আলতামিরা। প্রাচীন গুহাচিত্র হিসেবে অনেকেই আমরা এই নামটির সঙ্গে পরিচিত।
আসুন আলতামিরার ইতিহাস ধরে ভীমবেটকার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
তখন সময়টা বরফ যুগের শেষপর্যায়ে। বিজ্ঞানীরা যাকে পলিওলিথিক বা প্রাচীন প্রস্তরযুগ বলে সম্বোধন করছেন। তখনও ভাষা পায়নি শব্দের সুনির্দিষ্ট মাধ্যম। বিবিধ ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করতো মানুষ। মুখে বর্ণময় ভাষা নেই, তাতে কী, হাতে প্রকাশিত হচ্ছে চিত্রের ভাষা। প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত হলো রঙ, গাছের ডালের তুলি, আর পাহাড়ের ছাঁদ ও দেয়াল হলো ক্যানভাস। মানুষের ইতিহাসে সুচনা হলো শিল্পকলার।
প্রাগৈতিহাসিক সেইসব শিল্পীদের নাম কারও জানা নেই, তবে ধারণা করা হয় নিয়ান্ডারথাল মানবেরা এর চিত্রকর এবং তাদের আঁকা বাইসন এখনও অমলিন অবস্থায় রয়েছে; ঘটনাক্রমে ১৮৬৮ সালে মডেস্টো কুলিবাস নামে এক শিকারী ও ১৮৭৯ সালে মারসেরিনো সানজ ডি সাউটুওয়ালা নামে এক শৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ স্পেন-ফ্রান্স সীমান্তে আলতামিরা গুহার (Santillana del Marএর কাছে) দেয়ালে এই গুহাচিত্রের সন্ধান পান। আর এর সম্বন্ধে প্রথম কোনো প্রকাশনা হয় ১৮৮০ সালে । আলতামিরার গুহাচিত্রের বয়স ১৪ হাজার বছরেরও বেশি হবে। পৃথিবীতে তখন চলছে সর্বশেষ বরফ যুগ। কিন্তু বেশকিছুটা সময় লেগেছে বিশ্বাস করতে এটি আসলেই কি পলিওলিথিক শিল্পকলার একটি নিদর্শন? বিশেষজ্ঞরা প্রথমেই এটি বাতিল করে দিয়েছিলেন- আধুনিক কোনো শিল্পীর আঁকা কোনো নকল প্রতারণা হিসাবে। আর তাদের যুক্তিও ছিলো, এই রঙ কেন এতো উজ্জ্বল এবং এর কৌশল আসলেই অনেক অভিজাত ও অগ্রসর, যদি এর সৃষ্টিকালের কথা মনে রাখা হয় তাহলে কোনো সন্দেহ নেই এই প্রশ্নবোধক বিস্ময়টি ছিলো খুবই স্বাভাবিক। পুরো বাইসনটিকে কালো কালি দিয়ে আউটলাইন করা হয়েছে প্রথমে, তারপর এটিকে রঙ করা হয়েছে, শেডিং সৃষ্টি করা হয়েছে, কিছু কিছু জায়গায় রঙ চেছে সরিয়ে ফেলে, নতুন করে রঙের উপর দাগ এনগ্রেভ করা হয়েছে গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলোকে হাইলাইট করার জন্য যেমন- চোখ, শিঙ এবং পায়ের খুর;
এই গুহাচিত্রের বিষয়বস্তু খুবই কৌতুহলোদ্দীপক। ছবির বিষয় হিসেবে পারিপার্শ্বিক নৈসর্গিক চিত্র, পাখি, পোকা-মাকড় প্রায় অনুপস্থিত; মানুষের ছবি আঁকা হয়েছে খুব কম, আর তাও প্রতীকীকিন্তু তাদের প্রধান শিকার বাইসনসহ আরও প্রাণীর অসংখ্য ছবি আঁকা হয়েছে আবার গুহাচিত্রে হিংস্র মাংসাশী প্রাণীদের ছবিও খুবই বিরল। এর কারণ সম্ভবত, প্রাচীন যাদু বিশ্বাস থেকেই ভালো শিকার ও প্রাচুর্যের আশাতে এই ছবিগুলো আঁকা। সেই বিবেচনা থেকে নৃবিজ্ঞানীরা এই গুহা চিত্রগুলোকে আদিম ধর্মবিশ্বাসের নিদর্শন বলে মনে করেন। আলতামিরা নামটি আদিম মানুষের আঁকা গুহা চিত্রের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও এখন স্পেনের আলতামিরা গুহার চেয়েও অনেক বেশি পুরনো গুহাচিত্রের সন্ধান ফ্রান্স ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে পাওয়া গেছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ভারতেও।
ভীমবেটকা প্রস্তরক্ষেত্র (Rock Shelters of Bhimbetaka)। ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের রায়সেন জেলার আবদুল্লাগঞ্জ শহরে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ভারতের সবচেয়ে পুরনো মানব বসতির নিদর্শন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেখানকার কিছু কিছু বসতি ১০ হাজার বছরেরও পুরনো। সেখানে প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরাতন চিত্রটি ৩০ হাজার বছর আগে মধ্যপ্রস্তর যুগের আঁকা। জ্যামিতিক নঁকশা দিয়ে কাছাকাছি সময়ে আঁকা অন্য চিত্রটি মধ্যযুগের। চিত্রগুলোতে প্রধানত লাল এবং সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। মাঝে মাঝে সবুজ ও হলুদের ব্যবহারও দেখা যায়। চিত্রগুলোর মূল উপজীব্য হলো- তৎকালীন সময়ের গুহাবাসী মানুষের জীবন, যেখানে আছে মানব শিশু জন্ম নেওয়ার দৃশ্য। আর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পানাহার, নৃত্য, ধর্মীয় আচার আর মৃতদের সৎকারের দৃশ্য। তাছাড়াও আছে দেশীয় নানারকম পশুর ছবি।
ভীমবেটকাকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষণা করে প্রকাশিত ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের নথিতে এই স্থানটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ, একটি বৌদ্ধ মঠ জাতীয় কিছু হিসেবে। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ভি.এস. বাকঙ্কর ট্রেনে করে ভোপাল যাওয়ার পথে এই অঞ্চলে স্পেন ও ফ্রান্সে দেখা প্রস্তরক্ষেত্রের অনুরূপ গঠন দেখতে পান। ১৯৫৭ সালে পুরাতাত্ত্বিকদের একটি দল নিয়ে ওই অঞ্চলে উপস্থিত হন এবং অনেকগুলো প্রাগৈতিহাসিক গুহা-বসতি আবিষ্কার করেন। সেই থেকে এই রকম ৭৫০টির বেশি গুহা-বসতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৪৩টি ভীমবেটকা অঞ্চলে এবং ১৭৮টি লাখা জুয়ার অঞ্চলে। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে সমগ্র অঞ্চলটি থেকে প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার প্রমাণ মিলেছে (অন্ত্য আশুলিয়ান থেকে মধ্য প্রস্তর যুগের শেষভাগ পর্যন্ত)। বিশ্বের প্রাচীনতম পাথরের মেঝে ও দেওয়ালও এখানেই দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৬
এসএনএস