সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, বহুগামিতা অন্যায়, কিন্তু নিয়মের আড়ালে ব্যাপারটি যখন অরাজকতায় পৌঁছায়, তখন তা বিপত্তিকর বিষয়। আসলে ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পূণ্য এগুলো তো ভীষণভাবে আপেক্ষিক... কিন্তু যা সুস্থতার পথে বাধাস্বরূপ তা সে যে আঙ্গিকেই হোক আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হয় সামাজিক কারণে— এটা যে কোনো সার্থক সূত্র তা একেবারেই নয়।
অনেকক্ষেত্রেই ভালবাসার গন্তব্যগুলো একঘেয়ে হয়ে যায় কারণ, এটা শর্তাধীন ও স্নায়বিক উদ্দীপনার অধীনে জাগ্রত, যদি না সেখানে মানসিক তরঙ্গদৈর্ঘ্যর আলাদা মাত্রা থাকে। আবার অনেকক্ষেত্রে এসব বিষয় ছাড়াও মুক্ত বিনিময়ের জন্য প্রভাবক হিসেবে মানুষ নতুন সম্পর্ক গড়ে কিছু না ভেবেই। আসলে মানুষের ভেতরে নেওয়া আর মেশার এবং অবশ্যই কৌতূহলের একটা জায়গা থাকে..., প্রয়োজনের তাই আঙ্গিক বদলায়। আবার মিশতে মিশতে ব্যক্তিত্বের নতুন দিক খোলে। এগুলো অবশ্যই পরকীয়ার অনুঘটক। এবং বিশেষত, যৌনতা; আগেই বলেছি, যৌনতা ভোগাকীর্ণ বিষয়, তাই শুধুমাত্র যৌনতানির্ভর সম্পর্ক একগামিতায় সাধারণত বেশীদিন স্থায়ী হয় না। পরকীয়ার প্রসঙ্গে আসতে গেলে প্রথমেই ভালোবাসার কথা বলতে হয়, এটি একটি অবয়বহীন সত্য, যার নির্ধারিত শৃঙ্খলার মধ্যে অবগাহনে ব্যক্তিত্ব সব এক নয়। তা যদি নির্ধারিতও হয় তা আপেক্ষিক ও ভিত্তিক প্রয়োজনীয়তায় শৃঙ্খলিত হয়েও হয় না। আমরা সাধারণত যে ছকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হই তা মাত্রাকেন্দ্রিক। জৈবিক ভিত্তি -> বন্ধন -> নির্ভরতার প্রয়োগ -> দর্শনের উত্তরণ -> সূত্রমাফিক চলন।
অনেকসময় মনে করা হয় ভালোবাসা শর্তহীন হওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তবিক তা প্রযোজ্য নয় কারণ, আমাদের নিজস্ব যাপনই শর্তহীন নয়— যেমন নিজেকে নিয়ে নিজেরই চাহিদায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে মানুষ হীনমন্যতায় ভোগে। আর কোনোকিছুকে “শর্তহীন” হতে বলা মানেই শর্তাদেশ দেওয়া। প্লেটো যে “symposium” তথা দর্শনের কথা বলেছেন, বিচার্যভাবে তাও শর্তহীন নয়।
কারণ, নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শরীরী ভালোবাসার দ্বারাই কামনা-বাসনার উপপ্রতীকের মাত্রা হয়ে ওঠে— আসলে প্রবৃত্তি আবেগপ্রসূত হলেই তা বিষয়বস্তু। যেমন জলের ধর্মই ওপর থেকে নিচে যাওয়া, সুতরাং ধর্ম হারিয়ে গেলে সে প্রভাব কৃত্তিম হয়। যদি শরীর দিয়ে শরীরকে অতিক্রম করে ভালোবাসার দীর্ঘকালীন প্রতিষ্ঠা হয় এবং তা মুক্তভাবেই লাঘব হওয়া উচিত।
তাত্ত্বিক দিক থেকে সম্পর্কের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে সেই বিভাগে, এখন আলোচ্য বিষয় যদিও পরকীয়াভিত্তিক পলিগ্যামি।
RELATIONSHIP’S TYPES FAMILY * KINSHIP
SIBLINGS * COUSIN
MARRIAGE * HUSBAND * WIFE
FRIENDSHIP (ROMANTIC)
SIGNIFICANT OTHER
BOYFRIEND * GIRLFRIEND
CASUAL * COHABITATION
SAME SEX RELATIONSHIP
SEXUAL RELATIONSHIP
MONOGAMY * NONMONOGAMY
OPEN MARRIAGE * POLYAMORY
POLYFIDELITY * POLYGAMY
CICISBEO * CONCUBINAGE
COURTESEAN * MISTRESS
*ইন্টারপারসোনাল রিলেশনশিপ, যা সেক্সুয়াল ও আসেক্সুয়াল দু’রকমই হতে পারে। এই তন্ত্রটি HPA-axis (HYPOTHALAMIC-PITUITARY ADRENAL AXIS) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অক্সিটোসিনারজিক সিস্টেমের মাধ্যমে মা ও তার সন্তানের বাৎসল্যের স্থাপন হয়, সুতরাং স্তনপান একটি প্রতিবর্ত কারণ, শুধু প্রোল্যাকটিন ক্ষরণের মাধ্যমে নয়, এটি একটি মিডিয়াল প্রিঅপটিক এরিয়া ( MEDIAL PREOPTIC AREA/MPOA) এবং ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া (VENTRAL TEGMENTAL AREA/VTA) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যা মস্তিষ্কের সেনসরি অরগ্যানে কাজ করিয়ে স্নেহকে বাড়ায়। এছাড়াও ডোপামিন হরমোন যা লিম্বিক তন্ত্রে কাজ করে। অপরদিকে, প্রাপ্তবয়স্ক তথা পূর্ণযৌবনের মানুষদের ক্ষেত্রে অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
পলিফিডিলিটি (POLYFIDELITY) যেখানে একই গোষ্ঠীতে প্রত্যেকে সমানভাবে যৌনসম্পর্কে আশ্রিত, সানফ্রান্সিসকোর কেরিস্তা গ্রামে ১৯৭১ থেকে ১৯৯১ অবধি এটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রচলিত ছিলো। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের পুলসাইড পার্টি, বিচ পার্টিগুলোকে সাজানো হয় সেক্সুয়াল গেমসসহ আরও কিছু উপাদান দিয়ে যেনো তারা সমসাময়িক মানুষকে সহজে বেছে নিতে পারে। নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী মস্তিষ্ক ডোপামিন, সেরাটোনিন ক্ষরণ করে। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, এ ধরনের আকর্ষণ সঠিকভাবে দেড় থেকে দু’বছর স্থায়ী থাকে। মস্তিষ্কের আনন্দের অনুভূতিকেন্দ্র এইসব স্নায়বিক মুহূর্তে হৃদস্পন্দন বাড়ায়, আপেক্ষিকভাবে খিদে ও ঘুম কমায় এবং এগুলোর স্থায়িত্বমূলক সময়ের দীর্ঘতা ইচ্ছা, শিক্ষা, স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল। এখানে অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন (NGF) ভূমিকা পালন করে।
গ্রিক এরোস (EROS) থেকে EROTICISM এর উৎপত্তি। ক্ল্যাসিকাল রূপকে “অন্তরঙ্গ” সম্পর্ক বোঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন শরীরী সম্পর্কের বিভঙ্গের জন্য শৈল্পিক রূপকে এঁকে ধরেছেন শিল্পীরা। রোমান্টিক অনুষঙ্গ নিয়ে যৌন সম্পর্ক বোঝাতে এই আবেগের প্রকাশ। নিচে কিছু এরোটিক আর্টের ছবি দেওয়া হলো।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে কোর্টলি লাভ ( courtly love) প্রচলিত ছিলো। তৎকালীন দূর্গের মধ্যে প্রচলিত ছিলো এই সনাতন প্রেম প্রথা। একাদশ শতকে এর ওপর কিছু নিয়ম লাঘু হয় যথা “NO ONE CAN BE BOUND BY A DOBLE LOVE”। সিসিলির নরম্যান রাজত্বে এটি প্রচলিত ছিলো, পঞ্চদশ শতকে মধ্যযুগীয় ইউরোপে যে ফিউডালিজম (FEUDALISM) তথা নিয়মতান্ত্রিক সৈন্যদের জীবন ছিলো তাতে এর প্রভাব দেখা যায়। প্রচলিত অর্থে এ নিয়ে বিতর্ক আছে যে এটি কতখানি যৌনতা নির্ভর!
আবার “impersonal love” এর ক্ষেত্রে একটি গন্তব্য হলো অলট্রুইজম (ALTRUISM)। যদি এক্ষেত্রে শরীরী প্রভাবক আসে তবে তা প্যারাফিলিয়ার (sexual arousal) অন্তর্ভুক্ত হয়। ক্ষুধা, তৃষ্ণার মতো সেক্সুয়াল আর্জিও একটি ম্যামেলিয়ান ড্রাইভ।
*ইনফিডেলিটি (INFIDELITY)— যেখানে মানুষ একগামিতায় থাকলেও বাইরে আলাদা সম্পর্ক রাখে।
*রিলেশনশিপ এনার্কি (RELATIONSHIP ANARCHY)— ব্যক্তি কোনো নিয়মের মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক অতিবাহিত করতে অরাজি।
*ট্রয়লিজম (TROILISM)— এই ধরনের সম্পর্কে তিনজন মানুষ এক যৌনতায় অংশ নেয়।
*পলিয়ামরি (polyamory)— একাধিক রোমান্টিক সম্পর্ক, এই প্রথায় ভালোবাসা ও ইচ্ছার সাযুজ্যে একাধিক সম্পর্ক স্বীকৃতির দ্বারা সমর্থনযোগ্য।
একটি মিউজিক কমিউনিটি “BREAKING BENJAMIN” এই প্রথার সমর্থনে গান গেয়েছে। পলিয়ামরিরা পলিপ্রাইড নামক পতাকা ব্যবহার করেন, যার তিনটি রঙ থাকে। ওপরে নীল (সমস্ত সদস্যদের মধ্যে মুক্তবন্ধ ক্রিয়া ও সততা), মাঝখানে লাল (ভালোবাসা ও দৃঢ়তা), শেষে কালো (সমাজের হস্তক্ষেপে কিছু গোপন সততার মাধ্যমে ভালবাসা)। কেন্দ্রে একটি সাংখ্যিক “পাই” চিহ্ন থাকে যা ভালোবাসার বন্ধন ও তার আবেগকে প্রাকৃতিকভাবে বজায় রাখে। এটি সোনালি রঙের হয়।
যখন একটি পুরুষ একই সময় একাধিক স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন বা বিবাহিত হন তখন তা পলিগাইনি, যখন এটি কোনো নারী করেন তখন তা পলিঅ্যানড্রি নামে পরিচিত হয়। যেসমস্ত দেশ এ ধরনের যৌনতাকে স্বীকৃতি দেয় না সেখানে এটা “বাইগ্যামি” ক্রাইমের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বায়নের যুগে সার্বিকভাবে এটি স্বীকৃত না হলেও অনেকেই “সেক্স র্যাডিকাল” (যৌনমূলকে) মুক্ত প্রেমে এটাকে বহন করে যেনো যৌনতা বিনা কারণে অবদমিত না হয়। এথনোগ্রাফিক অ্যাটলাস (ETHNOGRAPHIC ATLAS) অনুযায়ী, এক হাজার ২শ ৩১টি সমাজের মধ্যে ১শ ৮৬টি মনোগ্যামাস, ৪শ ৫৩টি পলিগাইনাস, ৫শ ৪৪টি আকস্মিকভাবে পলিগাইনি ও ৪টি পলিঅ্যানড্রি। কিছুকিছু ক্ষেত্রে পলিগাইনাস বিবাহ সেমসেক্সেও হয়ে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার লভেডুতে (lovedu) ফ্র্যাটারনাল পলিঅ্যানড্রির প্রচলন আছে। ২০১০ সাল অবধি পলিগাইনি মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে অস্বীকৃত ছিলো। ফ্র্যাটারনাল পলিঅ্যান্ড্রি ভুটান, লাদাখের বৌদ্ধদের মধ্যে কিছু মাত্রায় প্রচলিত। ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩ সালে “আমেরিকান সিভিল লিবার্টি ইউনিয়ন” যুক্তাষ্ট্রে এটি নিষিদ্ধ বলেছে। সনাতন ধর্মে ১৯৫৫ সাল থেকে “হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট” অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু পুরাণে এরা যথাযথ প্রভাব ছিলো, ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের কিছু কিছু জায়গায় প্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে একগামিতাকে বেছে নেওয়া হয়েছে যেমন- শল্যপর্বের ইন্দ্র ও শ্রুবাবতী, আদিপর্বে ভৃগু ও পুলোমা, বনপর্বে পরীক্ষিৎ ও সুশোভনা এবং অগ্নি ও স্বাহা। আবার দেখা যায়, নারীর বহুগামিতা তথা পলিঅ্যান্ড্রি, যেখানে কৃষ্ণ মহর্ষি নারদকে বলছেন, “আমি সত্যাশ্রয়ী, তাই দ্বারকার ষোলো হাজার রমণীর যদৃচ্ছা বিচরণের অধিকার আছে এবং তা তার কাছে কোনো দূষণীয় বিষয় নয়’’। সুতরাং এটি বোঝা যায় যে, বহুগামিতা স্বীকৃত ছিলো।
প্রকৃতপক্ষে পরকীয়া আদৌ কতটা গ্রহণযোগ্য, জীবনের ক্ষেত্রে কতটা সফল— তা নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কী অনুচিত, সবকিছুই বিতর্কিত বিষয়... যেমন করে মনুষ্য সমাজের কোনো নিয়মই প্রশ্নাতীত নয়!
বাংলাদেশ সময়: ১২৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৭
এসএনএস