ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০২ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৭
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা এই সময়ের গল্প-৪

অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছি—গ্যারেজে, শেষ দু’ঘন্টা ধরে অবিরাম ঝরছে বিদায়ী ফাগুনের বৃষ্টি; সঙ্গে ছাতা নেই। আবাসিক এলাকার অক্ষত কালচে সড়কে গোড়ালিডুবো স্রোতধারা, মেঘের ডাকে খুব মাপা বিরতি। পিঠে ঝুলন্ত সপ্তাখানেক আগে কেনা নকল চামড়ার ব্যাগ—জলে ভিজে ওটা নষ্ট হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। যদিও নিজের কাছে বিষয়টা আড়াল করতে চাইলাম বৃষ্টিতে ঠাণ্ডা লাগতে পারে, কোনো গাড়ি সাঁই করে পাশ কাটালে ময়লা জলে অনাকাঙ্ক্ষিত গোসল হয়ে যেতে পারে এইসব অকেজো ভাবনায়। সহকর্মী এহসান ততোক্ষণে রাস্তায় নেমেছে, ওর বাসায় ফিরবার এতো তাড়া কেন তাও কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম—খিদে পেল কি? পেতেই পারে, আনুমানিক রাত সাড়ে দশটার মতো বাজবে এখন। এই আসছে গোটা বর্ষাকালে এমন হবে, যে যার মতো ঘরে ফিরবে—কেউ রিকশা ডাকবে, কেউ কোনো ছাতাধারী পথচারীকে ডেকে মুহূর্তের সঙ্গ নেবে নইলে বৃষ্টিতে দুদ্দাড় নেমে যাবে সর্দি-কাশির তোয়াক্কা পিছে ফেলে।

কই ভাই আসেন, কতোক্ষণ দাঁড়ায় থাকবেন?
এহসানের ডাকে বিমর্ষ লাগে। আসলে কি ব্যাগের চিন্তাও আমাকে পেয়ে বসেছে? মাসের ছোট্ট বেতনের একটা মোটা অংশ ব্যয় করে হঠাৎ কেনা নকল চামড়ার ব্যাকপ্যাক এতো ভাবাবে, তেমন লোক আমি? খুব হাসি পাচ্ছিল বলেই হাসিটা গিলে পথে নেমে গেলাম, কিছু আগে এহসান দেখাচ্ছিল দু’হাত দু’দিকে মেলে, “ভাই দেখেন বৃষ্টি তেমন নাই, যা পানি পড়ে সে হইল গাছের পাতা থেইকা”।

হাঁটতে হাঁটতেই তাকে বলি, একটা রিকশা পাও কিনা এগিয়ে দেখবে?
ভাই রিকশা দূর, রাস্তায় তো একটা কুত্তাও নাই।
কুত্তা নেই বলো কী? আমরা দু’জন তো দিব্যি আছি!
এহসান হাসে, কী যে কন না আপনে! অল্পবয়সি ছেলেটার মুখভর্তি এলোমেলো দাড়ি মৃত্যুমুখী বসন্তের ভেজা বাতাসে নাচে। তখন রাস্তাঘাট কাঁপিয়ে সীমানা দেয়ালের ওপাশে রেললাইন কাঁপিয়ে চলে যেতে থাকে খুলনাফেরত চিত্রা আন্তঃনগর, বৃষ্টির কারণে বুঝি এতো দেরি হলো তার? ফাঁকা ট্রেনের আলোকোজ্জ্বল কামরা দেখে বুকের ভিতরটা হুহু করে, এহসানের কাঁধে হাত রেখে বলি, ট্রেনটা দেখলেই কেমন বিভীষিকা লাগে বুঝলে নাকি?
ক্যান ভাই?
আছে, খুব বিধ্বস্ত রকমের গল্প। তোমাকে বলবো কখনও।
আপনার বাড়ি যেনো কোন জেলা?
খুলনায়।
এল্লিগাই তো কই। খুলনা হইতে ট্রেনে ঢাকায় আইতে আমারও একখান গল্প আছে। হুনবেন?  
হাঁটতে হাঁটতে কখন সৈনিক ক্লাব চলে এসেছি। চুল থেকে টুপটুপ ঝরছে জল, এটুক হন্টনেও ঝিরঝিরে বৃষ্টি জমা হয়ে গেছে শরীরের এখানে-ওখানে। রেলগেটে সিগনাল পড়েছে, লাইন পেরুবার সময় দূর থেকে দেখলাম আগুয়ান রেলের আলো, আলোটা দেখলেই কেমন পা আঠালো হয়ে ওঠে, নড়তে ইচ্ছে যায় না; মানুষ দু’চারদিন পর পর রেলে কাটা পড়ে কি ওতে আবিষ্ট হয়েই?
পরিচিত চায়ের দোকানটায় ভিড় নেই। লম্বাটে একটা ঘর—একধারে কাঁচের শোকেসে বিস্কুট, প্লেইনকেক আর বিড়িবাক্স সাজানো, অন্যধারে দু’টো পাশাপাশি চিকন বেঞ্চি পাতা। আমরা বসতে চা’অলা লোকটা কোথায় চলে গেলো, “মামা বয়ন, এট্টু আইতেয়াসি”।
হ্যাঁ, এহসান, ট্রেন নিয়ে কী বলবে যেনো?
গল্প ভাই, আপনি শুনবেন?
না শুনবার কী আছে, বলে ফেল।
বিদ্যুতের ভোল্টেজ কম-বেশি হেতু ক্যান্টিনের মৃদু আলো মুহূর্তে টিমটিমিয়ে ওঠে, চারপাশের সিগনালে আটকে পড়া যানবাহনে ইঞ্জিনের ভ্রুমভ্রুম বাজনা জোরালো আঘাত দেয় কানে; একটু দূরে জ্বলতে থাকা টিনঘেরা স্টোভে কেমন ফড়ফড়ে শব্দ জন্মায়। দেখতে পাই এহসানের ঠোঁট নড়ছে, কী যে কইছে বুঝতে পারি না। বৃষ্টির বেগ বেড়ে যায়। আঙুলে সে কোথাও ইশারা করতে সেদিকে তাকাই : হুহু করে হাওয়া কেটে এগিয়ে চলেছে আমাদের নিয়ে আস্ত ক্যান্টিনঘরটা, মেঝে কাঁপছে। বিরতির ছন্দ ভেঙে আকাশে সুতীব্র গর্জন করতে থাকে মেঘের পাল। চায়ের দোকানটা কি রেলগাড়ি হয়ে গেলো?
তাই হয়।

চারপাশে আধো-অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি অনেক লোকজন। দু’পাশের কামরার মৃদু আলোয় আলোকিত রেলের এই সঙ্গমবিন্দু যেখানে এক কামরা অন্য আরেক কামরার সঙ্গে মিলেছে। আমার মনে হয়—খুলনা থেকে ঢাকা ফিরছি। পকেটে আসন নম্বরসমেত একটা টিকিট। এতো মানুষ সামলে নিজের আসনে পৌঁছুতে পারবার হতাশা কমছে না—আসন দূর, নির্দিষ্ট কামরাটায় পর্যন্ত উঠতে পারিনি। এহসানকে কোথাও আর দেখি না। দেখি এক বৃদ্ধকে, গোলাকার মাথাভর্তি খাড়া খাড়া চুল—কদমফুলের মতো, পরে থাকা চশমার একটা কাঁচ ফ্যাকাশে হওয়ায় বুঝে নিই বৃদ্ধের ওই চোখটায় অন্ধত্ব। আমার মেজোচাচাও জীবনের শেষ দিকে এমন একটা চশমা পরতেন। এলাকার এক ধনবান বন্ধুর সঙ্গে চন্দনীমহল থেকে তিনি ঠিক এভাবেই ট্রেনে করে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিলেন, বাঁ’চোখটায় তখন যে খুব সামান্য অসুবিধে ছিলো আমলোকের ভাষায় তাকে বলে ছানিপড়া। যথাসময়ে শহর থেকে ছানি অপারেশন করে চন্দনীমহল ফিরলে তাকে দেখায় সুপুরুষ চেহারার এক সাময়িক যুবকের মতো। আমার আব্বা এবং বড়চাচার সঙ্গে এক দুপুরে ঝগড়ার তীব্রতায় খুব চিৎকার করতে গিয়ে তার চোখের ব্যান্ডেজে খিঁচ ধরে—এর বছরখানেক বাদে মেজোচাচা মরবার পর কবরে যান তার পুরোপুরি অকেজো বাঁ’চোখ নিয়েই। না চাইলেও আমার ওই দিনটা মনে পড়ে যায় : যথারীতি রাত জেগে সিনেমা দেখবার পর, কয়েকছত্র একটা নিবন্ধ লিখবার ক্লান্তিতে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙছে ছোটবোনের ফোন নম্বর থেকে উড়ে আসা অবিশ্রান্ত ডাকে, তাও সে দশবার চেষ্টা করবার পর এগারোবারের মাথায়। চন্দনীমহলে নামা এক হলদে বেলা এগারোটায় দাঁড়িয়ে সে জানায়, ভোরে মেজোচাচা মারা গিয়েছেন, আমি মিরপুর থেকে খুলনায় রওনা করবো কিনা?
রেলগাড়িটা যশোর পৌঁছুলে এতো মানুষ উঠতে চেষ্টা করে যে আমি কোনোকিছু ধরে থাকা ছাড়াই শূন্যে স্থির হয়ে রই। একে অন্যকে ঠেলে দরজাগুলোয় পুরুষ, নারী এবং তাদের সঙ্গে শিশু, উঠতি বয়সি কিশোরী ও খুব বয়স্করা উঠতে থাকে—জানালা গলে কিংবা সোজা ছাদেও। এমন সময় কে একটা বাঁশের মই এনে প্লাটফর্ম থেকে ছাদে ঠেকায়। মইঅলাকে বিশ টাকা দিয়ে একের পর এক লোকজন ট্রেনের ছাদে উঠতে শুরু করে হাসিমুখে। জনা সাতেক লোক উঠতে পেরেছে, হঠাৎ গার্ড বাঁশি বাজালে মানুষ আতংকে চিৎকার করে ওঠে—মই বেয়ে ছাদে উঠবার মাঝামাঝি থাকা এক যুবক নিচে পড়ে যায় কেননা মইঅলা মই ধরে টান দেয়। সবাই হইহই করে ওঠে, “পড়িছেরে, টেরেনের তলে পড়িছে”। আমার গায়ের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে লেগে থাকা এক যুবক কৌতুকের স্বরে বলে, “চলো তবে এইবার ভূত হয়ে ঢাকা চলো”।
মানুষের ঠেলায় একটা কামরায় বাধ্য হয়ে ঢুকে পড়বার সুবিধা পেয়ে যাই ধীরে ধীরে, শাদাটে আলো জ্বলছে, ফ্যান চলছে—এই ট্রেনগুলো নতুন, জানালার পাশে বসা এক সুবেশ মধ্যবয়সি পুরুষ তার ষোড়শী কন্যাকে বলছেন, এই রেল ক’দিন আগে দিলো সরকার, হেগে-মুতে জাত রাখলো না দেখসিশ?
আব্বু, কী পচা শব্দ বলো তুমি।
সুবেশ পুরুষটি চোখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকান। হয়তো ভাবেন, আমি ওইসব সুযোগ সন্ধানী যাত্রীদের মতন, বিনা টিকেটে রেলের কামরায় উঠে পড়ে এমন ভদ্র ও মার্জিত অজস্র পরিবারের দারুণ এক রেলযাত্রার বারোটা বাজাচ্ছি। আমার আনন্দ, বেদনা ও অহমের অনুভূতি একসঙ্গে পাক খায় তলপেটে। তিনদিনের ছুটিতে খুলনা এসে কী বিপাকেই না পড়েছিলাম মনে পড়ে। পরিবহন ধর্মঘটে শহরের সব বাসরুট বন্ধ, বেরুবার উপায় নেই। এদিকে অফিস ধরবার আবশ্যিকতা, নগরে ফিরবার তাড়না নিয়ে আমি এ ঘাট ও ঘাট করে বেড়াচ্ছি। খালিশপুর নতুনরাস্তার টিকেট কাউন্টারগুলোকে এক ভোরে স্নিগ্ধতার বদলে ভুতুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি : ফেব্রুয়ারির শেষ দশক অথচ খুলনায় রাত নামলে যে শীত তার রেশ নিয়ে ভোরটা আলো হতে চাইছে না এরূপ মনে হয়। চারদিকে হুট করে এমন কুয়াশা নামে, রাস্তার এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। মানুষ যারা কর্মের সন্ধানে নেমেছে—হেঁটে এদিক-সেদিক যাচ্ছে, ইজিবাইকগুলো চলছে ভয়ে ভয়ে। গেলো সন্ধ্যায় নাকি এই ব্যাটারিচালিত অটোগুলোতেও আন্দোলনরত শ্রমিকেরা ভাঙচুর করেছে। এক রিকশাঅলা—উদ্দেশ্যের মৃত্যু হচ্ছে তেমন এক মানুষ ভেবে আমার নিকটে এসে সুধায়, ভাইডি কুয়ানে যাবেন?
আমি বলি, হার্ডবোড খেয়াঘাট।
রিকশায় উঠে বসলে কুয়াশা ভেদ করে সেটা চলতে শুরু করে। একরকম চেপে থাকা হতাশা উজাড় করতেই রিকশাঅলাকে প্রশ্ন করি, ঘটনা কী বলেন তো। এই জঘন্য ধর্মঘটের কারণ কী? মানুষের দুর্ভোগ্যের তো সীমা দেখছি না।

ভাইডি, এইডে তো শুরু। ওই ডিরাইভাররে ছাইড়ে না দিলি এ ধর্মঘট শেষ হবেনানে।
কোন ড্রাইভার? ঘটনাটা কী, এই প্রশ্ন আমি করি এক রকমের মূর্খতা নিয়ে। কী হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হুট করে চলে এসেছিলাম খুলনা, রাজনৈতিক ও সার্বিক দেশীয় সংবাদ সম্পর্কে একদম অজ্ঞ থেকেই—বাসায় কতোদিন দৈনিক নেওয়া হয় না, এ কি তার ফলাফল? রিকশাঅলা আমাকে জ্ঞানী করে তোলে, শুনেন মামা। রাশশাইতে এক মহেন্দ্রগাড়ি তিনজন যাত্রী নিয়ে সন্দারাত্তিরে গাছের সাতে বাড়ি খাইলো আরেকখান টিরাকরে সাইড দিতি গিয়ে। তিন যাত্রীই ইস্পট ডেড, শুদু ওই ডিরাইভার বাইচে গিসে। তারে পুলিশি ধইরে নিয়ে গেসে, পরদিনেই ফাঁসির হুকুম হইয়ে গিছে সাতে সাতে।
বলেন কী!
ভাইডি এন্নে আপনেই কন, ডিরাইভার কি ইচ্ছে কইরে এক্সিডেন করিসে নাই? এর জন্যি ফাঁসি দিয়ে দেবে?  
এক রকমের গুমোট গন্ধে ট্রেনের ভিতরটায় দাঁড়িয়ে মাথা ভার হয়ে আসে। মনে হয় গোটা দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন বুঝি আজ উঠে পড়েছে এই সুন্দরবন নামের আন্তঃনগর এক্সপ্রেসে। দু’সারি সিটের মাঝখানে মোটমাট গজ খানেক যায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কিংবা দুলতে থাকি। ঝিকুর ঝিকুর শব্দের বদলে গুমগুম আওয়াজ হয়। শুধুমাত্র কামরাটির সিলিঙেই কোনো লোক নেই, তখন কেউ একজন বলে, “শাউয়ো যারা সিটি বসিছে এইগে মালামাল নামাইয়ে ওই ব্যাগ রাখার শিকগুলোর উপরে শুয়ে পড়তি মনে কচ্ছে”। একটা হাসির তোড়ে হুইহুইহুই রকমের শব্দ খেলা করে যায়। দাঁড়িয়ে থাকি, দাঁড়িয়েই থাকি। নড়াচড়ার কোনোরকম উপায় মেলে না, আমার পিছনের সিটে যে চ্যাপ্টা হাতল ওতে বসে পড়ি পা’দুটোকে একটু বিরাম দিতে। প্রায় সমবয়সি সেই যুবকটি যে বলেছিল এখন ভূত হয়ে ঢাকা চলো, কাছেই দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল করলাম—হাসিমুখে বলে, “বেশি সময় হাতলে বসবেন না পাইলস হয়ে যাবে”। হুইহুইহুই শব্দটা আবার আসে—রেলকামরার মেঝে বোঝাই করে যারা বসেছিল, এবার তারা হাসে আরও উচ্চশব্দে। একটু দূরে সেই সুবেশি পুরুষটির দিকে তাকাই আমি, ঘুমুচ্ছেন, গাল হাঁ হয়ে আছে; ষোড়শী মেয়েটার হাতে স্মার্টফোন, উজ্জ্বল মুখে কী যেনো করছে। যেনো অনন্তকাল এই ট্রেন চলবে, আমরা কখনও গন্তব্যে পৌঁছুতে পারব না—দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একেকজন হয়ে যাব গাছ, পায়ে শেকড় গজাবে—চামড়া হয়ে উঠবে রুক্ষ, ট্রেনের জানালা গলে হয়তো দলে দলে চেনা-অচেনা পাখির দল এসে আশ্রয় নেবে শরীরে। আমার মেজো চাচার মতো দেখতে লোকটা, তিনিও খুব কাছে দাঁড়িয়েই ঢুলছেন—তাকে কেমন গাছ মনে হয় মুহূর্তে, স্মরণ হয় মেজোচাচার বলা সেই ভুবনপুরের কাহিনীটা।  

ভুবনপুরে হায়দার বেপারিরা বাস করতো। তাদের গোয়ালভরা গরু ছিলো, ফি’বছরেই গাভীগুলো জন্ম দিত পাল পাল বাছুর। সারা মহল্লায় বেপারিদের বাড়িটাকে লোকে বলতো গরুবাড়ি। এমন গরুময় বাড়ি তাদের কাছে ছিলো বিস্ময়কর কারণ, সারা পৃথিবীতে এরূপ বাড়ি থাকতে পারে, গ্রামবাসীর কল্পনায় ছিলো না। মৌসুমটা ছিলো বিয়ানোর। এক ভোরবেলায় অন্য আরও অনেক গাভী যখন বিয়োচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট বকনা কিংবা এঁড়ে, একটি মায়াকাড়া চেহারার গাভীও বিয়োলো—রক্তাক্ত ছোট্ট প্রাণীটি বকনা বা এঁড়ে কিছুই ছিলো না, সেটা ছিলো আস্ত এক মানব শিশু। সারা গরুবাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল, এরপর গোটা ভুবনপুরে। “হায় হায়, কলি নাইমে গেইছে দুনিয়াতে। গরুর প্যাটে মাইনষির বাচ্চা? এ কিরাম কথা কউ দিন তুমরা?” অমনটা কইতে কইতে সারা গ্রাম ভেঙে পড়লো, সবাই একনজর দেখতে চায় শিশুটিকে। স্থানীয় বংশীয় হিন্দুদের একটা দলও চলে আসলো, তারা দাবি করল স্বয়ং দেবদূতরূপে ভুবনপুরে অবতারণ হয়েছে শিশুটির, এ সাধারণ ঘটনা হতেই পারে না এমনকি তারা গরুসহ বাচ্চাটিকে নিয়ে যেতে চায়—দরকার হলে তারা পর্যাপ্ত অর্থ প্রদানেও রাজী আছে। এই যখন অবস্থা, হায়দার বেপারির যাকে বলে নাভিশ্বাস উঠে যায়। শিশুটি হয়তো তার সামনেই কাঁথামোড়ানো অবস্থায় চিৎকার করে কাঁদে অথবা দুনিয়া যে এক বিচিত্র স্থান, আধফোটা চোখমেলে বুঝবার চেষ্টা করে। গরুর পেটে জন্ম নেওয়া মানব শিশুটিকে সবাই দেখতে চায় একনজর কিন্তু সে সুযোগ কাদের কাদের মেলে খুঁজে পাওয়া দায় হয়। বেলা বাড়তে থাকে, মানুষের মনে দানা বাঁধে অসন্তোষ—বেপারি বাড়ি থেকে কি গুজব ছড়ানো হয়েছে? হইচই বেড়ে যখন মধ্যগগনে ঠেকে, হায়দার বেপারি তার পঞ্চান্নে পড়া ঋজু দেহটিকে দাঁড় করিয়ে দেন জনাকীর্ণ মেটে উঠোনের মাঝখানে।
তুমাদের কী সমস্যা? এইরকম গোল করতিসো কেন ঘরদুয়ারে আইসে?
জবাব দিতে গিয়ে একটা নতুন হল্লার স্রোত খেলে ওঠে চারদিকে। আমরা দেখতি চাই, বাচ্চাডারে দেখতি চাই।
মানষির বাচ্চা তুমরা দেখোনাই এর আগে?
ওইদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা এরপর ছড়িয়ে পড়ে মহাপৃথিবীতে। ভিনগ্রামে কেউ বিয়ে করে, কেউ পাড়ি জমায় শহরে কেউবা হিজরত করে ভিনদেশে কিন্তু গরুর পেটে জন্ম নেওয়া সেই বিচিত্র মানবশিশুটির কথাটি তারা ভোলে না। হায়দার বাড়ির পিছনদিকে কী যে বিশাল এক বটগাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ, ও গাছটাই নাকি সেই গরুর গর্ভে জন্ম নেওয়া মানব শিশুটি। জন্মের রাতে যে নিখোঁজ হয়ে যায় আর পরদিন ভোরে সবার অলক্ষ্যে বেপারিভিটের পিছনদিকে গজিয়ে ওঠে এক বটগাছ হয়ে।

এসমস্ত ভাবতে ভাবতে একদল কিশোরের দিকে তাকালাম। এদের বয়স চৌদ্দ থেকে আঠারোর মাঝে, কর্মের সন্ধানে ঢাকায় চলেছে—উত্তরা যাবে, হয়তো কোন পোশাক কারখানায় ঢুকে পড়বে। ওদের চেহারার সারল্য একেবারে শিশুর মতন কিন্তু স্বভাবে বর্ণনাতীত এক অভিযোগ, কাদের প্রতি? সামনে দাঁড়ানো সেই যুবকটিকে তখন জিজ্ঞেস করি, আপনি কোথায় যাবেন?
চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।
কবে ইন্টারভিউ? কোথায়?
কাল সকাল নয়টায়। নিটোল মোটোরসে।
এই সারারাত জার্নি করে পারবেন পরীক্ষা দিতে?  
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে যুবকটি সুধায়, আপনি কি ঢাকাতেই থাকেন?
হ্যাঁ।
কী করেন?
ছোটখাটো একটা চাকরি করি।
ট্রেন ঈশ্বরদী পৌঁছুলে কি লোকজনের ভিড় কমবে? একটু বসতে পারব ভাই? কী যন্ত্রণা হলো বলেন দেখি, গোটা এক রাত্তিরের জার্নি এইভাবে দাঁড়িয়ে করা যায়! পা’দুটো তো গাছ হয়ে যাচ্ছে, দেখেন কেমন ফুলে উঠেছে?
ছেলেটা প্যান্ট তুলে পা দেখায়, আসলেই ফুলেছে, নীলচে মতো রঙ হয়েছে ওগুলোর। বুঝতে পারি আমার নিজের পা’দুটোও ফুলে উঠছে কেমন—মোড়া জুতোর আড়ালে চামড়ার গভীরে তলিয়ে থাকা টনটনে শিরা-উপশিরার বেদনা টের পাই, ঘামে ভিজে কুটকুট করে সারাদেহ, দপদপিয়ে ওঠে মগজ। সিটে বসা এক মহিলা সহমর্মী কণ্ঠে জানান যে ঈশ্বরদী জংশনে লোকজন কমবে।  
আর কয়টা স্টেশন পর সেই জংশন?
তিনটা মনে হয়।
নাম না জানা কোনো স্টেশনে কিছু সময়ের জন্য ট্রেন থামলে কিশোরের দলটি—যারা সম্ভবত কোনো পোশাক কারখানায় কাজ নিতে শহরে চলেছে, জানালায় হাত গলিয়ে ফেরিঅলার থেকে অনেকগুলো সিঙাড়া আর সমুচা কেনে। ওদের দেখাদেখি পুরো কামরার লোকজন সিঙাড়া-সমুচা কিনতে ব্যাগ্র হয়ে ওঠে, হুটোপুটির মতো শুরু হয়। জানালা টপকে আরও কিছু মানুষ ট্রেনে উঠতে চাইলে ভিতরের যাত্রীরা তাদের পানে তেড়ে ওঠে, কিছুক্ষণ আগের সেই সহমর্মী মহিলাটির ধাক্কাতেও প্রায় আধেক দেহ গলিয়ে দেওয়া এক লোক ছিটকে পড়ে বাইরে।
ট্রেন ফের তার আগের গতি পায়।

মায়ানগরে পৌঁছুবার অপেক্ষা ঝেড়ে আমরা উৎকর্ণ হয়ে উঠি ঈশ্বরদী জংশনের তরে—কখন একটু বসতে মিলবে, সবার গাছ হয়ে উঠতে থাকা পা’দুটো আবার মানবিক সুবিধা পাবে। একটা ট্রেন যেনো গোটা দুনিয়াসমেত রাত্তির ভেঙে এগিয়ে যেতে থাকে। মনে হয় এই যা কিছু ঘটছে, সমস্তই কি এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্প? বুঝিবা একে অন্যের গল্পে আমরা ঢুকে পড়েছি অনিচ্ছায় এবং বেরুতে পারছি না। অদূরেই সিটে বসা সুবেশি পুরুষটির দিকে চেয়ে আমার হিংসে হলে দেখি যে তার মুখটি বিকৃত হয়ে উঠেছে, মেজোচাচার মতো দেখতে বৃদ্ধটি খুশখুশ করে কেশে নিয়ে বলেন, “উনারে ছারপোকায় কাটতিসে, বইসে থাকলিও জ্বালা”। তখন দূরে, কামরার আরেক প্রান্তে দেখা যায় এহসানকে—দাঁড়িয়ে আছে অন্যদের মতোই, আমি ওর নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠি—এতো এতো মানুষের হল্লা ভেদ করে আমার কণ্ঠস্বর সে পর্যন্ত পৌঁছায় না।

** যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
** আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
** টান । আকাশ মামুন
**এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, ০৪ আগস্ট, ২০১৭
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।