ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ভ্রমণামৃত-১০

ফ্লোরেন্স: গর্জনমুখর প্রশান্ত সৈকত | মাহমুদ হাফিজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৭ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৬
ফ্লোরেন্স: গর্জনমুখর প্রশান্ত সৈকত | মাহমুদ হাফিজ

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় সাদারঙের শেভরোলে যখন ছুটতে শুরু করলো, শক্ত করে সিটবেল্ট বেঁধে আমরা আল্লাহ আল্লাহ জিকির করছি। দু’দিকেই আকাশমুখী পাহাড়।

ঢালে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ঘনজঙ্গল। নিচে আগাছায় ঘেরা গিরিখাদ দিয়ে কোনো কোনো জায়গায় কলকল বয়ে যাচ্ছে অনাবিষ্কৃত ঝরনাধারা। গাড়ির গতি থেকে থেকে একশো কিলোমিটার ছাড়াচ্ছে। স্টেয়ারিংয়ে পল্লব মাহমুদ। পেছনে আমি, জলি ফেরদৌসী, মামণি শায়লা জেরীন, তুসু মাহমুদ। দক্ষ চালক হলেও  আমেরিকান বামহাতি ড্রাইভে পল্লব খুব বেশি পাকা নয়। পকেটে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট আছে আমার। যার নামে ইন্স্যুরেন্স আছে, সেই কেবল গাড়ি চালাতে পারে। মসৃণ রাস্তা আর চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবেগ-আতিশয্যে হাত নিশপিশ করলেও উপায় নেই। আমরা ছুটছি ফ্লোরেন্স। আপাত গন্তব্য ফ্লোরেন্সের প্রশান্তপার, গর্জনমুখর ‘হাশিটা’ সমুদ্রসৈকত।  


যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের চোখ জুড়িয়ে মনে প্রশান্তি এনে দেয়, অরেগনের ইউজিন-ফ্লোরেন্স ১২৬ নম্বর হাইওয়ের সৌন্দর্য তার চেয়ে একটু বেশি। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে রাস্তা। পাহাড় ছেড়ে কখনও সোজা রাস্তা মাইলের পর মাইল। মাঝে স্ফটিকস্বচ্ছ জলধারা, হ্রদ, নদনদী বয়ে চলেছে পাহাড়ি বুনোপথে। পথের মধ্যে সবুজ পাহাড়ঘেরা নীল পানির লেক ছুটন্ত পর্যটককে হাতছানি দিয়ে ডাকে।  
আমাদের গুগল জিপিএস বলছে, ইউজিন শহর ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে ১২৬ নম্বর মহাসড়ক ধরে পাহাড়ি রাস্তায় ৮৮ কিলোমিটার যেতে হবে। তারপর অন্য রাস্তা। আমরা এ রাস্তায় ছুটে চলার কিছুক্ষণের মধ্যে সুউচ্চ পাহাড় নজরে আসতেই প্রশান্তি নেমে এলো। দলের কিশোর সদস্য তুসু ‘ওয়াও’ বলে আনন্দধ্বণি করে উঠলো। গাড়ির ভেতরে নাইকন সেভেন থাউজ্যান্ড ক্যামেরাসহ সবার মোবাইল ক্যামেরা সচল হলো। কিছুদূর পর ডানে বিশাল আকারের পাহাড়ি হ্রদ। নাম ফার্ণ রিজ লেক। নাগরিক কোলাহল ছেড়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যে পুলকিত হয়ে গাড়ি থামিয়ে নামতে যাচ্ছিলো সবাই। সামনে ক্রমশ একটার পর একটা সৌন্দর্যের আঁধার থাকায় এগিয়ে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করা হলো। আমরা এগিয়েই যেতে থাকলাম।  


লেক ছাড়িয়ে গেলে ডানে বা উত্তরে এলিমরা আর বামে ভেনেতা নামে দু’টি ছোট্ট পাহাড়ি শহর। সেসব দর্শনীয় হলেও একজীবনে যেমন সবকিছু হয় না, তেমনি এ যাত্রায় আমরা গন্তব্যের দিকেই ছুটতে লাগলাম। নটি ও ওয়াল্টন এলাকা ছেড়ে আমাদের গাড়ি গভীর বনপাহাড়ের সঙ্কুল রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলো। এ সড়কে আটশো ফুট উচ্চতার গাড়ি উঠে গেলে কান বন্ধ হয়ে যায়। কোগরা পাসের পর রাস্তার দু’পাশে পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ে দুর্লঙ্ঘ হওয়ায় মানুষ বানিয়েছে পাহাড়ের নিচ দিয়ে টানেল। এ রাস্তার টানেলের নাম পিটারসন। এ টানেল ইউজিন-ফ্লোরেন্সের সোয়া ঘণ্টার দূরত্বের বাধা তুলে নিয়েছে সেই ১৯৫৭ সাল থেকে।  
আমরা ম্যাপলেটনের কাছে সেতু পার হলাম। সেতুর পর রাস্তা বামদিকে মোড় নিয়ে একটি পাহাড়ি নদীর সঙ্গী হলো। পাহাড়ি নদী আমাদের সঙ্গী হলো বহদূর। পাহাড়ে জন্ম নিয়ে এ নদী পাহাড় ও জনপদের পর জনপদ পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে হার মেনেছে। ফ্লোরেন্স শহরের দক্ষিণ দিয়ে প্রশান্তে বিলীন হওয়া নদীটির নাম ‘সাইউসলা’। ইংরজিতে নদীটির নাম দেখে উচ্চারণ করা খুব কষ্ট হচ্ছিলো। পরে স্থানীয়দের কাছ থেকে নদীটির উচ্চারণ শোনার পর আমার কাছে তা খুব পরিচিত শব্দ মনে হলো। আমাদের পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা লাহাবে এই শব্দটি আছে বলে তা উচ্চারণ ও মনে রাখতে খুব কষ্ট হয় না। এই রাস্তায় কুজ বে রেল লিংক এর রেলপথ মাঝে মাঝে নজরে আসে। ক্যাসারম্যানের কাছে নদীটির ওপর রেললিঙ্কের সেতুটির পাশ দিয়ে এর রাস্তা এগিয়ে অরেগন উপকূলের ওয়ানওওয়ান বা ১০১ ‘প্যাসিফিক কোস্ট সিনিক বাইওয়ে’র সঙ্গে মিলিত হয়। এটিই প্রশান্ত মহাসাগরপ্রান্তিক শহর ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্স শহরের ভিতর দিয়ে উত্তর দক্ষিণমুখী ১০১ বাইওয়ে দিয়ে বাম বা দক্ষিণ দিকে গেলে চোখ আটকে যায় সাইউসলা সেতুর ওপর। আমাদের হাতিরঝিল, গুলশান-বনানী লেক সেতুর যে স্থাপত্য, তার অনুপুঙ্খ আদলে গড়া এই সেতু। চকিতে ভুল হয় এটা কী যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরেন্স না প্রিয় রাজধানী ঢাকা! 
আজকের আরাধ্য নগর কোলহল নয়, মহাসাগরপার, পাহাড় ঘনবনের ঝাউছায়া। আমরা বাইওয়ে ধরে ফ্লোরেন্স সেতু পেছনে ফেলে চলতে শুরু করলাম। ওয়েস্টকোস্টে আমাদের সামনের রাস্তা শিয়াটল ও কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের দিকে গেছে, পেছনের দিক সানফ্রান্সিসকো ও লসএঞ্জেলেস। উপকূল ঘেঁষে নির্মিত দৃশ্যময় সিনিক বাইওয়ে ধরে চলতে গিয়ে পুরো প্রশান্তপারের স্বাদ পাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘হাশিটা বিচ ড্রিফউড রিসোর্ট’-এ পৌঁছালাম। গাড়ি রেখে নিচের বালুময় সমুদ্র সৈকতে নেমে কিছুক্ষণ কাটানোর পরিকল্পনা করা হলো।  


রিসোর্টের পেছনে প্রশান্ত মহাসাগর। সেখানে দাঁড়াতেই প্রশান্তপারের ঝাপটা বাতাস মুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেলো। দূরে নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্রগর্জন কানে এলো। সমুদ্রপারে পৌঁছে গর্জনের সঙ্গে চোখ আটকে গেলো সফেদ ফেণাময় সামুদ্রিক ঢেউয়ে। ফ্লোরেন্সের হাশিটা সৈকতের টানা গর্জন আর উপকূলে ধাবমান নিরবচ্ছিন্ন ঢেউ আমাদের মনে জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে অপার্থিব আনন্দ শিহরণ। কূলে আছড়ে পড়া ঢেউ-গর্জনে ফ্লোরেন্স যতোই ফুঁসুক, প্রশান্তের বিশালতাকে দিনমান সঙ্গী করতে আজ এ শহরের সৈকতটি ছেড়ে যাচ্ছি না। সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে বরং হা হয়ে গেলাম।  
সমুদ্রের বিশালতা  ও শক্তির কাছে মানুষকে তুচ্ছ বলে মনে হয়। দলের সবাই জগতবিভ্রান্ত। স্থানকালপাত্র ভুলে কুলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠলো। আমি দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মনে এঁকে যাচ্ছিলাম একটা বিশ্ব মানচিত্র। সে মানচিত্রে স্পষ্ট দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি…ঠিক সোজা সমুদ্রের ওপারে রয়েছেন আমার মা, আমার গ্রাম আর আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৬
এসএনএস 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।