ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শুভবিবাহ | অমিতাভ পাল

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
শুভবিবাহ | অমিতাভ পাল

মিউনিটি সেন্টার আলো করে বিয়ে হচ্ছে। উঠানে বরযাত্রীদের উচ্চকণ্ঠের তুমুল আড্ডা, সাজপোশাক নিয়ে মহিলাদের কথাবার্তা, প্রসঙ্গের মধ্যে হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ঢুকে পড়া শব্দের মতো শিশুরা এবং রান্নার গন্ধের আসা যাওয়া-সব অপেক্ষা করছে আনুষ্ঠানিকতার চরম অধ্যায়টির জন্য।

আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা শুরু হবে।

এমন সময় পাত্রের বাবার হঠাৎ মনে হলো পাত্রীপক্ষকে একটা কথা জানানো হয়নি। তুচ্ছ এই কথাটা না জানালে বিয়েটা সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না—এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি হাজির হলেন মেয়ের বাবার কাছে এবং তাকে টেনে নিয়ে এলেন কমিউনিটি সেন্টারের অপেক্ষাকৃত নির্জন একটা কোণায়। জানালেন তার ছেলে অনেক তরুণ বয়সে একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল। ব্যাপারটা তিনি যেহেতু পছন্দ করেননি তাই ছেলেকে ধরে নিয়ে এসে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন দেশে এবং ঘটনাটা ভুলে গিয়েছিলেন। পনের বছর বিদেশে থেকে ছেলেও যে সেটা ভুলে গেছে তার প্রমাণ হিসাবে তিনি হাজির করলেন তার পছন্দের মেয়েকে ছবি পর্যন্ত না দেখে বিয়ে করতে ছেলের রাজি হওয়াটাকে এবং মেয়ের বাবাকেও বললেন সহজ ও স্বাভাবিক এই বিষয়টা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা না করতে।



ছেলেমেয়ের এই অতীত ইতিহাস প্রকাশ করে দিয়ে দুই বাবা মানসিকভাবে চরম নির্ভার হয়ে গেলেন এবং পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাসলেন প্রাণখোলা হাসি। দূর থেকে তাদের হাসতে দেখে এতক্ষণ উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকা বরযাত্রী, কন্যাপক্ষ, মহিলা, শিশু ও রান্নার গন্ধ—সবাই আরো উদ্দাম হয়ে উঠল এবং সকলেই রওনা হলো আনুষ্ঠানিকতার চরম কাজটি শেষ করবার জন্য



ছেলের বাবার কথা শেষ হতেই মেয়ের বাবা জানালেন এই ছোট্ট ঘটনাটা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে কেননা তার মেয়েরও আছে ঠিক এইরকমই একটা ইতিহাস। সেও পালিয়েছিল তার পনের বছর বয়সে তারুণ্যের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিয়ে এবং তিনি ব্যাপারটাকে মেনে না নেয়ায় মেয়ে ফিরে আসে ঘরে। তারপর তিনি মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, করে তুলেছেন প্রাপ্তবয়স্ক চিন্তার অধিকারী এবং মেয়েটাও ছেলেবেলার দুর্ঘটনার মতো ভুলে গেছে ঘটনাটা—এমনকি সেই দুর্ঘটনার দাগ পর্যন্ত মিলিয়ে গেছে তার মনের চামড়া থেকে।

নিজের নিজের ছেলেমেয়ের এই অতীত ইতিহাস প্রকাশ করে দিয়ে দুই বাবা মানসিকভাবে চরম নির্ভার হয়ে গেলেন এবং পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে হাসলেন প্রাণখোলা হাসি। দূর থেকে তাদের হাসতে দেখে এতক্ষণ উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকা বরযাত্রী, কন্যাপক্ষ, মহিলা, শিশু ও রান্নার গন্ধ—সবাই আরো উদ্দাম হয়ে উঠল এবং সকলেই রওনা হলো আনুষ্ঠানিকতার চরম কাজটি শেষ করবার জন্য নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে।

২.
বিয়ে হয়ে গেছে। ঝলমলে কমিউনিটি সেন্টার আলোর সব সাজসজ্জা খুলে ফেলে আবার হয়ে গেছে সাধারণ। বরযাত্রী ও কন্যাপক্ষের লোকজন যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়ে কাটাচ্ছে মধুর ক্লান্তির রেশ। শিশুরা ঘুমিয়ে পড়েছে সমস্ত দাপাদাপিকে আগামীকালের জন্য তুলে রেখে। আর রান্নার গন্ধ স্মৃতির মতো ঘোরাঘুরি করছে হঠাৎ উদ্গত কোনো ঢেকুরের চারপাশে। মেয়ের বাড়িতে চলছে সবকিছু ঠিকঠাক মতো শেষ করার কৃতিত্ব নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া। ছেলের বাড়িতে জামাই বউকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে নির্জন একটা ঘরে তাদের নতুন জীবনের প্রথম মধুর রাতটিকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেয়ার জন্য।

৩.
ছেলেটা বসে আছে মেয়েটার সামনে। মেয়েটার মাথা নিচু। ঘোমটার ভিতরে ঢুকে—আরো খানিকটা অন্তর্ধান করে সেই মাথা না দেখতে পাওয়ার সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে প্রায়। তার উজ্জ্বল নতুন শাড়ি, গয়নার আলোকসজ্জা, শাড়ির নিচ দিয়ে একটুখানি বেরিয়ে থাকা পায়ের অসাধারণ সব আঙুল, প্রসাধনের মাতাল করা সুগন্ধী আর নির্জনতা হঠাৎ ছেলেটার মনে জাগিয়ে তুলল সৌন্দর্যের কাছে যাওয়ার সেই চিরকালীন অনুভূতি—যার টানে মানুষ পেছনে ফেলে আসতে পারে কাটিয়ে আসা জীবনের সবটুকু। অমোঘ সেই টান এবার ছেলেটাকে নিয়ে এলো মেয়েটার খুব কাছে এবং দৃশ্য, গন্ধ, স্বাদ—সবকিছুকে ঘোমটার সাথে দুই হাতে সরিয়ে সে দেখতে চাইলো গুহার ভিতরে রাখা গোপন গুপ্তধনের মতো মেয়েটার মুখ।

ঘোমটা খসে পড়ল। নিচু হয়ে থাকা মেয়েটার মুখ হঠাৎ নগ্ন হয়ে পড়ায় আরেকটু লজ্জাবনত হয়ে ঝুঁকে পড়ল কোলের দিকে। কিন্তু অস্থির হয়ে পড়া ছেলেটা এইসব খেয়াল না করেই দুই হাতে তুলে ধরল মুখটা এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

মুখটা ছেলেটার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটার।



বাংলাদেশ সময়: ১৩০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।