ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বড় আয়োজনে বিশ্বের আট বইমেলা

শামীম রুনা, ফিচার রাইটার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
বড় আয়োজনে বিশ্বের আট বইমেলা

১. ফ্রাংকফুট বুক ফেয়ার (জার্মানি)
জার্মানির ফ্রাংকফুটের—ফ্রাংকফুট ট্রেড ফেয়ার গ্রাউন্ডে প্রতি বছর মধ্য অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। ট্রেড ফেয়ার জাতীয় এই বইমেলাটি প্রকাশক এবং প্রকাশনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় এবং পাঁচদিনের এই মেলার প্রথম তিনদিন নির্ধারিত থাকে শতাধিক দেশ থেকে আগত পাবলিশিং কোম্পানি এবং বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য।

শেষ দুই দিন সাধারণ দর্শকদের জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকে। সাধারণত দুই লাখ ৮৬ হাজার দর্শকের সমাগম ঘটে এই মেলায়।

ফ্রাংকফুট বইমেলা ১৭ শতক থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, মাঝে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯-এ সেন্টপল চার্চে এই বইমেলা পুনরায় আরম্ভ হয়। তারপর থেকে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মেলা। ফ্রাংকফুট বইমেলাকে বিশ্বের প্রধান বইমেলা ধরা হয়, এটি মূলত বই বিক্রির পরিবর্তে বই প্রকাশনা সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং রাইটস, লাইসেনিং ফিস, ডিলস এবং ট্রেডিং-এর কাজ করে থাকে।

২. মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার (রাশিয়া)
১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর মস্কো বইমেলা শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের ৩ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে মস্কো এক্সিভিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার। এই মেলায় রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো অংশ নেয় এবং পাঠকরা বিশেষ মূল্যে বই কিনতে পারে। লেখকদের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতার একটি ভালো সুযোগ পাওয়া যায় এ মেলায়। প্রতিদিনই মেলায় বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে নানা ধরনের ওয়ার্কশপ, গোল টেবিল বৈঠক, লেখকদের নিজস্ব পাঠ, সাক্ষাৎকার এবং বইয়ে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ সংগ্রহের সুযোগ থাকে।

এই মেলায় শিশুদের জন্য ‘লেটস রিডস’ নামে একটি কর্নার নির্ধারিত আছে, যেখানে শিশু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। আধুনিক ডিজিটাল প্রিন্টিং টেকনোলজি বিষয়টি মেলার অপর একাংশে ডিসপ্লে করা হয়। মস্কোর—শরতের এই বইমেলায় দশ হাজার লোক আসে তাদের প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা করবার জন্য। এই মেলায় প্রতি বছর এমন একজন লেখককে সম্মানিত করা হয়—যিনি তাঁর লেখার জন্য শ্রদ্ধেয়।

৩. কায়রো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার (মিশর)
বিশ্বের আরো একটি বড় বইমেলা—কায়রো বইমেলার সূচনা হয় ১৯৬৯ সালে। এটা আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বড় বইমেলা। এই বইমেলা জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে কায়রোর মাদিনাত নাসারের কায়রো ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয় এবং তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলে। পাঁচটির মতো আরবি ভাষা, ইংরেজি এবং আরো নানান ভাষার সাহিত্যের বই এই মেলায় পাওয়া যায়।

কায়রো বইমেলায় আরব পাবলিশিং-এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট থাকে। এই মেলায় একশ’রও বেশি দেশ থেকে আগত বই বিক্রেতা এবং দুই লাখ পাঠকের সমাবেশ হয়। ২০০৬ সালে কায়রো বইমেলা ফ্রাংকফুট বইমেলার পর দ্বিতীয় প্রধান বইমেলার স্বীকৃতি পেয়েছিল।

৪. লন্ডন বুক ফেয়ার (যুক্তরাজ্য)
বিশ্বের আরো একটি প্রধান বইমেলা হলো লন্ডন বুক ফেয়ার। ১৯৭১-এর ৫ নভেম্বর মি. লাইওনেল লেভিনথাল—ছোট প্রকাশকরা যেন তাদের প্রকাশনা লাইব্রেরিয়ানদের দেখাতে পারেন—সেজন্য বার্নাস হোটেলের বেসমেন্টে বই প্রদর্শনের যে উদ্যোগটি নিয়েছিলেন; সে উদ্যোগ বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান বইমেলার মর্যাদা লাভ করেছে। মি. লেভিনথাল তাঁর ছোট বইমেলার জন্য বার্নাস হোটেলের লোকেশনটি ঠিক করেছিলেন কারণ—এটি ছিল লাইব্রেরি এসাসিয়েশনের কাছে এবং মেলার তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছিল লাইব্রেরিয়ানদের মাসিক মিটিংয়ের তারিখ অনুযায়ী। মাসিক ওই মিটিংয়ে লন্ডনের বাইরে থেকেও প্রচুর লাইব্রেরিয়ান আসতেন। প্রথম মেলা সাকসেসফুল হবার পর মি. লেভিনথাল প্রবল উৎসাহ পেয়ে এই মেলা প্রতি বছর করার কথা ভাবলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি পরের বছর ১৯৭২-এর নভেম্বরে হোটেল ব্লুমসবেরিতে ‘স্মল এ—স্পেশালিস্ট পাবলিশার’ নাম দিয়ে দ্বিতীয় মেলার আয়োজন করেন। ১৯৭৭ সালে এই মেলার নাম পাল্টে ‘লন্ডন বুক ফেয়ার’ করা হয়।

বর্তমানে একশ’টিরও বেশি দেশ থেকে ২৫ হাজারেরও বেশি প্রকাশক, বই বিক্রেতা, এজেন্ট, লাইব্রেরিয়ান ও মিডিয়াকর্মী এই মেলায় অংশ নেয়। বই প্রকাশকরা আসেন তাদের আগামী বইয়ের প্রদর্শন এবং অনুবাদ বিষয়ক রাইটের ব্যাপারে অন্য প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনা করতে। ২০০৬ পর্যন্ত এই মেলা অলেম্পিয়া এক্সিভিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হতো তারপর এটি যায় এক্সেল এক্সিভিশন সেন্টারে। ২০০৭-এর পর থেকে ১৪-১৬ এপ্রিল, প্রতি বছর লন্ডন বুক ফেয়ার ‘আর্ল কোর্ট এক্সিভিশন সেন্টারে’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

৫. আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা (ভারত)
পাঠক সমাবেশের দিক থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইমেলার স্থানটি দখল করে আছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। এশিয়ার প্রধান বইমেলা এবং অবাণিজ্যিক দিক থেকেও কলকাতা বইমেলার গুরুত্ব অন্যতম। ফ্রাংকফুট বইমেলার দিক থেকে বিবেচনা করলে কলকাতা বইমেলার স্থান তৃতীয়। আড়াই লাখেরও বেশি পাঠক প্রতি বছর এই বইমেলা পরিদর্শন করতে আসে। আগে ময়দানে অনুষ্ঠিত হলেও ২০০৯-এর পর থেকে সায়েন্স সিটির পাশে মিলন মেলায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই বইমেলা। এটি মূলত শীতকালীন মেলা। কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের জন্যও একটি আলাদা প্যাভিলিয়ন থাকে। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে কলকাতার নন্দন চত্বরে ‘বাংলাদেশ বইমেলা’ নামে আরো একটি বইমেলার আয়োজন হয়ে আসছে।

কলকাতা বইমেলার সাফল্য এসেছে মূলত পশ্চিমবঙ্গের ছোট ছোট বইমেলার সাফল্যকে কেন্দ্র করে, যেমন শিলিগুড়ি বইমেলা, আসাম বইমেলা ইত্যাদি। কলকাতা বইমেলার জনপ্রিয়তা এতটাই যে ২০০৬ সালে ফ্রাংকফুট বইমেলায় এটি গেস্ট অফ অনারের মনোনয়ন পায়। আশি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত কলকাতায় বছরে দুটি বইমেলা হতো, একটির উদ্যোক্তা ছিল প্রকাশনী এবং বই বিক্রেতা সমিতি, অন্যটি হতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে—যার নাম ছিল ‘গ্রন্থমেলা’। এছাড়াও সারা বছর জুড়ে কলকাতায় বিভিন্ন ইনডোর ভেন্যুতে নানা নামে ছোট ছোট বইমেলার আয়োজন করা হয়।

৬. বলগ্না চিল্ড্রেনস বুক ফেয়ার (ইতালি)
শিশু সাহিত্যের জন্য ‘বলগ্না চিল্ড্রেনস বুক ফেয়ার’ একটি প্রধান বইমেলা। ১৯৬৩ সাল থেকে প্রতি বছর মার্চ এবং এপ্রিলের চারদিন এই মেলা ইতালির বলগ্নায় অনুষ্ঠিত হয়। শিশু সাহিত্য, শিশু চলচ্চিত্র এবং এনিমেশন নিয়ে যারা কাজ করেন—তারাই মূলত এখানে শিশু সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসেন।

এছাড়া এই মেলায় শিশু সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও এনিমেশন ইত্যাদিতে কৃতিত্ব রাখার জন্য মোট চারটি ক্যটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়।

৭. বুয়েন্স এরিস ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার (আর্জেন্টিনা)
বিশ্বের পাঁচটি প্রধান বইমেলার একটি হলো বুয়েন্স এরিস ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার। এই মেলা ১৯৭৫ সাল থেকে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এরিস শহরে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এবং বইমেলাটি মূলত স্পেনিশ সাহিত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ও জমে উঠেছে।

এক লাখ ২০ হাজারের মতো দর্শনার্থীর সঙ্গে আর্জেন্টিনার লেখকরা যেমন নিয়মিত মেলায় আসেন, তেমনি আসেন প্রচুর বিদেশি লেখকও।

৮. অমর একুশে গ্রন্থমেলা (বাংলাদেশ)
একুশে বইমেলা হিসেবে বেশি পরিচিত এই মেলার আরেক নাম প্রাণের মেলা। প্রতি বছর বাংলা একাডেমি এই মেলার আয়োজন করে। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলা এই বইমেলা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়ে এলেও ২০১৪ সাল থেকে মেলার পরিধি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত ব্যাপ্ত করা হয়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে সেসব শহীদদের প্রতি—যাঁরা ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মতো শহীদদের উদ্দেশ্য করে বইমেলার আয়োজন বিশ্ব বইমেলার ইতিহাসে বিরল।

মুক্তধারা প্রকাশনীর কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা—১৯৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে বাংলা একাডেমির সামনে ছোট আকারে বই বিক্রির আয়োজনের মাধ্যমে আজকের এই অমর একুশে গ্রন্থমেলার গোড়াপত্তন করেন। তিনি অন্যান্য প্রকাশকদেরও এই মেলায় অংশগ্রহণ করতে বলেন, পরবর্তীকালে এই মেলা বাংলা একাডেমির অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক মেলায় পরিণত হয়। মেলা চলাকালীন সারা মাস নজরুল মঞ্চে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি। এই মেলার প্রবেশ মূল্য নেই, মেলা প্রাঙ্গণ ধূমপানমুক্ত। প্রচুর সংখ্যক ক্রেতা-দর্শনার্থী মেলায় আসে, বই দেখে, কেনে এবং লেখককুঞ্জে তাঁদের প্রিয় লেখক-কবিদের সঙ্গে মত বিনিময় করে। মেলায় বই বিক্রি হয় কমিশনের মাধ্যমে। এছাড়া বাংলা একাডেমি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গুণীজনদের বিশেষ সম্মাননা দিয়ে থাকে।

এছাড়া জাপান, চীন, ম্যাক্সিকো, জিম্বাবুয়ে ও সাউথ আফ্রিকাসহ আরো নানা দেশে বড় বইমেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিটি দেশের বইমেলা সে দেশের ও জাতির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।



বাংলাদেশ সময়: ১৯২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।