১.
ফিউজিটিভের ছদ্মাবরণে হঠাৎ ট্রেকিং করতে চলে এলাম গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল-এ। আফিম চাষের স্বর্গ বলে যার বদনাম।
জীবন-যাপনকে গণিতের নিয়মে আবদ্ধ রাখা যায় না সব সময়। কখনও কখনও নিয়ম ভেঙে যায়। আমারও নিয়ম ভাঙে। একদিন সোজা প্লেনে চেপে নানা ঘাট ঘুরে অবশেষে একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে বারমুডায় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে।
সোনালী ত্রিভূজে প্রথম ক’দিন এলোমেলো ছুটাছুটি। স্থির হওয়ার পর এক সন্ধেবেলায় ব্রাজিলিয়ান কফি পানের ফাঁকে ট্যুর গাইড আমার হাতে একটা বই গুঁজে দিল, যার বিষয়বস্তু- আফিম। আগ্রহে হাতে নিয়ে দেখি আফিমের মতো একটি জটিল বিষয়ে কেমন বড় মাপের একটি বই লিখা হয়ে গেছে!
ড্রাগ্স নিয়ে কোনও দিনই মাথা ঘামাইনি, তবু আড় চোখে নিষিদ্ধ আনন্দে পাতাগুলোয় তাকিয়ে হঠাৎ নজরে এলো এক আজব লাইন: ‘ইন বেঙ্গল, ক্যালকাটা ওয়াজ দি ওপিয়াম ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন দ্য নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’। বলে কী! আমি তো খোদ বাংলারই লোক, জম্ম-কম্ম আর বাপ-দাদার বহু-পুরুষের বসবাস। অথচ আমিই জানি না ব্যাপারটা! আমার মতো আর কেউ জানে বলেও তো শুনি নি!
আফিম খাওয়া তো দূরের কথা, বাল্যকালে গাঁজার কলকে ছাড়া অন্য কিছুতে টান দিতে কাউকে দেখিনি কখনও। এখন অবশ্য অবস্থা পাল্টেছে। নানা ধরনের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নেশা দেদারছে ঢুকছে বিশ্বের দেশে দেশে। সর্বত্রই মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সরকারি অফিস পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে। অবশ্য এসব অফিস নিয়ে আমার কোনও আস্থা নেই।
আমার বিশ্বাস, উপমহাদেশের অফিসগুলোতে উপনিবেশের ভুত-প্রেতরা বাস করে। অফিসাররা সাবেক ব্রিটিশ রাজা বা রানীর আত্মীয়ের মতো। তা-না হলে নিদেন পক্ষে হালের নেতা-নেত্রীদের পরম পছন্দের মানুষ। অতএব জনগণ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; জনসেবা তাদের মুখ্য কর্ম নয়; প্রধান মোক্ষ তো নয়ই। তাদের লক্ষ কর্তাভজন। ‘বিচ্ছু’ নামের একটি বোম্বের ছবিতে দেখেছিলাম, খোদ মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাই কর্তাব্যক্তিদের কব্জা করে সদম্ভে আন্ডার ওয়ার্ল্ড দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রকাশ্যে তিনি সাধু বাবা। নানা রকম পদক ও সম্মাননা নিচ্ছেন মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করার বাহানায়। এই সময়ের মাদক সম্পর্কে আমার তীর্যক জ্ঞান এতটুকুই।
বারমুডার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল-এ মাসখানেক কাটিয়ে কানাডার মন্ট্রিয়ল-এ ফিরে এলাম। আমি ওখানকার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করি। কানাডার নাগরিকও বনে গেছি। হয়েছি দ্বৈত নাগরিক বা ডুয়েল সিটিজেন। মাথায় ডুয়েল স্রোত। কানাডায় থাকি আর ভাবি বাংলার ঔপনিবেশিক সময়, যার তলে খেলা করেছিল আফিমের নীল ধুম্রজাল।
আমার মাথায় একবার কোনও কিছু ঢুকে গেলে সহজে বের করতে পারি না। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতেই হবে। আমার নাকি এনকোয়ারিং মাইন্ড: খুঁতখুঁতে খোঁজার স্বভাব। শেষ পর্যন্ত ভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে আফিমের ওপর একটা বই ধার নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। মাত্র কয়েক পাতার মধ্যেই যাকে বলে দিব্যচক্ষে ভেসে উঠল আমার অতি চেনা কিছু আবছা মুখ। একটি বইয়ের কাঠামো হাতছানিতে ডাকতে লাগল। কি নাম দিতে পারি? ‘দি ওপিয়াম ক্লার্ক’ হলে ভালো হতো। সেটা হবে না। রেফারেন্স ঘেঁটে জেনেছি, আগেই এ নামে কুণাল বসু একটি আস্ত উপন্যাস লিখে রেখেছেন। অতএব নতুন চিন্তা করতে হবে।
আফিম পর্বের উপন্যাস বিষয়ক চিন্তার আগে কয়েকটা ছোটগল্প ছাড়া বিশেষ কিছু লিখিনি। কবিতার কথা বাদ দিলে এসব গল্পই আমার ভরসা। একবার চট্টগ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। তখন ‘অঙ্গুস্তানা’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। মনে আছে, গল্পের খোঁজে ফাউজুল কবির নামে একজন কবি আমার সহযাত্রী হয়ে বন্দরনগরীর সর্বদক্ষিণ প্রান্তের ইপিজেড এলাকার পোশাক কারখানাগুলোর সামনে বসে থাকতেন। পোশাক নারীদের প্রাত্যহিকতা নিকট থেকে দেখার চেষ্টায় কতটুকু সফল হয়েছিলাম জানি না। তবে গল্পটি লিখে অপার আনন্দ পেয়েছিলাম মনে আছে।
তারপর ঢাকার পাশে জাহাঙ্গীরনগরের প্রেক্ষাপটে একটি গল্প চলে আসে নাটকীয়ভাবে। রিসার্সের কাজে সেখানে গিয়েছিলাম কিছুদিনের জন্য। মিলা, কাকলী, শাম্মি নামের কিছু তরুণ-তরুণীর সঙ্গে অবসর সময়ে বসতে বসতে খানিক ঘনিষ্ঠতা হয়। সে সুবাদে তাদের আশা-হতাশার গোপন এলাকাটার গভীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা হয়ে যায়। তাই নিয়ে লিখি ‘দ্বৈরথ’ নামে আরেকটি গল্প। কিভাবে যেন গল্পটি ছাপায় আর অন-লাইন-ওয়েভে ছড়িয়ে যায় দেশে-বিদেশে। তারপর থেকে একটা বড় লেখার জন্য মন উসখুস করছিল। মাস্টারির কাজ কোনও দিনই মনে দাগ কাটেনি, রোজগেরে চাকরির ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্যের হাতছানি। কী লিখি, কী লিখি? আফিমের খোঁজ পেয়ে বড় ধরনের কাহিনীর উন্মাদনা পেলাম। এ তো যে-সে প্লট নয়, যাকে বলে ক্লাসিক্যাল নভেলের খোরাক। এক দিকে ইতিহাসের টান, অন্য দিকে হরেক জাতির ফুলশয্যার নেশাতুর খাট পাতা।
আমার জানা-শোনা কলোনিয়াল সিলেবাসের ফাঁক-ফোকর দিয়ে গলে যাওয়া আফিমের গল্প শুরু ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত বিহারে, আর শেষ চীনে। আজকের চীন নয়। চীন তখন আফিমখোর ঘুমন্ত জাতি। বিহারের পাটনার ফ্যাক্টরিতে তৈরি হত আফিমের দলা, যার নাম ‘বেঙ্গল মাড’। বাংলায় জন্ম নয় বটে, তবে তার ব্যবসা-বাণিজ্য সবই কলকাতার আলিপুরের অক্শন হাউস-এ। এখন যেমন চা উৎপন্ন হয় সিলেটে আর অকশন হয় চট্টগ্রামে। সে রকমই বিহারের আফিমের নিলাম হতো কলকাতায়। কলকাতা থেকেই আফিম কিনে ব্রিটিশ কোম্পানির সাহেবরা পাড়ি দিত চীনে। জাহাজ খালাস করে কিনে নিত সাংহাই-এর দোকানিরা। তার পর ডিঙি নৌকো চড়ে আফিম পৌঁছে যেত চীনের মূল ভূখণ্ডের ঘরে ঘরে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গোটা জাতটাকে নেশাখোর বানিয়ে ফেলেছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক বেনিয়া। এমনই এই ব্যবসা, যার মন্ত্র একটাই, আফিম খাও আর ব্রিটিশ কোম্পানির লাভ বাড়াও। আমি খাবো না, তোমরা খাবে। আমি শুধু চাই লাভ! শকুনের লোভাতুর চোখের মতো মুনাফার লাভাস্রোত।
শুধু ব্যবসায়ী নয়, আফিমের রঙিন দুনিয়ায় ভিড় জমিয়েছিল আরও অনেকেই। নেশাখোর, জাহাজের কাপ্তান ও খালাসি, বিবিধ ষড়যন্ত্রী, পাদরি, কেরানি, গুপ্ত বিপ্লবী, বারবনিতা, ব্যর্থ প্রেমিক, বেশ্যার দালাল, ফতুর জমিদার ও পলাতক খুনি। এদের নিয়েই গল্প আবর্তিত, যার মুখ্য চরিত্রে জানবাজারের ব্রাহ্মণ সন্তান হিরণ্যগর্ভ চক্রবর্তী, টোলের পরীক্ষায় ফেল করে শেষমেশ ম্লেচ্ছ ইংরেজদের আফিম কোম্পানির নিম্ন বেতনভুক কেরানি। নেশা তার নেশা-করা আর হাত দেখা। আমরা, যারা কলকাতা বেড়াতে গিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং-এ গিয়েছি, তাদের আফিমের অক্শন হাউস চিনতে অসুবিধে হবে না। সারি সারি ডেস্কের ওপর ফাইলে মুখ গুঁজে কেরানিকুল। এখানেই হিরণবাবুর হাতেখড়ি। আর বন্ধুত্ব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, পার্সি, শ্যামবাজারের ঘটি আর একজন বিশিষ্ট সাহেব, অক্শন হাউস-এর সুপারিনটেনডেন্ট জোনাথন ক্র্যাব-এর সঙ্গে।
ক্র্যাব ভারতপ্রেমী। তাঁর বউ লিলিয়ান, কোম্পানির বড়সাহেব বিয়ে করে জাতে ওঠা গরিব ঘরের নেটিভ-মেমসাহেব। সে নিজেও ঘোরতর আফিমখোর। হিরণের ডাক পড়ে ক্র্যাবকে সংস্কৃত শেখাতে। ঔপনিবেশিক বেনিয়াদের মধ্যে স্থানীয় ভাষা শিক্ষার তখন বেশ দস্তুর। সে সুবাদে হিরণের সঙ্গে পরিচয় হয় লিলিয়ানের। তৈরি হয় অদ্ভুত ত্রিভুজ: নেশার সোনালী ত্রিভুজের বিপ্রতীপে প্রেমের মায়াবী ত্রিভূজ।
এদিকে কলকাতার পাট শেষ হলে ক্র্যাব রওনা দেন চীনের ক্যান্টন বন্দরে। সঙ্গে যান তাঁর প্রিয় কেরানি হিরণ। তখন ওপিয়াম যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। পরাস্ত চীনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপিয়ানরা। এদিকে নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ দূরপ্রাচ্যের জলহাওয়া আর বিচিত্র খাওয়া-দাওয়ায় নাজেহাল, দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল। এই প্রবাসেই তাঁর প্রথম প্রেম। তত দিনে ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গিয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন, আফিম-উৎখাত যার অন্যতম দাবি।
কলকাতা আর ক্যান্টনের পর উপন্যাসের শেষ অধ্যায় আরেক আফিমের শহর মালয়েশিয়ার কুচিং-এ। এখানে মুখ্য ভূমিকায় ডগলাস ক্র্যাব, জোনাথন আর লিলিয়ানের পরিত্যক্ত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সন্তান। হিরণ তার অভিভাবক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ টোকা দিচ্ছে এশিয়ার দরজায়, সাম্রাজ্যের পতন আসন্ন, সেই সঙ্গে আফিমের গল্পও শেষ। আমার তখন পুরো গল্পগুলোকে সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। থোক থোক তথ্যকে কাঠামোয় আনার ব্যস্ততায় কখনও কখনও মনে হতো, সাম্রাজ্য শেষ, উপনিবেশ শেষ, আফিমের ব্যবস্থাও আপাতত শেষ; কিন্তু নেশার নীল জগত কী শেষ হয়েছে? থেমেছে মানুষের দিকশূন্যহীন বিভ্রমের চাদর জড়ানো নীল উড়াল?
শুধু কি মানুষ? সমাজ ও দেশে দেশে নেশা ছড়িয়ে দিয়ে গেছে অবিশ্বাস, হিংসা, ঘৃণা। ইংরেজ চলে গেলেও আফিমের কারণে ঐতিহাসিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বরফ জমে আছে চীন আর ভারতের মধ্যে। সেই বিতৃষ্ণা প্রকট হয়েছিল ১৯২৪ সালে, যখন রবীন্দ্রনাথ চীনে উপস্থিত হন। ২০১২ সালে প্রকাশিত লেখক পঙ্কজ মিশ্র-র ‘From the Ruins of Empire’ গ্রন্থে এই ক্ষোভের নিপুণ বর্ণনা আছে। চীনের পক্ষ থেকে ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তীব্রতর রূপ লাভ করেছিল ১৮৩৯-৪১ সময়কালের আফিম যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবহর ভারতীয় সেনার সহযোগে ক্যান্টন আক্রমণ করে। পরিণামে সাংহাই-সহ পাঁচটি বন্দরের বাণিজ্যের অধিকার বেইজিংয়ের চিং সম্রাটের হাত থেকে চলে যায় ব্রিটিশদের আয়ত্তে।
এই সেই আফিম, যার চাষ হতো বিহারে। পাটনা, বারাণসীতে তখন আফিমের রমরমা কারবার। সেগুলো রাসায়নিক প্রস্তুতির পর বাক্সে পুরে নিলাম হতো কলকাতায়। নিলাম ডেকে খরিদ্দারেরা সেই মাল রীতমতো বিল কেটে সাহেব কোম্পানির জাহাজে চাপিয়ে দিতেন। অতঃপর আফিম মোটা অঙ্কে হংকং ও ক্যান্টন বন্দরের নদীর মুখ থেকে কিনে নিত চীনা চোরাচালানকারীরা। বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করা হত ঘুষ দিয়ে। এই আফিমের প্রভাবে চীনে মারা যায় কয়েক কোটি মানুষ। শেষ হয়ে যায় চিনাদের কর্মশক্তি। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে নষ্ট হয় একটি আস্ত শতাব্দী। এই আফিম ব্যবসার পুরোভাগে যেসব ভারতীয় ছিলেন, তাঁদের অন্যতম বিখ্যাত বাঙালি দ্বারকানাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত পিতামহ। রবীন্দ্রনাথ হয়ত এই কারণেই পারতপক্ষে তাঁর ঠাকুরদাদার নাম উচ্চারণ করতেন না। ‘ভারতী’ পত্রিকায় একটি গ্রন্থ সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন একটি স্মরণীয় প্রবন্ধ, শিরোনাম ‘চীনে মরণের ব্যবসা’ ( জ্যৈষ্ঠ ১২৮৮)। প্রবন্ধের প্রথম লাইনেই রবীন্দ্রনাথের প্রবল আক্ষেপ প্রকাশিত হয়: ‘একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লোভে বলপূর্বক বিষপান করানো হইল, এমনতরো নিদারুণ ঠগীবৃত্তি কখনও শুনা যায় নাই। ’
এই লেখার ৪৩ বছর পর ভারতীয়-এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী কবি যখন চীনে যান, তখন ভারত সম্পর্কে চীনে তৈরি হয়েছে ক্রোধের বদলে ঘৃণা ও অবজ্ঞা। সাংহাইয়ে ছাত্রেরা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, 'Go back, slave from a lost country'!
(চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৭
জেডএম/