মূল: অগাস্ট কুবিজেক
অনুবাদ: আদনান সৈয়দ
[লেখক অগাস্ট কুবিজেক ছিলেন কুখ্যাত নাজি বাহিনীর জনক অ্যাডলফ হিটলারের ছেলেবেলার বন্ধু। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ’ থেকে জানা যায়, হিটলার তার প্রথম যৌবনে গান গাইতেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন, ছিলেন একজন প্রেমিক ও ছবি আঁকায় তার ছিলো আজন্ম ঝোঁক।
তৃতীয় অধ্যায়
পর্ব ৬
একজন যুবক হিটলারের প্রতিকৃতি
হিটলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকাকালীন তার কোনো ছবি আমার সংগ্রহে নেই। সম্ভবত সেই সময়ে তার কোনো ছবিই হয়তো ছিলো না। সেসময় আমাদের এই ছবির অনুপস্থিতি সত্যি খুব বেখাপ্পা দেখায়। বলতে গেলে সেই যুগে সবসময় নিজের সঙ্গে খুব আরাম করে বহন করার মতো এমন কোনো ক্যামেরা ছিলো না। অবশ্য এমন ক্যামেরা বাস্তবে যদি পাওয়াও যেতো তাহলেও তা আমাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরেই থেকে যেতো। ধরুন, আপনি যদি একটি ছবি ওঠাতে চাইতেন, আপনাকে অবশ্যই কোনো স্টুডিওতে যেতে হতো। এটিও ছিলো অনেক ব্যয়বহুল একটি বিষয়। আমার যতোটুকু মনে পড়ে আমার বন্ধু কখনই ছবি তোলার বিষয়ে আগ্রহী ছিলো না। সে তার নিজের যোগ্যতা নিয়ে কখনও অহংকারী ছিলো না অন্তত স্টেফেনির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত। আমার ধারণা, অ্যাডলফ হিটলার তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলিতে পাঁচটির বেশি ছবি হয়তো তোলেনি।
অ্যাডলফের সবচেয়ে অল্প বয়সের ছবিটি সম্ভবত তোলা হয়েছিলো ১৮৮৯ সালে যখন তার বয়স কয়েক মাস হবে। ছবিটিতে তার নাক, গাল, মুখ, উৎসাহদীপ্ত চোখ, আলো সব মিলিয়ে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ঠের একটা ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করার মতো। ছবিটিতে হিটলারকে তার মায়ের সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়টা আমি প্রথম বুঝতে পারি যখন আমার সঙ্গে ফ্রাও হিটলারের দেখা হয়। অন্যদিকে, তার বোন পাওলা দেখতে ছিলো তার বাবার মতো। আমি হিটলারের বাবাকে কখনও দেখিনি আর সে কারণে এই বিষয়ে ফ্রাও হিটলারের কথার উপর ভিত্তি করেই আমাকে কথাটা বলতে হচ্ছে।
হিটলারের স্কুলজীবনে সহপাঠীদের সঙ্গে তার একটি ছবি আমি দেখেছি। তবে তার একান্ত নিজস্ব কোনো ছবি সেখানে ছিলো না। পরবর্তীতে তার আরও কিছু ছবি আমি দেখেছি, যেখানে তাকে দেখতে মোটামুটি একইরকম দেখা গেছে। আমার ধারণা, ছবি তোলার সময় হয়তো তার এমন কোনো বিষয় মাথায় কাজ করবে যে, সে সবসময় তরুণ হয়ে থাকতে চাইতো। স্টেয়ারে স্কুল জীবনে থাকাকালীন তার বয়স যখন ষোল, সেই সময়ে তার ব্যক্তিগত ছবি আঁকার খাতা থেকে একটি নিজের স্কেচ খুঁজে পাওয়া যায়। শিল্পী স্ট্রামলেচনার স্কেচটির নাম দিয়েছিলেন, ‘Nach Der Natur’ অর্থাৎ ‘সত্য জীবনের প্রতি’। সন্দেহ নেই, সেই সময়ে সে ছিলো একজন শখের আঁকিয়ে কিন্তু আমি খুব জোর দিয়েই বলবো, তার কাজের মাপ ছিলো অনেক উঁচুতে।
হিটলার উচ্চতায় ছিলো মাঝারি গড়ন আর হালকা পাতলাগোছের। তখন সে উচ্চতায় তার মাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। তার শারীরিক গঠন ছিলো দুর্বল ও মোটেও শক্তিশালী ছিলো না। অবশ্য তার এই শারীরিক দুর্বলতার কথা সে কখনও স্বীকার করতো না। শীতকালে লিজ শহর যখন কুয়াশা আর শীতে ঢেকে যেতো, তখন শরীরের দেখভালের জন্যে তাকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হতো। সেই সময়টায় সে সবসময়ই অসুস্থ থাকতো। ঠাণ্ডায় তার বুকে সবসময় কফ জমে থাকতো। মোট কথা তার ফুসফুস খুব দুর্বল ছিলো।
তার নাক খাড়া ছিলো এবং দেখতে ভালোই ছিলো। তবে আহামরি দেখার মতো কিছু ছিলো না। কপাল ছিলো অনেক প্রশস্ত। আমি সবসময় এটা দেখে দুঃখ পেতাম যে, সেই সময়েও সে তার চুল সোজা করে ভ্রু বরাবার আঁচড়াতো। তার কপাল, নাক ও মুখ- সবমিলিয়ে তার গোটা চেহারাটাই যেনো একটু বেখাপ্পাগোছের ছিলো। বিশেষ করে তার চোখ যেনো গোটা মুখায়বকে শাসন করতো। আমার জীবনে আমি এমন আর কাউকে দেখিনি, যার চোখ তার গোটা ব্যক্তিত্বকে চালনা করতে পারে। তার মায়ের চোখ ছিলো অনেক পাতলা কিন্তু সেই চোখে ছিলো তার ছেলের মতোই বিপুল পরিমাণ তেজ। সত্যি বলতে, হিটলার মুখে কোনো শব্দ না ফুটিয়েই অনর্গল শুধু চোখ দিয়েই কথা বলতে পারতো এবং সে কী বলতে চাইছে, আমরা ঠিক বুঝতে পেতাম।
আমাদের বাড়িতে প্রথমবার সে যখন আসে আমি তাকে আমার মায়ের সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মা আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার বন্ধুর কী অসাধারণ চোখই না আছে!’। তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে, তার কথায় প্রশংসার চেয়ে ভীতির পরিমাণটাই বেশি ছিলো। আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, তরুণ বয়সের কোন বিষয়টি তুমি ধারণ করতে চাও, তাহলে আমি শুধু বলবো, তার (হিটলার) চোখের মতো একজোড়া চোখ চাই।
স্বাভাবিকভাবেই অসাধারণ বাচনক্ষমতা ছিলো তার বিশেষ এক আকর্ষণীয় শক্তি। কিন্তু বিষয়টির সঙ্গে ভবিষ্যত যোগসূত্র তৈরি করতে সেসময় আমি খুব একটা বিচক্ষণ ছিলাম না। আমি নিশ্চিত ছিলাম, হিটলার একসময় অনেক বড় একজন শিল্পী হবে অথবা বড় কোনো কবি হবে। পরে ভেবেছিলাম, সে হয়তো বড় একজন চিত্রশিল্পী হবে। পরবর্তীতে ভিয়েনায় হিটলার আমাকে জানিয়েছিলো, সে তার সত্যিকারের দক্ষতা খুঁজে পায় স্থাপত্য শিল্পে। কিন্তু দুঃখ রইলো এই যে, তার এতো এতো শৈল্পিক গুণবলীর একটিও সে তার জীবনে কাজে লাগালো না। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমি সবসময় তার কথা শুনতে ভালোবাসতাম। তার ভাষা ছিলো খুব স্বচ্ছ ও মধুর। সে আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণে কথা বলতে খুব একটা পছন্দ করতো না, বিশেষ করে ভিয়েনার নিজস্ব যে সুরেলা উচ্চারণ রয়েছে, সে ভাষা তার মোটেও পছন্দের ছিলো না। এটা সত্য যে, হিটলার অস্ট্রিয়ান-জার্মান ভাষায় কখনই কোনো শব্দ উচ্চারণ করতো না। তার কথা ও বক্তৃতায় বেভেরিয়ান ভাষার আধিপত্য ছিলো প্রচুর। সম্ভবত এটা এ কারণেই হয়ে থাকবে, হিটলার তার জীবনের তিন থেকে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত তার শুল্ক কর্মকর্তা বাবার সঙ্গে পাসাওতে বড় হয়েছিলো।
এ কথা বলতেই হবে, আমার বন্ধু তার ছেলেবেলা থেকেই কথা বলায় বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলো। এবং সে তা জানতোও। সে কথা বলতে ভালোবসাতো ও কথা বলতো বিরামহীনভাবে। সে যখন কথা বলতে বলতে আকাশ কুসুম ভাবনার জগতে চলে যেতো, তখন আমি ভাবতাম- এটা তার কথা বলার দক্ষতারই একটি ফল। তারপরও আমি ভাবি। খ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষা নিয়ে সে যখন বড় বড় বক্তৃতা দিতো, সেই জ্ঞান কি আমি তার কাছ থেকে অর্জন করিনি? কখনও কখনও হিটলার তার বাগ্মীতার দক্ষতা আমার ও অন্যদের উপর খাটানোর চেষ্টা করতো। এটা সবসময় আমি বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবি যে, তার তখনও আঠারো বছর হয়নি অথচ সে কীভাবে আমার বাবাকে রাজী করালো, আমাকে আর ওয়ার্কশপে কাজ না করিয়ে ভিয়েনায় সঙ্গীত শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হোক! একজন পিছিয়ে পড়া ও অল্পশিক্ষিত বাবাকে বশে আনা ছিলো আমার জন্য এক বিশাল অর্জন। যখন থেকে আমি তার এই বাচন ক্ষমতার ফল হাতে পেলাম, তখন থেকেই আমি বিশ্বাস করতাম যে- এমন হেন কঠিন কোনো কাজ নেই যা হিটলার তার কথার মাধ্যমে অর্জন করতে পারবে না!
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
এসএনএস
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-২)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৩)
**দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৪)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৫)