাবা ছিলেন ভারতীয় রেলওয়ের একজন উচ্চশ্রেণীর কর্মকর্তা। এডিথের বয়স যখন সাত তখন বিলাতি কায়দায় পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার স্বার্থে তাকে বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এডিথ সেই স্মৃতি নিয়ে বলছেন, “আমার মনে আছে, আমাকে বিদায় দিতে আমার পরিবারের সবাই রেলস্টেশনে এসে জড়ো হলেন। আমার ট্রেনটা ছেড়ে দিচ্ছে আর ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে। বাবার দূর থেকে হাত নাড়ানোর দৃশ্যটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। ” ইংল্যান্ডে গিয়ে এডিথের উপলব্ধি—ভারতে শিখে আসা তার যাবতীয় জ্ঞানবিদ্যা সবকিছুই যেন ভুল। কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে আদব কায়দা—সব কিছুই এডিথ ডিকসনকে বিলেতের নতুন পরিবেশে নতুন করে শিখতে হলো। দূর থেকে বিলেতকে অনেক আধুনিক এবং সুন্দর একটি শহর মনে হলেও এডিথ সেখানে পৌঁছে বিষণ্ণভাবে দিন কাটাতে লাগলেন। এডিথের ভাষায়, “সবাই বলত যে, বিলেত কতই না সুন্দর! তখন আমি মনে মনে ভাবতাম কী সেই সুন্দর? কোনো সুন্দরই আমার চোখে ধরা পড়ছে না। ইংল্যান্ডে সুন্দরকে খুঁজে পেতে আমার অনেকদিন লেগেছিল। ইংল্যান্ডকে আমার কাছে সবসময় ধূসর, ছোট, উদ্দীপনাহীন একটা দেশ মনে হয়েছে। সেই তুলনা ভারত কতই না বৈচিত্র, উষ্ণতা আর আনন্দে ভরপুর একটা দেশ” (The Dust in the Balance : British Women in India 1905-1945, writer Pat Barr, Hamish Hamilton, London, 1989, page 16)
তবে বিলেতের এই নির্বাসনকে আপাত দৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও ভারতের জন্ম নেওয়া বিলাতি শিশুদের জন্য এটিই ছিল একটি স্বাভাবিক বিষয়। ভারতে দীর্ঘদিন জীবন যাপন করলেও বিলাতিরা কখনোই চাইত না ভারতে বসবাসের কারণে তাদের ছেলেমেয়েরা বিলাতি শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাক। আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের শিশুদের বিলেতে পাঠানো ছিল তখনকার একটি নিয়মিত ঘটনা। যেসব শিশুরা ভারতেই বিলাতি শিক্ষা নিতে পারত—তারাও নিজেদের সব রকমভাবে বিলাতি আচার আর আদব কায়দায় গড়ে তুলত। বইপত্র থেকে শুরু করে সব রকম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিলেত থেকে ভারতে আসত তাদের জন্য। বিলাতি শিক্ষার কারিকুলাম অনুযায়ী ভারতের স্কুলেই তাদের শিক্ষিত করা হতো। সেক্ষেত্রে বিলাতি নারীরা তাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে নিজেদের উৎসর্গ করে দিত। বিলাতি নারী অনড্রে মনিকার কথাই ধরা যাক। তিনি ১৯১৩ সালে ভারত এসেছিলেন স্বামীর সাথে পাকপাকিভাবে জীবন যাপন করার জন্য। তার বাবা জসেফ ক্লে ছিলেন একজন ডেপুটি কমিশনার। ক্লে তার বাড়িতে মেয়ের পড়াশোনার জন্যে আলাদা একজন শিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন। তার পড়াশোনার ফিরিস্তিটি ছিল এরকম—ঘুম থেকে উঠেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে অবশ্যই পনের মিনিটের জন্য শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। তারপর বিশাল ডাইনিংরুমে সকালের নাস্তা। নাস্তার পরই পড়াশোনায় বসা। টেক্সট বইগুলো ছিল কলকাতার ‘থাকার স্পিঙ্কস’-এর প্রকৃতি থেকে শিক্ষা, ইতিহাস, লংমেন রচিত পাটিগণিত শিক্ষা ইত্যাদি। পড়াশোনায় ভালো ফলের জন্যে জসেফ তার মেয়ের জন্যে ভালো পুরস্কারের ব্যবস্থাও করে রাখতেন। বাবা-মার সহযোগিতায় মনিকা ভারতে থেকেই বিলাতি কায়দায় মানুষ হতে থাকলেন। ভারতে দীর্ঘদিন থাকলেও বিলাতিরা কখনোই ভারতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং জীবন ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি।
বিলাতি নারী মিস ফ্লোরেন্স এম. ওইলড তার পড়াশোনার পদ্ধতি নিয়ে যে কথাটি বলে গিয়েছেন তা হলো, “Our aim was still the same. We were trying to train the girls to think- and give them something worthwhile to think about.”
পর্ব ১১ পড়তে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ সময়: ১৬০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৫