ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (শেষ পর্ব)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৬
ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (শেষ পর্ব)

জাহাজ এগিয়ে চলে। তীরের কাছের স্থাপনাগুলো ভালোভাবে দেখাবার জন্যে জাহাজটি মাঝ দরিয়া দিয়ে না চলে কিছুটা যেন তীর ঘেঁষেই চলতে থাকে।

আর সেখানে কিন্তু অখ্রিদের জল ততটা শান্ত নয়, বরং সবুজাভ পাথরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কিছুটা তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ। জলের এই তুঙ্গি নাচনে আমাদের জাহাজও যেন বেশ খানিকটা দুলে ওঠে। তার মাঝেই শুনতে পাই সারেংয়ের ল্যাকপেকে এক সহকারী ম্যাগাফোনে বলছে, বাঁ ধারের ওই যে উঁচু পাহাড়ের উপর এক বাংলো বাড়ি সেখানেই নাকি এক সময় যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো এসে মাঝে মধ্যে গ্রীষ্মের ক’টাদিন কাটিয়ে যেতেন।

বাড়িটি এখনও পরিত্যক্ত নয়, এটি এখন ব্যবহৃত হয় মেসিডোনিয়ার রাষ্ট্রপতির অবকাশ ভবন হিসেবে। ওই পাহাড়ের পাশেই আরেক টিলায় এক বুড়োকে লম্বা ছিপ ফেলে মাছ ধরতে দেখি, পাশের হাস্যোজ্বল এক নাতি, ডোরাকাটা এক গেঞ্জি চাপিয়ে চোখের চশমাটিকে বুকের কাছে ঝুলিয়ে বুড়ো মিটিমিটি হাসছেন আর কে জানে হয়তো নাতিকে দিচ্ছেন মাছ শিকারের তালিম।

আমাদের জাহাজটিকে সামনে রেখে পেছনে ধীরে ধীরে বইতে থাকে এক ডিঙি নৌকো, বুড়ো বয়সের হাড়ে ভেল্কি দেখিয়ে সে নৌকার বৈঠা দু’হাতে বাইতে থাকেন মাথায় গোল রোদ টুপি পড়া এক পৌঢ়। তবে আমাদের পিছু পিছু এলেও আমাদের গতিকে ছোঁয়ার কোনো অভিপ্রায় তার মাঝে লক্ষ্য করি না, তিনি বরং অনুসরণ করেন টলটলে নীলাভ জলে ফুটে ওঠা তার একমাত্র প্রতিবিম্বকে।  

সেই ব্রোঞ্জ যুগেও নাকি হ্রদের এ দিকটায় বেশ বড়সড় এক জেলে সম্প্রদায়ের বাস ছিলো। জলের উপরেই মাচাং বানিয়ে বেড়ার ঘর তুলে গড়ে উঠেছিল পুরো প্রায় একটি গ্রাম। সময়ের তোড়ে সেসব বিলীন হয়ে গেছে বহুকাল আগেই। তাই আজ যে গ্রামটিকে সেখানে দেখা যায় সেটি সেই আদি গ্রামের অনুকরণে তৈরি একটি মডেল বিশেষ, পর্যটকদের সেই অতীতের গ্রাম সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্যে মেসিডোনিয়া সরকার কয়েক বছর আগে এটি তৈরি করেছে।
প্রায় মিনিট পঞ্চাশেক অখ্রিদের স্বাস্থ্যকর হাওয়া খেয়ে আমরা এসে পৌঁছাই সেই সেইন্ট নাউম দ্বীপে। বস্তুত এ দ্বীপে আছে সাধু নাউমের মঠ, আর তার নামেই এ দ্বীপেরও নামকরণ। ঢালু এক পাহাড়ি পথ বেয়ে সেই মঠে পৌঁছামাত্র অভ্যর্থনা জানায় পেখম গুটিয়ে বেশ গম্ভীরভাবে দুলকি চালে ঘুরে বেড়ানো একটি ময়ূর। আমি তাকে খুব একটা বিরক্ত না করে মঠের অভ্যন্তরভাগে যাবার পাঁয়তারা করি।

সেইন্ট নাউম ছিলেন এক বুলগেরিয়ান যাজক। এই মঠের স্থাপত্য আর ভেতরের ছাদের গায়ে অঙ্কিত ফ্রেস্কোগুলোর মাঝেও তাই বুলগেরীয় অর্থোডক্স ধারার প্রভাব প্রবল। প্রায় ধূসর সেই ফ্রেস্কোগুল দেখার মাঝেই খেয়াল করি কিছু ভক্ত ঝটপট প্রার্থনার মোম জ্বেলে সটকে পড়ছেন পেছনের দিকে কোথাও। তাদের পিছু পিছু আমিও সেখানে যাই, গিয়ে দেখি সেখানে তখন বসে গেছে ছবি তোলার হাট। পাহাড়ের এই সুউচ্চ অংশ থেকে দূরের আলবেনিয়াকে পেছনে রেখে কে কটি ছবি তুলবেন সেই নিয়েই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।

কার কাছে যেন জানলাম এই ছোট্ট দ্বীপেই আছে আরও একটি ছোট্ট হ্রদ, আর সে হ্রদেও চাইলে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব কিছু ছোট নৌকো নিয়ে। আমাদের জাহাজ আবার ফিরে যাবে ঘণ্টা চারেক পর, হাতে তাই বেশ খানিকটা সময়। আমি ফুরফুরে মনে একরত্তি এই দ্বীপের তস্য ছোট সেই হ্রদটিকে খুঁজে নেই, কাছে পিঠে পেয়ে যাই মস্তক-মুণ্ডিত দীর্ঘদেহী এক মেসিডোনিয়ান মাঝিকেও।

ঠিক হলো আধ ঘণ্টার এই নৌকা ভ্রমণে তাকে দিতে হবে পনের দিনার, আর এই আলাপের মাঝেই বুঝলাম কেতারদুরস্ত এ মাঝি ইংরেজিটাও বলতে পারেন কাজ চালাবার মতো। এ দেশে এটি কিছুটা ব্যতিক্রমী তো বটেই। মেসিডোনিয়ায় বর্তমান প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা মোটামুটি কিছুটা ইংরেজি বললেও আগের প্রজন্মের মাঝে কিন্তু ইংরেজির অবস্থান ততটা প্রগাঢ় নয়, নিজ মাতৃভাষার বাইরে দ্বিতীয় ভাষা বলতে তারা বলতে পারেন কেবল রাশান।
সেইন্ট নাউম বা অখ্রিদের মতো স্থানে আগত পর্যটকদের অধিকাংশই আশপাশের দেশ সার্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, ক্রোয়েশিয়া অথবা দূরের রাশিয়ার মানুষ। এখনো এখানে পশ্চিম ইউরোপ বা বিশ্বের অন্য স্থানের পর্যটকদের ঢল নামেনি। অন্যদিকে যুগোস্লাভ সময়েও এ দেশে মূলত চর্চা হয়েছে সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান আর রাশিয়ান ভাষার। তাই ইংরেজিটা চলে গেছে মূলত তৃতীয় ভাষার স্থানে।
বেশ কসরত করে নিজের ওজনটাকে পাটাতনের মাঝ বরাবর রেখে যে নৌকোয় উঠলাম তাকে স্থানীয়রা বলে কাইচে, যদিও আবার মেসিডোনিয়ার অন্য স্থানে এই একই নৌকোকে ডাকা হয় চামেস নামে। অনেকটা যেমন আমাদের দেশে এলাকা আর কিছুটা প্রকার ভেদে নৌকা কখনো হয়ে হয় সাম্পান, কখনো ডিঙ্গি। আমাদের কাইচেতে প্রায় জনা আটেক লোক উঠবার পর বেশ যখন ডুবু ডুবু অবস্থা, তখন মাঝি সাহেবের সদিচ্ছা হয় বৈঠা চালাবার। এমন কাচের মতো ঝকঝকে জলের হ্রদ কস্মিনকালে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

দ্রিম নামের এই স্বচ্ছ-সলীলা হ্রদের জল-রহস্য আমি মাঝির কাছে জানতে চাই। মাঝি বলেন, আর কটা মিনিট ধৈয্য ধরো, সব বলছি। অল্প কিছুক্ষণের মাঝে বুনো এল্ভা গাছে ছাওয়া এক পাড়ের কাছে গিয়ে মাঝি বৈঠা নামিয়ে পাঠশালার শিক্ষকের মতো এক আলোচনার ভঙ্গিতে উন্মোচন করেন এই হ্রদের কিছু রহস্য।

এই যেমন আমরা এখন যেখানে ভাসছি, তার জলতলে যে সাদা ধবধবে বস্তু দেখা যায় সেই ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের কারণেই এই জল এতটা টলটলে। আর তার মাঝে মাঝে যে বুদবুদগুলো দেখা যায় ওখান দিয়েই এ হ্রদে এসে জমা হয় ভূগর্ভস্থ কিছু প্রসবনের জল। নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে মাঝি নিজের জলের বোতলখানি গলুই এর নিচ থেকে বের করে হাত ডুবিয়ে হ্রদের জলে পূর্ণ করে নেন। আমাদের একজন কিছুটা চোখ গোল গোল করে জানতে চায়, ইয়ে মানে এ জল কি পানযোগ্য?

উত্তরে মাঝি মশাই স্মিত হেসে ঢক ঢক করে বোতল থেকে জল খেয়ে নিয়ে রায় জানিয়ে বলেন, অবশ্যই। মাঝির অভয়বাণীতে পরিতুষ্ট হয়ে বুনো জলাধারে চুক চুক করে জল চেটে খাওয়া হরিণের মতো আমিও আঁজলা ভরে জল নিয়ে সবটুকু জল শুষে নেই। আমাদের কাইচে ঘাটে এসে ভেড়ায় আমার জল-পান পর্ব সেখানেই সমাপ্ত হয়, অদূরের জেটি ঘাট থেকেও এমন সময়ে ভেসে আসে ফিরতি জাহাজের ভ্যাঁপু।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৬
এএ

**
ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৬)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৫)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৪)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-৩)
** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-২)

** ইউরোপের প্রাচীনতম হ্রদে (পর্ব-১)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।