ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আদিবাসি নৃত্যের মিথ | সালেক খোকন

আদিবাসি সংস্কৃতি ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
আদিবাসি নৃত্যের মিথ | সালেক খোকন

লছে মাদল-ঢোলের বাদ্য। তালে তালে নাচছে একদল নারী।

পায়ে নূপুর জড়ানো। খোঁপায় ঝুলছে নানা রঙের ফুল। কণ্ঠ আকাশে তুলে হাত ধরাধরি করে নাচছে তারা। মাঝে মধ্যেই গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে প্রিয় পানীয় হাঁড়িয়াতে। সমবেত কণ্ঠে আদিবাসি সুর :
‘আতো গাতি কুরি কোড়া
মায়া জালাং ছাড়া কিদেই
ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে...’

সাঁওতালী ভাষার গানটির ভাবার্থ:

‘গ্রামের যত যুবক-যুবতী আছে
মায়ার জালে আটকা তাদের কাছে
ছিলাম আমি, এখন বোঙ্গার জ্বালা
ছিঁড়ল মায়া, আমার যাওয়ার পালা। ’
গ্রামের নাম মহেশপুর। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী আদিবাসি গ্রাম এটি। সাঁওতালদের আধিক্য থাকলেও এখানটাতেই পাড়াভেদে বাস করে নানা বিশ্বাসের আদিবাসিরা। সাঁওতালদের গ্রামপ্রধান বা মহত দালু সরেনের বাড়িতে চলছে ঝুমুর নাচের আসর। তারই আমন্ত্রণে আমরা এসেছি এ গ্রামটিতে।

কেন এই নাচের আয়োজন? উত্তরে দালু বলেন, ‘বছরের যেকোন সময় এবং যেকোন স্থানে ঝুমুর নাচ হতে পারে।   পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গানের তালে তালে এ নাচ চলে। এ নাচের আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। দাঁড় ঝুমুর, টাঁড় ঝুমুর, ভাদুরিয়া ঝুমুর, নাচনী ঝুমুর প্রভৃতি।

ঝুমুর নাচে কোথাও দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা, কোথাও বৃষ্টির আহ্বান এবং কোথাও নর-নারীর প্রেম বিনিময়ের কথা ব্যক্ত হয়। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ঝুম্ ঝুম্ শব্দ তুলে এই নাচের উদ্ভব বলেই এর নামকরণ হয়েছে ঝুমুর। সাঁওতাল ছাড়াও ওরাওঁ, মাহাতো, লোহার, কুর্মী, ভূমিজ, ভুইঞা প্রভৃতি আদিবাসি সমাজে ঝুমুর নাচ ও গানের প্রচলন রয়েছে।

নাচ-গানের ফাঁকে ফাঁকে আমরা আদিবাসিদের নৃত্য নিয়ে আলাপ জমাই।

সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, নৃত্য ঐশ্বরিক দান। দেবতাদের সহায়তায়ই তা মানব সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। এ নিয়ে সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। কাহিনীটি:

সৃষ্টির শুরুর দিকের কথা। সাঁওতালরা তখনও কোনো দেবদেবীর পূজা করত না। ফলে নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও ছিল তাদের কাছে অজানা। একবার দু’জন সাঁওতাল যুবক গেল গহীন জঙ্গলে। সূর্য ডুবতেই চারদিকে অন্ধকার নামল। তারা রয়ে গেল বনের মধ্যেই। ওই রাতেই তারা শুনতে পেল গান ও নৃত্যের শব্দ। এই শব্দ তাদের কাছে একেবারেই নতুন। তারা শব্দ ধরে এগোতে থাকে। কাছাকাছি পৌঁছাতে তারা তো ভয়েই অস্থির। দু’জনই একটি উঁচু গাছে উঠে দেখল—মরেকো, জাহের এরা, মারাংবুরো ও গোঁসাই—এ তিন স্বর্গীয় দেবতা নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নৃত্য করছে।

হঠাৎ এক দেবতা থেমে গেলেন। বললেন, আশেপাশে মানুষের গন্ধ। তার কথা শুনে দেবতা জাহের এরা নির্দেশ করলেন, “তাদের কোনো ক্ষতি করো না। বরং তাদের এখানেই নিয়ে আসো। ” যুবক দু’জনকে আনা হলো এবং তারা সারারাত দেবতাদের সঙ্গে নাচল। ভোরবেলা তাদের হাতে দু’টো ঢোল দিয়ে দেবতাদের নির্দেশ, “তোমরা তোমাদের মানবকুলে ফিরে গিয়ে সব বলো। তোমরা এখানে যেমন করলে, তা যেন সবাই শেখে এবং আমাদের সম্মান দেখিয়ে পূজা করে। ” এভাবেই সাঁওতাল সমাজে গান ও নৃত্যের বিস্তার ঘটে।

সাঁওতাল-নৃত্যগুলোর মধ্যে লাগরেঞ, দোন, ঝিকা, জাতুর, রিনজা, বাহা, ঝুমুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এরা পূর্ণিমা রাতে লাগরেঞ নৃত্য, বিবাহ অনুষ্ঠানে দোন, ঝিকা, ফসল কাটার উৎসবে জাতুর, বৃষ্টির আহ্বানের জন্য রিনজা, বসন্তকে বরণ করে নিতে বাহা নৃত্যের আয়োজন করে থাকে।

নৃত্যে মনিপুরী আদিবাসিদের খ্যাতি বিশ্বময়। এদের বিশ্বাস, পৃথিবী সৃষ্টির মূলেই রয়েছে নৃত্য। দেবতা ও দেবীকে মনিপুরী ভাষায় বলে লাইবংথু ও লাইনুরা। এরা মনে করে দেবতা ও দেবীদের চেষ্টার ফসল এই পৃথিবী। এ নিয়ে মনিপুরী সমাজে প্রচলিত আছে একটি লোককাহিনী। কাহিনীটি:

সর্বপ্রথমে চারদিকে ছিল কেবল পানি আর পানি। স্থলের চিহ্নমাত্র ছিল না। ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিলেন, পৃথিবী সৃষ্টি করবেন। আর ওমনি সাতজন দেবী সেই পানির ওপর নৃত্য শুরু করলেন। তাদের নৃত্যের তালে মুগ্ধ হলেন নয়জন দেবতা। নৃত্যের তালে তালে স্বর্গ থেকে তারা ঢিল ছুঁড়তে থাকলেন। আর এভাবেই, সে ঢিলের মাটি জড়ো হয়েই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে—যে কারণে মনিপুরীদের কাছে নৃত্য অতি পবিত্র।

চৈত্র-বৈশাখ মাসে পক্ষকাল ধরে এ আদিবাসিরা আয়োজন করে ‘লাই হারা-উবা’ নৃত্য। লাই অর্থ দেবতা আর ‘হারা উবা’ অর্থ আনন্দ। দেবতাদের আনন্দদানের উদ্দেশ্যেই নিবেদিত এই নৃত্য। এছাড়া এরা দৈবশক্তির প্রতি প্রার্থনার মানসে নদীতে নেমে লাই-একাউবা নৃত্য এবং বৃষ্টির আহ্বান জানাতে লাই-থেম্বা নৃত্যের আয়োজন করে।

মনিপুরীদের নৃত্যধারার প্রভাব রয়েছে খাসীয়া সমাজেও। এদের নৃত্যের বিস্তৃত অংশ জুড়েই আছে ধর্মীয়ভাব। খাসীয়াদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নৃত্য ‘নোংগক্রেম’। ফসল উৎপাদনের সময় এরা আয়োজন করে ‘বেহদিয়াম খাম’ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে তারা ফসল দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে এ নৃত্য করে। নাচতে হয় বৃত্তাকারে। বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে একটি পবিত্র কাঠ। বাজানো হয় বাঁশি, মাদল, ঢাক-ঢোল ইত্যাদি। নাচের এক পর্যায়ে কাঠ দিয়ে ফসলখেত থেকে অপদেবতা তাড়ানো হয়।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গারো-নৃত্যের অবতারণা হয়। নৃত্যের ভাব-বিভাবের মধ্যে দেহবিক্ষেপ ও অঙ্গসঞ্চালনই প্রধান। এর মাধ্যমে গারোরা পশুপাখির অনুকৃতি, খাদ্য গ্রহণ, বৃষ্টির আহ্বান, ফসল কাটা, বোনা, দেবদেবীর কাছে প্রার্থনাসহ নানা কিছু ব্যক্ত করে। সাঁওতালদের মতো গারোদের বেশির ভাগ নাচ অনুষ্ঠিত হয় জুম চাষকে কেন্দ্র করে। গালমাকজা বা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ওয়াচেংজা বা জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কে এরা এক বছর হিসেবে গণনা করে। প্রায় প্রতি মাসেই গারোদের দু’একটি নৃত্যানুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এগুলোর মধ্যে ঘোরির আ, মংসি আ, গিন্দেগালা, কিলপুআ, আমব্রে রুরু আ, দুকরু সুআ প্রভৃতি নাচ উল্লেখযোগ্য।

গারোদের বিশ্বাস, কয়েকজন অপদেবতা তাদের শস্য নষ্ট করে। এরা হলো বাং, বাকওয়েন, রাক্কাসি, মিসকাল, চু আল। মূলত এদের হাত থেকে রক্ষা পেতেই আদিবাসিরা ঘোরির আ, চামে মিককাং নি অ, জিক সেককাং ইত্যাদি নাচের আয়োজন করে। নাচের সময় সকলের হাতে থাকে তীর, ধনুক, বল্লম। নাচের তালে তালে অস্ত্রশস্ত্র দেখিয়ে এরা অপদেবতাকে ভয় দেখায়, যাতে তারা ফসল নষ্ট না করে। একই সঙ্গে অস্ত্রের কলাকৌশলই এসব নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

এছাড়া রাজবংশী সমাজে ব্রতনাচের মাধ্যমে তাদের সংসার ধর্ম ও পরিবারের সুখ সমৃদ্ধির কামনা ব্যক্ত করা হয়। দূর্গাপূজা, কার্তিক পূজা ও কালী পূজার সময় রাজবংশী যুবক ও রমণীরা কখনো বিধাব ও বৈরাগীরা ধূপদানীতে ধূপ জ্বালিয়ে হাতে নিয়ে ঢাক-কাঁসারের তালে নাচেন, একে বলা হয় ধূপ নাচ। রংপুরের কোনো কোনো অঞ্চলে চৈত্র বৈশাখ মাসে খরা দেখা দিলে রাজবংশী গ্রামের মেয়েরা একত্রে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল-ডাল তোলে। মেয়েদের মধ্যে একজন ‘রাজা’ হয় এবং একজন ‘রাণী’। রাজা রাণীর মাথায় একজন ছেঁড়া ছাতা বা গ্রাম্য মাথাল ধরে। অপর একজন ভাঙা টিন বাজায় ও সাথে মেয়েরা গান-নাচ করে।

এ সম্প্রদায়ে—বিয়ের পরদিন বৌ নিয়ে বর তার নিজ গৃহে ফিরে এলে বধূকে বরণ করতে বরের বাড়িতে চলে বধূবরণ নৃত্য। ধান, দূর্বা, ফুল ইত্যাদি বর-কনের মাথায় ছিটিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় আশির্বাদ করা হয়। এ সময় এরা থালা নৃত্য, রেকাবী নৃত্য এবং কলস নৃত্যও পরিবেশন করে। এছাড়া শিবপূজার গাজন নৃত্যের সময় রঙ মেখে সঙ সেজে যুবকেরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচ করে। মহিলার বেশ ধারণ করে কিছু যুবক। তাদের গৌরী বলা হয়। এ নৃত্যের মুদ্রায় রাধা-কৃষ্ণের মান-অভিমান, চণ্ডীদাস-রজকিনির প্রেম প্রভৃতি প্রকাশ পায়। এছাড়াও এরা পারিবারিক মঙ্গল, সমস্যা থেকে মুক্তি ও গ্রামের মঙ্গল কামনায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে জল ঢেলে কাদামাটি নৃত্য করে থাকে। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গারোদের অনেক নৃত্য ও আচারই আজ লুপ্তপ্রায়।

রাখাইন আদিবাসি তরুণীরা দলবদ্ধ হয়ে আধুনিক ব্যালে নৃত্যের মতো কিছু নাচ পরিবেশন করে। এ নাচের বিভিন্ন মুদ্রায় রাখাইনদের সমাজ-জীবনের জন্ম, বাল্যকাল ও বয়ঃপ্রাপ্তি, বিভিন্ন খেলাধুলা, উৎসব পার্বণসমূহের চিত্র ফুটে ওঠে। রাখাইন ভাষায় নাচগুলোকে সেইং ডেইং, আজিং জিকে, আরাছামাংগী, হেং, য়েইং, সাং গ্রেং, রাঠা ছোয়ে হেং নৃত্য বলা হয়। এছাড়া প্রত্যেক এলাকায় বর্ষারম্ভে দেবতাদেরকে তুষ্ট করতে এরা নেৎ নৃত্য, ওয়াং-গাবা উৎসবে নাগ নৃত্য, অভিনয়ের মাধ্যমে ঙাচে নৃত্য ও ধর্মীয় পুরোহিতের মৃতদেহকে শ্রদ্ধা জানাতে ডুং, ছেইং নৃত্যের আয়োজন করে।

আদিবাসিদের বিশ্বাস, নৃত্যের তাল এবং গানের সুরে আছে অতিমাত্রায় সারবস্তু এবং ম্যাজিক বা ঐন্দ্রজালিক শক্তি। জীবনধারণের সকল ক্ষেত্রে এ শক্তি প্রয়োগ করতে পারলেই তাদের মঙ্গল অনিবার্য।

সূর্য ডুবতেই চারদিকে অন্ধকার নামে। অন্ধকার কাটিয়ে দেয় জোৎস্নার আলো। বেড়ে যায় ঢোল-মাদলের বাদ্য। আদিবাসিরাও বিভোর হয় বাঁধভাঙ্গা আনন্দে। তাদের আনন্দ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে বহু দূরে।
 


বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।