ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

পাভেলের ফ্রেমবন্দি চিরমুক্ত সব মুহূর্তের পাঠশালা

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৬
পাভেলের ফ্রেমবন্দি চিরমুক্ত সব মুহূর্তের পাঠশালা

ঢাকা: ১৯৮৫ সালে বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। ঝড়ে কে কোথায় উড়ে গেছে ঠিক নেই।

অনেকের মতো উড়িরচরের নূর হোসেন হারিয়েছেন তার স্ত্রীকে। কে জানে বেঁচে রয়েছে কি নেই বা থাকলেও কোথায় আছে জানা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ত্রাণ নিতে গিয়ে স্ত্রী খুঁজে পেলেন স্বামীকে বা স্বামী স্ত্রীকে। এই মহাআনন্দ, মহামিলন কি ফ্রেমবন্দি থাকে?

কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সব উত্তাল মুহূর্ত। ইতিহাস দেখেছে, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লাইনটি কীভাবে চারকোনা ফ্রেম থেকে বেরিয়ে একটি গোটা জাতির বক্তব্য হয়ে ওঠে!
রাজপথ থেকে উড়ির চর। বঙ্গবন্ধু থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা। গণভবন থেকে হোয়াইট হাউজ। এভাবে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরুর পর ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল আবারও ঠিক এখানেই ফিরে আসেন আলোকচিত্রী পাভেল রহমান। মাঝখানে কতো আলো, কতো ছায়া পেরিয়ে তিনি বছর ষাটে এসে উপস্থিত হন। একইসঙ্গে উপস্থিত হয় বিভিন্ন সময়ে ফ্রেমবন্দি অথচ চির মুক্ত সব মুহূর্ত।
এদিন তার জন্মদিন উপলক্ষে টিএসসিতে ‘আলোকচিত্র প্রদর্শনী’র আয়োজন করে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি। প্রদর্শনীতে তার তোলা ৬০টি ছবি স্থান পায়। ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন সময় ব্যবহার করা ক্যামেরা ও প্রেস পাসগুলো। আর এভাবেই উড়িরচরের নূর হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় গণতন্ত্রকামী নূর হোসেনের।      

তার ছবি নিয়ে প্রদর্শনী আগেও হয়েছে, কিন্তু দেশ-সমাজ-রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবারের আয়োজনটি যেনো আরও বেশি অর্থবহ হয়ে উঠেছে। তাইতো ইতিহাস ভুলতে থাকা জাতির কাছে আবার ফিরে আসেন গেঞ্জি লুঙ্গি পরা পাইপ হাতে অতি সাধারণ বেশে অসাধারণ বঙ্গবন্ধু। কিংবা রাজনৈতিক সহনশীলতার সর্বোচ্চ চর্চা হিসেবে দেশের ‍দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পাশাপাশি বসা মুহূর্ত।
ফিরে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, ফিরে আসে তার রেখে যাওয়া স্বপ্ন, শাহবাগে জনতার গণজাগরণে।
তার ক্যামেরার চোখ চট্টগ্রামে পাহাড় ধস থেকে চলে যায় রাজীব গান্ধীর শবযাত্রায়। ধরা পড়ে পিতার মৃত্যুর পর শোকার্ত সন্তান প্রিয়াঙ্কার উদাস দৃষ্টি।
কিংবা তার ফ্রেমে বন্দি হবেন বলেই হয়তো নিয়তি তৎকালীন পোপ, বেনজির ভুট্টো ও মুনমুন সেনকে এ দেশের মাটিতে নিয়ে আসে।
কোরবানির এক টুকরো মাংসের জন্য অভাবী হাতগুলো যেনো আর ছবিতে আটকে থাকতে চায় না, সোজা বিবেক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিংবা থরে থরে সাজানো লাশের পা কি শুধুই ছবি?
যার উত্তর গত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খুঁজে চলেছেন পাভেল রহমান, সেটিই যেনো এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে আবার জীবন্ত, সবল আর উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে। ২৬ এপ্রিল দিনব্যাপী চলা এ প্রদর্শনী চলবে ২৭ এপ্রিলও।
নিজের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ণ কমিটির বিশেষ ব্রুশিয়রে তিনি লিখেছেন, ‘৩০ বছরের যুবক আমি ‘ষাট বছরে’ নিজের চেহারা কল্পনায় এনে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। কল্পনায় মাথা ভর্তি টাক, ফোকলা দাঁত, কানে কম শোনা, চোখে ঝাপসা দেখা এক বুড়ো আমি। কিন্তু আজ ত্রিশ বছর পর বাস্তবে নিজে যখন ষাটে, তখন দেখি উল্টোটা। আমি দিব্যি আছি শক্ত, দাঁতগুলি এখনো পোক্ত, দৃষ্টি আমার অবিচল যুবকের মতই সুস্থ সবল উচ্ছ্বল’।  

দায়িত্ব নিয়ে বলা যায়, ঠিক তার মতোই তার আলোকচিত্রগুলো আরও ৬০ বছর পরেও একইরকম শক্ত-পোক্ত-অবিচল হয়ে হাজির হবে।

পাভেল রহমানের জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৬ এপ্রিল রংপুর জেলায়। যশোর জিলা স্কুলে পড়ার সময়েই হাতে তুলে নেন ক্যামেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের আগেই কৃতিত্বের সঙ্গে জাতীয় সংবাদপত্রের আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন তিনি। পেশাগত জীবনে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রপত্রিকার পাশাপাশি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি), ফটো এজেন্সি গামা, এশিয়া উইক, কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান ও আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে সুনাম কুড়ান তিনি। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তার আলোকচিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে। বিশ্বমানের অনেক পুরস্কার ঝুলিতে পুরেছেন খ্যাতিমান এ আলোকচিত্রী।
তার কর্মজীবনের পরিধি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘ এতোটা বছর বাংলাদেশকে তার চোখ দিয়েই দেখেছে বিশ্ব। এজন্য দায়িত্বও ছিলো আর দশজনের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। তাইতো বহুবার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেও পিছপা হননি। তার এমন বিপদসঙ্কুল পথচলা ছিলোই উড়িরচরের মহামিলন বা গণতন্ত্রকামী নূর হোসেনের পিঠের মতো অসংখ্য ছবির থেকে বেশিকিছুর জন্য।

৬০তম জন্মদিনে এ আলোকচিত্রীর জন্য কামনা, তার ছবি বেঁচে থাকুক কিংবা ছবির জন্য তিনি বেঁচে থাকুন দীর্ঘদীন।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৬
এসএনএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।