ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘বক্তব্যজীবী লেখক’ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৭
‘বক্তব্যজীবী লেখক’ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক হিসাবে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (১৪ অক্টোবর ১৯৩০-৪ সেপ্টেম্বর ২০১২)  নিজেকে ‘বক্তব্যজীবী লেখক’ পরিচয় দিলেও তিনি গভীর জীবনবাদী, রসজ্ঞ কথাশিল্পী। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ঔপন্যাসিকের তিনি সমকালীন, অথচ স্বতন্ত্র প্রতিভায় উজ্জ্বল। আজ ৪ সেপ্টেম্বর তার ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী।

তাঁর জীবনবোধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইসলাম ও হিন্দু সংস্কৃতির ভাস্কর্য মেলবন্ধন ঘটেছে। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে তাঁর প্রথম যৌবনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণীয় : ‘পশ্চিমি ধ্রুপদী সংগীতের রেকর্ড শোনাতেন।

একদিন বিঠোফেনের ছ’টা সিম্ফনি শুনিয়ে জানতে চাইলেন মনের কী সব অনুভূতির সৃষ্টি হল। বললাম। উনি আমাকে রেকর্ডের কভারগুলো পড়তে দিলেন। অবাক হয়ে দেখি, সিম্ফনিগুলোর ভাব অবিকল আমার অনুভূতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ’ ফলে তাঁকে তারাশঙ্কর-পরবর্তী রাঢ়-বাংলার একজন সার্থক কথাশিল্পী হিসেবে দেখা হয়। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখক সত্তায় জড়িয়ে ছিল রাঢ়ের রুক্ষ মাটি। জন্মভূমি মুর্শিদাবাদের পাশের জেলা বীরভূম, যেখানে লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্করের জন্ম। একই জলহাওয়া তাঁদের দুজনকেই প্রাণোন্মাদনা দিয়েছিল। তাই তারাশঙ্কর বলতেন, "আমার পরেই সিরাজ, সিরাজই আমার পরে অধিষ্ঠান করবে। '
আত্মকথায় সিরাজ জানিয়েছেন, ‘আমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তোমার শরীরে পবিত্র পুরুষ হজরত মুহম্মদের রক্তধারা আছে। আমরা সৈয়দ বংশীয়। দাদুর দাদু ফারসি ভাষায় যে ডাইরি বা রোজনামচা লিখেছিলেন, তার বিবরণ বিস্ময়কর। আমাদের পূর্বপুরুষ খোরাসানবাসী। সেমেটিক রক্তধারার সঙ্গে আর্য রক্তধারা মিশে গিয়েছিল। … এহেন পরিবারের বিষয়বৈভব বলতে যা ছিল, তা শুধু কিতাব। রাশিকৃত গ্রন্থ। … আরবি, ফারসি, উর্দু প্রকাণ্ড সব বই। তার অনেকগুলোই হাতে-লেখা পান্ডুলিপি। … বাবা এই ঐতিহ্যের মূলধারাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। গান্ধীজির ডাকে নন-কো অপারেশন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেল খাটেন। তারপর আমাদের পরিবারটি হয়ে উঠল রাজনৈতিক পরিবার। দাদুও ওহাবী আন্দোলনের কড়া সমর্থক এবং গোঁড়া ফরাজী ছিলেন। … মা আনোয়ারা বেগম কবিতা ও গল্প লিখতেন।

বিচিত্রা-বঙ্গলক্ষ্মী-সওগাত-গুলিস্তাঁ ইত্যাদি সে-সময়কার কলকাতার অজস্র পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরুত। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে চিঠিতে তাঁর যোগাযোগ ছিল। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি বাংলাদেশের ফজলুল হক সেলবর্সীর লেখা অনেক চিঠি তাঁর কাছে দেখেছি। আরো দেখেছি – ভারতীয় কম্যুনিস্ট দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজঃফর আহমদকে আমাদের মাটির বাড়ির দোতলায় লুকিয়ে থাকতেন। তখন উনি ছিলেন আন্ডার গ্রাউন্ডে। ’
 
সিরাজের "ইন্তি, পিসি ও ঘাটবাবু", "ভালোবাসা ও ডাউনট্রেন"( প্রকাশিত প্রথম গল্প), "তরঙ্গিনীর চোখ","জল সাপ ভালোবাসা", "হিজলবিলের রাখালেরা", "রণভূমি", "উড়োপাখির ছায়া", "রক্তের প্রত্যাশা", "মৃত্যুর ঘোড়া", "গোঘ্ন", "রানীরঘাটের বৃত্তান্ত", ইত্যাদি অসংখ্য ছোটগল্প অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে । তাঁর প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস - "নীলঘরের নটী"। পর পর প্রকাশিত হয় "পিঞ্জর সোহাগিনী", "কিংবদন্তির নায়ক","হিজলকন্যা","আশমানতারা", "উত্তর জাহ্নবী", "তৃণভূমি", "প্রেমের প্রথম পাঠ", "বন্যা","নিশিমৃগয়া","কামনার সুখদুঃখ", "নিশিলতা", "এক বোন পারুল", "কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি", "নৃশংস","রোডসাহেব", "জানগুরু" ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তাঁর গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ভারতের সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এমনকি ইংরেজি তো বটেই, বিশ্বের বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে৷

তাঁর লেখা 'তৃণভূমি" উপন্যাসে রাঢ়ের কান্দি মহকুমার এক বৃহৎ অঞ্চল ধরা আছে। "উত্তর জাহ্নবী" উপন্যাসে ধরা আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথা, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত। আর "অলীক মানুষ" এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী, যা এক মুসলিম পীর বা ধর্মগুরুর বংশে জাত পুরুষের আত্মানুসন্ধান। ব্রিটিশের রাজত্বের শেষভাগে এক পরিবর্তনীয় সময়ের নিখুঁত স্থির ছবি। এই অলীক মানুষ তাঁকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করেছে।

ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করলেন "গোয়েন্দা কর্নেল" নামে একটি চরিত্র, যাঁর মাথা জোড়া টাক, ঠোঁটে চুরুট, অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসার, এখন প্রজাপতি ও পাখি দেখতে ভালোবাসেন। নিজেকে প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন, অথচ তিনি অনেক অপরাধ ও হত্যার কিনারা করে শখের গোয়েন্দাগিরি করেন৷ গোয়েন্দা কর্নেল পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তিনি আরো একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেন পরিণতমনস্ক পাঠকদের জন্যে। তিনি ছিলেন 'ইনস্পেকটর ব্রহ্ম'।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল। সংবাদপত্রে চাকরি করলেও কোনও মালিকানাগোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করেন নি । 'অলীক মানুষ' উপন্যাস ছাপা হয় ধারাবাহিকভাবে 'চতুরঙ্গ' নামে একটি লিট্‌ল ম্যাগাজিনে। "তৃণভূমি" ছাপা হয় অধুনালুপ্ত 'ধ্বনি' নামক এক ছোট পত্রিকায়। বড় পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর সেরা উপন্যাসগুলি ছাপা হয়েছে ছোট পত্রিকায়। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের প্রতি ছিল তাঁর সস্নেহ পক্ষপাত। মিডিয়ার আলো ও প্রচারের প্রতি তাঁর আকুলতা ছিল না। নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রায় একা উন্নত গ্রীবায় ছোট ফ্ল্যাটে জীবনকে কাটিয়ে গেছেন। মাথা উঁচু করে থাকার দর্পী মনোভাবের জন্য তাঁকে অনেক মনোকষ্ট পেতে হলেও তিনি দমে যান নি। তাঁর পাঠকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর। তাঁর ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও আন্তরিকতা। তার মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাই।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-লেখক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।