ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাঙালির রবি-নজরুল | শুভ কর্মকার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৬
বাঙালির রবি-নজরুল | শুভ কর্মকার

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল। কবিগুরুর ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি ছাড়া যেমন পূর্ণ হয় না বাঙালির নববর্ষ উদযাপন ঠিক তেমনি নজরুলের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ ছাড়া বাঙালির ঈদ থেকে যায় অপূর্ণ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ও বাঙালির সাথে মিশে থাকা অন্তপ্রাণ এক অস্তিত্ব। আমি যে মুহূর্তে কাজী নজরুলের নামের পূর্বে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি ব্যবহার করছি তখনো মাথায় ঠেকছে অনেকগুলো কথা। প্রসঙ্গটি কবিদের নামের আগে খেতাব নিয়ে। দু’ কবির অনুসারী ও ভক্তদের মধ্যে মাঝে মাঝে এরকম একটি বিষয় নিয়ে প্রায়ই মতদ্বন্দ দেখি যা সম্পূর্ণ অবান্তর। রবিঠাকুরের নামের পূর্বে ‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’, ‘গুরুদেব’ প্রভৃতি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে নজরুলকে ঠিক কোন খেতাবে নির্দিষ্টভাবে ভূষিত করে সম্বোধন করতে হবে তা নিয়ে আমি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

তৎকালীন উপনিবেশিত ভারতে সাহিত্যকর্মে উৎকর্ষতা রবিঠাকুরকে এনে দিয়েছিল ‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’, ‘গুরুদেব’ প্রভৃতি জাতীয় সন্মাননাযুক্ত খেতাব। তিনি তার মোহিনীয় সাহিত্যকর্মের প্রভাবে তৈরি করতে পেরেছিলেন এক অপূর্ব বলয় যা থেকে সে সময়কার কোন কবি, সাহিত্যিক ও লেখকরা সহজে মুক্তি পান নি। এক্ষেত্রে রবীন্দ্র-বলয় থেকে মুক্ত কবি হিসেবে বিশেষভাবে ব্যতিক্রম মনে হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন অনেকটা দুম করে এসে মিলিয়ে যাওয়া উল্কার মতো। খুব স্বল্প সময়ে নিজ আসন গেড়ে কবি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাম্রাজ্য। কবিগুরু যখন তার প্রতিভাচ্ছটার মধ্যগগনে ঠিক তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কবিগুরুর সাহিত্য বলয়কে শুধু ভাঙেই নি, আবাহন দিয়েছিলেন নতুন দিগন্তের; যা কবিকে এনে দেয় ‘বিদ্রোহী কবি’র খেতাব। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্য সমাজে কবি-পরিচয়ের পত্তন করলেও সাম্যবাদ, প্রেম, দেশ, ধর্ম ও মনুষ্যত্ব নিয়ে তার অসাধারণ লেখাগুলো জাতিকে নাড়া দিয়েছিল বিপুলভাবে। কোন ক্ষেত্রেই তার বিচরণ এতটুকু কম মনে হয় নি বলে সম্বোধনটা শুধু আজ ‘কবি’ হিসেবেই করে গেলাম। আর রবির মতো শক্তি ও প্রাণের উৎস হয়ে বাংলার ঊর্ধ্ব ললাটের মাঝ গগনে বিদ্যমান হয়ে রইলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

সম্পর্কের সূচনা:
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সম্পর্কের সূচনা কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যসূচনার গোঁড়া থেকেই। রবীন্দ্র-যুগে রবীন্দ্র-বলয়ের সম্পূর্ণ বাইরে থেকে সাহিত্য রচনা করেছেন, লিখেছেন গান, দিয়েছেন সুর। মজার বিষয় হচ্ছে তার বন্ধু মুজফফর আহমেদ এর ভাষ্যনুযায়ী নজরুল শৈশব থেকেই রবি অনুরাগী ছিলেন। নানান জায়গায় তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বেড়াতেন, ‘আমরা বলতাম নজরুল ইসলাম রবীন্দ্র-সঙ্গীতের হাফিজ’। যুদ্ধের সময় ট্রাঙ্কে থাকতো রবীন্দ্রনাথের গানের বই। দেশে ফিরেই পরিচিত হয়েছিলেন সে সময়কার রবীন্দ্রসঙ্গীতের বড় গায়ক হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। মুজফফর আহমদ আরও লিখেছেন, ‘এরপর হতে হরিদাসবাবু ও নজরুল রবীন্দ্র-সঙ্গীত গাওয়ার জন্য একসঙ্গে অনেক জায়গায় যেতে লাগলেন’।

সেকালে যারা নজরুলের কাছে গান শিখেছেন, কবি তাদের রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখিয়েছেন শুরুতে। কাজী মোতাহার হোসেনও নজরুলের কাছে দু’খানি রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিখেছিলেন। ‘কে যেন আমারে এনেছে ডাকিয়া এসেছি ভুলে’ এবং ‘তোরা পারবি নাকি যোগ দিতে সেই ছন্দেরে’। প্রতিভা বসুকে নজরুল প্রথম শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীত ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে’। উমা মৈত্রকে (নোটন) শিখিয়েছিলেন ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি’। বিখ্যাত ফজিলাতুন্নেসার বোন শফিকুন্নেসাকে শিখিয়েছিলেন ‘হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া’। আরেকবার নজরুল শান্তিনিকেতিনে যাওয়ার সময় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে গীতাঞ্জলীর সব গান স্মৃতি থেকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন ট্রেনের কক্ষে বসে রবীন্দ্রনাথ যা শোনার পর বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। নজরুলের হৃদয়ের কতটা অংশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তা গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ ও ‘রিক্তের বেদন’ এবং ‘বাঁধনহারা’ পত্রোপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর উদাহরণ দেখলে বোঝা যায়।

সাক্ষাৎ:
১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। রবিঠাকুরের সাথে সাক্ষাতের প্রথমদিনেই কবিগুরু তাকে তলোয়ার দিয়ে দাড়ি ছাঁচার কথা বলেছিলেন। তিনি নজরুলের রাজনৈতিক সংগ্রামে আগ্রহের কথা ভাবেন নি। কবিগুরু নজরুলের কাব্য প্রতিভা দেখে ভেবেছিলেন, - নজরুল কবি, কাব্যচর্চাই তার পেশা হওয়া উচিত। মানে রাজনীতিতে তার যাওয়া উচিত নয়। নজরুল বুঝেছিলেন অন্তত এসব ভেবেই কবিগুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি ছাঁচার কথা বলেছিলেন। সে কথা বলেই চুপ থাকেন নি। নজরুলকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য। সেখানে সে ছেলেদের কিছু কিছু ড্রিল শেখাবে আর গান শিখবে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। কিন্তু পরবর্তীতে নজরুলের রাজনৈতিক আগ্রহের প্রতি কবিগুরু নিরাশ করেন নি। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট বের হয় ধূমকেতু, সম্পাদক নজরুল। কবির অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন আট লাইনের কাব্যবাণী ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু’ নামে। নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’র জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে বাণী চাওয়া হয় তখন কবিগুরু বুঝে ফেলেছিলেন যে নজরুলের বিকশিত হওয়ার পথা ভিন্ন। তিনি রাজনৈতিক আশীর্বাদক হয়ে সেদিন যা বাণীটি পাঠিয়েছিলেন সেটি হল—
“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন”।
 
এই কাব্যবাণী প্রতি সংখ্যায় ছাপা হতো। নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ বন্ধ হবার পরে নজরুল সম্পাদনা করেন ‘লাঙ্গল’। এবারও রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন নজরুলকে। প্রথম প্রকাশ পায় ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২৫।
“জাগো জাগো বলরাম
ধর তব মরুভাঙ্গা হল
বল দাও, ফল দাও
স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল”।

দার্জিলিংয়ে সাক্ষাৎ:
১৯৩১ সালের জুন মাসে দার্জিলিংয়ে ভ্রমণকালে কাজী নজরুল ইসলাম শুনলেন সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঘুরতে এসেছেন। শোনামাত্রই নিজে মুখপাত্র হয়ে লেখিকা জাহানারা চৌধুরী, নাট্যকার মন্ময় নাথ, ও শিল্পী অখিল নিয়োগীকে (স্বপনবুড়ো) নিয়ে কবিগুরুর সাথে দেখা করতে আসেন। নজরুল তার এই সাক্ষাতের কথা ১৩৩৮ সালের ‘স্বদেশ’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় প্রবন্ধাকারে প্রকাশ করেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে পেয়ে খুবই খুশী—বহুক্ষণ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়”। আড্ডার এক পর্যায়ে কবিগুরু-পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “বাবা-মশায়ের খাবার দেরি হয়ে যাচ্ছে”। সবাই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন তখন ১২টা গড়িয়ে দুপুর। কবিগুরু তখনো অভুক্ত। তাদের দুজনের মধ্যে হৃদ্যতা কতটুকু গভীর ছিল তা সহজেই বোঝা যায়।

চিঠি:
নজরুল-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের এ পর্যায়ে টানবো পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ঐতিহাসিক চিঠির কথা-

কল্যাণীয়েষু,
রথী, নজরুল ইসলামকে Presidency Jail এর ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম। লিখেছিলুম 'Give up hunger strike, our literature claims you'। জেল থেকে Memo এসেছে The addressee not found; অর্থাৎ ওরা আমার message দিতে চায় না। কেননা, নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে না থাকলেও ওরা নিশ্চয় জানে সে কোথায় আছে। অতএব, নজরুল ইসলামের আত্মহত্যায় ওরা বাধা দিতে চায় না।

শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯২২ সালের ৮ ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ রাজনৈতিক কবিতা হওয়ার অপরাধে ইংরেজরা এটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে এবং একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে জবানবন্দি দেন যা ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বাংলা সাহিত্যের এক সম্পদ বলে সাহিত্যিক মহলে স্বীকৃত। প্রহসনের বিচারে কবির ১ বছরের সাজা হয়। জেলে থাকার সময়েও ইংরেজদের অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি শুরু করেন আমরণ অনশন। নজরুলের কারাদণ্ড হলে নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে আছেন মনে করে রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত হয়ে তাঁকে ‘Give up hunger strike, our literature claims you’ বলে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, জেলার সে টেলিগ্রাম নজরুলকে দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। রবি ঠাকুর পাঠানো টেলিগ্রামের শব্দগুলোকে নিয়ে চিন্তা করলে সহজেই বোঝা যায় নজরুলকে তিনি কতটা পছন্দ করতেন।  

“নজরুলের কারাদণ্ড হলে নজরুল প্রেসিডেন্সী জেলে আছেন মনে করে রবীন্দ্রনাথ চিন্তিত হয়ে তাঁকে ‘Give up hunger strike, our literature claims you’ বলে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু সেটি তাঁর হাতে পৌঁছায়নি। ”

‘বসন্ত’ নাটক:
কবি যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে সমর্থন জানিয়ে তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। কবিগুরুর অনেক ইচ্ছে ছিল ‘বসন্ত’ নাটকটি নিজের হাতে নজরুলকে দেবেন। কিন্তু সময় ও শরীর অনুকূল না থাকায় তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে বইয়ের এক কপি স্বাক্ষরসহ দেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ‘বসন্ত’ নাটকের উৎসর্গপত্রে কবিগুরু লিখেছিলেন ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’। উঠতি তরুণ এক প্রতিভাকে রবীন্দ্রনাথ কবি বলে সেদিন স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রবিঠাকুর যখন নজরুল-কে ‘কবি’ বলেছিলেন তখন অনেকে বলেছিল পাগলকে কবি উপাধি দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন- “ঐ তারুণ্য আমার থাকলে হতো বটে। ও তো কেবল কবি নয় মহাকবি”।

বই পেয়ে বাঁধন হারা পাখী নজরুল একেবারে আত্মহারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। কবিগুরু ততদিনে শুধু ভারতের কবি নন, বিশ্বকবি, পেয়ে গিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। কবিগুরুর ‘বসন্ত’ নাটকটি কোন ক্ষুদ্র বা গৌণ নাটক ছিলনা তা ‘বসন্ত’ নাটকের গানগুলো দেখে সহজেই বোঝা যায় যেমন: ১. ‘যদি তারে নাই চিনিগো সে কি আমায় নেবে চিনে’। ২. ‘তোমার বাস কোথা যে পথিক দেশে কি বিদেশে’ গান দুটো আজো সমান জনপ্রিয়। হিন্দি ‘অভিমান’ সিনেমার বিখ্যাত গান ‘তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে ৠায়না’র সুর শচীন দেববর্মন নিয়েছিলেন ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ থেকে।
 
আত্মহারা নজরুল পত্রটি পেয়ে জেলের ভেতরেই নাচানাচি শুরু করেন। সেটি একবার কপালে একবার বুকে রাখেন। নজরুল পরে লিখেছিলেন, ‘তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, অনশন-ক্লেশ ভুলে যাই’।
কবিতায় লিখেছিলেন:

“সে সুন্দর বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়েছিলে 'বসন্তে'র পুষ্পিত মালিকা”।

নজরুলের মতো একজন ‘কয়েদি’কে বই উৎসর্গ করেছেন জেনে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ সেদিন রুষ্ট হয়েছিলেন বলে জানা যায়। শুধু ইংরেজরা নন সাথে গুরুদেবের অতি-ভক্তরাও । রবীন্দ্রনাথ তাদের উদ্দেশে বলেছেন, “আমার পছন্দ অপছন্দ আমার কাছে। তোমরা তার কবিতা পড় নাই। না পড়েই তাকে অবজ্ঞা করা শুরু করেছ। ...আমি যদি আজ তরুণ হতাম আমার কলমেও ঐ সুর বাজত। ” গুরুদেব আরো বলেছেন, “যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য। ...তীব্রতাও রসাত্মক হলেই কাব্য হয়ে ওঠে, যেমন উঠেছে নজরুলের বেলায়”। কবিগুরুর কথাগুলো শুনলে বোঝা যায় যে নজরুলের রাজনৈতিক মতাদর্শে মুগ্ধ হয়ে তিনি প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন প্রচ্ছন্নভাবে যেমনটি করে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল লালনসহ নানান ব্যক্তিদের (অনেকের) মতাদর্শ। নইলে “ঐ তারুণ্য আমার থাকলে হতো বটে” কিংবা “আমি যদি আজ তরুণ হতাম আমার কলমেও ঐ সুর বাজত” কথাগুলো নিশ্চয়ই শুধু শুধু বলতেন না।

অন্যান্য ঘটনা:
বস্তুত কবিগুরুর সাথে নজরুলের সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার। রবীন্দ্রনাথ কে পাঠানো নজরুলের ‘তীর্থ পথিক’ কাব্যে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এটা -
“তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, বিস্ময়ের বিস্ময়
তব গুন গানে ভাষা সুর যেন সব হয়ে যায় লয়
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তের তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দ মুক বানী ।
কাব্য লোকের বাণী বিতানের আমি কেও নহি আর
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস হার
প্রার্থনা মোর যদি আবার জন্মি এ ধরণীতে
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে”।

তাছাড়া নজরুলের কৈশোর রবি ও অশ্রু পুষ্পাঞ্জলি কবিতা দুইটি কবিগুরুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখা । রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাবহ ভারতবর্ষকে সান্ত্বনা দিতে রেডিও থেকে স্বরচিত ‘রবিহারা’ কবিতাটি নিজে স্ব-কণ্ঠে আবৃত্তি করেন। “ঘুমাইতে দাও, শান্ত রবিরে জাগায়োনা” শিরোনামে একটি গানও রেকর্ড করেন। এ বিষয়গুলো সাহিত্যের ইতিহাসে উপেক্ষিত।  

তৎকালীন সাহিত্য সমাজে নজরুল শুধু নমনীয় ব্যবহারে বরণীয় হয়ে স্থান করে নেন নি। তাদের উপরে করতে পেরেছিলেন নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার জন্যে গান্ধী, অরবিন্দ, চিত্ররঞ্জন, সুরেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, বারীণ ঘোষ প্রমুখকে ব্যঙ্গ করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,
‘রবি শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে
সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধ কারার বন্দ ঘরে। ’

কবিদ্বয়ের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর মতামত আছে। শুনেছি কেউ কেউ কবিগুরুকে ইংরেজদেরকে সমর্থন করে অনুকূলে থাকার জন্য ব্রিটিশদের “দালাল” বলে অপবাদ দিয়ে দুষেছিলেন ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলী’কে। অন্তত নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনে এই কারণটিকেই বড় করে দেখেন। কিন্তু এর পেছনে মাত্রাতিরিক্ত ঘাটাঘাটি করে হেয় করাটা যে বাঙালির বিরাট বড় হীনমন্যতা সেটা বলতে কোন আপত্তি বোধ করি না। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ বোধয় ঠিকই বলেছিলেন, নোবেল পুরস্কার রবিঠাকুরের জন্য দরকার ছিল এই কারণে যাতে করে তাঁকে বাঙ্গালি ও বাংলা সাহিত্য মূল্যায়ন করতে শেখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবিগুরু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিষ্ক্রিয় থাকতেন। জালিয়ানওয়ালা হত্যাকাণ্ড ও বঙ্গভঙ্গের সময়টি ছাড়া কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে কখনই সরাসরি নিজেকে জড়াননি।

“নজরুল শুধু নমনীয় ব্যবহারে বরণীয় স্থান করেন নি কবিগুরুর হৃদয়ে, তাঁর উপরে করেছিলেন নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে কবিগুরুর সমালোচনা করেছিলেন তিনি। যদিও কবিগুরু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিষ্ক্রিয় থাকতেন। জালিয়ানওয়ালা হত্যাকাণ্ড ও বঙ্গভঙ্গের সময়টি ছাড়া কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে কখনই সরাসরিনিজেকে জড়াননি। ”

ধর্মের সাম্য:
শুনতে একটু খটকা লাগতে পারেযদি বলি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনই একই ধর্মের অনুসারী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনই চেয়েছিলেন দুটি ধর্মের সমন্বয়ের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের একতা আনয়ন। শুনতে কটু লাগলেও ধ্রুবসত্য যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের একতা ধর্মের ভিন্নতার কারণে প্রায় ম্রিয়মাণ। ১৯২৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে কাজী নজরুল যেমন ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ নামক রণসঙ্গীত রচনা করেছিলেন সেভাবে ১৯০৩ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনেও রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ ভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। কবিগুরু সে আন্দোলনে সকলের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁর লেখালেখি, গান, শোভাযাত্রা ও বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে । হিন্দু-মুসলমান সকলেই সেই আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। শোনা যায় সেই তারিখে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ধর্মের মৌলবাদী খোলস থেকে বের হয়ে জাত ভেদ ভুলে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথও বেরিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে উপস্থিত মুসলমানদের হাতে রাখি পরিয়ে দেবার লক্ষ্যে। কিন্তু তাঁকে যেতে দেওয়া হয় নি। অনেকেই মনে করেন যে রাখি বন্ধনের উদ্দেশ্যে কবিগুরু যদি ওই কাজটি সম্পাদন করতে পারতেন তাহলে বোধকরি হিন্দু মুসলিম এর এই চিরকালীন দ্বন্দ্বের অবসান হলেও হতে পারতো আবার না-ও হতো পারতো।

দুজনের কবিতা ও গান:
রবিঠাকুরের গানে যেমনটি করে বাংলা গানে বিচিত্র সুরের উৎস। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও একই সঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও সুগায়ক। গানের সংখ্যায় তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছেন। হ্যাঁ ! গানের সংখ্যায় তিনি কবিগুরুকে ছাপিয়েছেন। এটি আশংকা নয়, প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাঁর মত এত গান পৃথিবীতে কেউ লিখতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ থেকে যায়। রবীন্দ্রসংগীতের যেমন নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে ২২৩২টি কিন্তু নজরুল সংগীতের নির্দিষ্ট সংখ্যা নিরূপণ আজো নির্ধারিত হয়নি, এক্ষেত্রে তাঁর উদাসীনতা ও অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডও কম দায়ী নয়। তবে সংখ্যাটি তিন থেকে পাঁচ হাজারে উঠানামা করলেও মাত্র ৩০৯৪টি গানের বাণী উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। সন্ধান পাওয়া বাকি ৮০টি গানের এখনো বাণী উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

নজরুলের কবিতা সম্পর্কে কবিগুরু মূল্যায়ন করেছিলেন এভাবে, “অরুগ্ন-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন-বর্বরতা তার অনবদ্য ভাবমূর্তি রয়েছে কাজীর কবিতায় ও গানে। কৃত্রিমতার ছোঁয়াচ তাকে কোথাও ম্লান করেনি, জীবন ও যৌবনের সকল ধর্মকে কোথাও তা অস্বীকার করেনি। মানুষের স্বভাব ও সহজাত প্রকৃতির অকুণ্ঠ প্রকাশের ভিতর নজরুল ইসলামের কবিতা সকল দ্বিধা-গুণের ঊর্ধ্বে তা আসন-গ্রহণ করেছে”।

কবি বুদ্ধদেব বসু অভিমত দিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথের গান বাণী প্রধান এবং বাণী এখানে সুরের প্রশ্রয়ে ডানা মেলেছে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলি প্রত্যেকটিই এক একটি সুপাঠ্য কবিতা। অন্যদিকে নজরুল সুর ঝঙ্কারে প্রথমে রেখা-বিন্যাস করেন তারপর বাণীর বীজ সেখানে রোপণ করে দেন। এজন্য তাঁর গানে রাগের রূপাবলি অপেক্ষাকৃত অধিক। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমাদের আত্মা শুনতে পায় উর্ধ্বমুখী কামনার পাখা-ঝাপটানি আর নজরুলে আমাদের হৃদয়াবেগ তার প্রতিদিনের হাসি-কান্নার লীলানৃত্য”।

নজরুল সঙ্গীত সম্পর্কে প্রখ্যাত শিল্পী আশা ভোঁসলে ভারতীয় পাক্ষিক সানন্দাতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “নজরুল গীতিতে বন্ধন নেই। আছে সুরের মিষ্টতা। গাইতে গাইতে যদি কোথাও একটু আলাপ বা বিস্তার করার ইচ্ছে জাগে তাহলে সেটা করার স্বাধীনতাও নজরুল গীতিতে আছে। শিল্পীর নিজস্ব ইন্টারপ্রেটেশন বা ব্যাখ্যার সুযোগ আছে। আর সেটাই নজরুল গীতির আকর্ষণের অন্যতম উপাদান”। অপরদিকে রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে তিনি বলেন, “রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গিয়ে দেখি এতে ভীষণ সুরের কড়াকড়ি। নানা রকম বন্ধন। একটা সুর বা নোট এদিক ওদিক করার উপায় নেই”। শুধু আশা ভোঁসলে নন কিশোর কুমার, অনুপ জালোটা, পংকজ উদাস, প্রমুখ আধুনিক ও গজল শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও নজরুল সঙ্গীত গেয়ে বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এর মূল কারণ- নজরুল সঙ্গীতের রয়েছে সুরের বৈচিত্র্য, মিশ্র সুর, গানের ভাষা- শব্দ চয়ন-ছন্দে পরিপূর্ণ আধুনিকতা ও মুনশিয়ানা।

বিশিষ্ট কবি ও সমালোচক আবদুল কাদিরের পর্যবেক্ষণে বাংলা সংগীতের অন্যতম যুগলবন্দী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের গানের রূপ-রস-অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে, “সঙ্গীতে মোজার্ট ও বিঠোফেন দুই অলোক সামান্য প্রতিভা। মোজার্টের গানে আছে শিল্প সম্পূর্ণতার আনন্দ ও উদার সৌন্দর্য, বিঠোফেনে আছে ক্ষত-বিক্ষত আত্মার দাহ ও বিস্তৃতি। মোজার্ট সুরের ঊর্ধ্ব-স্বর্গে ধ্যান-স্তিমিত আর বিঠোফেন আত্মা অনন্তের আত্মরক্ষা ও ভয় বিক্ষোভ নিয়া স্বর্গ হইতে নরকে আন্দোলিত হইয়া ফিরিতেছে...একালের বাংলা গানের ক্ষেত্রে এমনই দুই অনন্য সাধারণ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। রবীন্দ্রনাথের গানে মানুষের মনের ভাষা বড় আবেগ-সুর-ঝঙ্কারে পরিস্ফুট হইতে পারে। তাহা যেন সহজ সৌন্দর্য ও ললিত মাধুর্যে প্রকাশ লাভ করিয়া আছে। কিন্তু নজরুলের গান রক্তাক্ত আত্মার গান। কবি মাটির উপর দাঁড়াইয়া আছেন, কিন্তু সে দাঁড়ানো গ্রীক-দেবতা Mercur'র মতো গুলফ্মূলে তাঁর পাখা, ঊর্ধ্ব আকাশের কিরণামৃতের জন্য তাঁর দু-নয়ন তৃষ্ণার্ত। সত্যের দুলালীর জন্য তাঁর যে পরিবেদনা, তাহাই তাঁহার আত্মার রক্তপাতে গানে গানে অপূর্ব দাহের সৃষ্টি করিয়াছে”।

এবার দুজন দুজনের বাণীতে সুরে সঙ্গীতে, কতটা আত্মিক ছিলেন সে প্রসঙ্গে আসা যাক। দাঁড়িয়ে থাকলে পাশের চেয়ারটি টেনে বসুন, পানির গ্লাসটি সাথে নিন। শোনার পর চোখ কপালে উঠে যেতে পারে।

রবিঠাকুরের প্রথম ছবি, বাংলা প্রথম সার্থক ছবি “গোরা”। পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম। ছবির কাজ শেষ। ছবিতে রবিঠাকুরের গান সঠিক সুরে গাওয়া হয়নি বলে আপত্তি জানাল 'বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসংগীত বোর্ড। ইনারা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংরক্ষণে কাজ করেন সে কথা সবারই জানা। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান দেবদত্ত ফিল্মস আপত্তির কথা জানালে, শোনামাত্রই নজরুল চট্ করে ছবির ফিল্ম এবং প্রজেক্টর নিয়ে সোজা বিশ্বভারতীতে চলে এলেন কিছুমাত্র চিন্তা না করে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখিয়ে ছবির অনুমোদন নিবেন বলে তাঁর সাথে দেখা করেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “কি কাণ্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছো আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে! তোমার চেয়েও আমার গান তারা কি বেশী বুঝবে? আমার গানে মর্যাদা কি ওরা বেশী দিতে পারবে?” নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটি খসড়া অনুমোদন পত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। সেদিন ছবিটি না দেখেই রবীন্দ্রনাথ সম্মতি স্বাক্ষর পত্রে সই করে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এমনি আস্থাভাজন ছিলেন দুজন দুজনার।

এত কিছুর পরেও বাংলার সাহিত্যের এ দুজন মহান পুরুষের সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলবেন রবিঠাকুর হিন্দুদের কবি আর নজরুল মুসলমানের, একজন মৌলবাদী আরেকজন উদার কিংবা একজন ভারতের আরেকজন বাংলাদেশের? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুল ইসলামের আন্তরিক সম্পর্ক অটুট থাকুক এটা মৌলবাদী মুসলমানরা যেমন চাননি, তেমনি চাননি মৌলবাদী হিন্দুরাও। এই দেশের রাজনৈতিক সামাজিক জটিলতার সময় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনেরই অবদান উল্লেখযোগ্য। তাদেরকে নিয়ে সস্তা নোংরা রাজনৈতিক টানাটানি ও ধর্মীয় বিভেদের শেষ নেই। একদল রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু ধর্মের এবং কাজী নজরুল ইসলাম কে মুসলমানদের বলে আলাদা করে রেখেছেন। দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য দু’পক্ষ থেকেই নানা ধরনের সমালোচনা, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র অবিরামভাবে চলে আসছিল তখনো এখনো। ধর্ম যাদের কাছে মুখ্য তারা যে সাহিত্যের মর্মমূলে প্রবেশ করার যোগ্যতা বা অধিকার রাখেন না, তা রবীন্দ্রনাথ যেমন জানতেন, তেমনই জানতেন নজরুলও। অথচ তাঁরা নিজেরা কখনই এই বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন নি। সাম্য ও মানবিকতার সাধনাই তারা করে গেছেন চিরকাল। সাহিত্যের দুই মহান মানুষ দুটি প্রতিষ্ঠান। এদেরকে দেশ ও ধর্মের নামে দেওয়া দৈন্যতা থেকে মুক্ত করা ছাড়া বাঙালির মুক্তির কোন বিকল্প নেই।
বাঙালির রবি-নজরুলের আদর্শ প্রতিস্থাপিত হোক প্রতিটি মানুষের অন্তরে, ছড়িয়ে পড়ুক দিক দিগান্তরে...

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।