ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ব্যবচ্ছেদ এবং অতঃপর | হানিফ মোল্লা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৮
ব্যবচ্ছেদ এবং অতঃপর | হানিফ মোল্লা ব্যবচ্ছেদ এবং অতঃপর | হানিফ মোল্লা

থিয়েটারে এক সন্ধ্যায় শিমুল মুস্তাফার কবিতা শুনতে গেলাম। অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনও কিছু সময়  বাকি। বাইরে গেটের কাছে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে অপেক্ষার অস্বস্তি পার করছিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক লোকজনের দিকে আমার চোখ। হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা মুখে।

চেনা-জানা মুখ। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, আমি ঠিক দেখছি কিনা।

মনে হচ্ছে বন্ধু রাজন। চিনতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। বারো বছর আগে যেমন ছিলো, ঠিক তেমনই এখনও দেখতে। লিকলিকে পাতলা টাইপের শরীর। কথা বলার সময় একটা হাসি লেগেই থাকে মুখে। পাবলিক প্লেসে পরিচিত কাউকে পেয়ে গেলে ভালোই লাগে। ছাত্রজীবনে আমার অনেক পাগলামির একটা ছিলো গোল মেডেল বিতরণ। গোল্ড মেডেল না, গোল মেডেল। নানান ক্যাটাগরিতে সেই মেডেল পরিচিত বন্ধুদের মাঝে বছরে একবার দেওয়া হতো, একটা ছোট-খাটো বন্ধুদের জটলার মধ্যে কলা ভবনের ঝুপড়িতে। দুইবার সেই মেডেল রাজন-শীলা জুটি পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ প্রেমে জুটির কারণে।

দেখলাম একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু রাজন। সিগারেট অর্ধেক খেয়ে এগিয়ে গেলাম রাজনের দিকে। আমাকে খেয়াল করেনি সে। কাছে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে তাদের দুইজনের আলাপ শুনছি। আমাকে বিরক্তিকর কেউ মনে করে তাকালো একবার। তারপরেই বুঝতে পারলো আমি অনন্ত। সারা শরীরে একটা আনন্দ ছড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণী আমার হঠাৎ আগমনে খুশি হতে পারেননি। সেটা তার এতোক্ষণ হাসি হাসি মুখের ভঙ্গি আর এখন জোর করে হাসি ধরে রাখার চেষ্টাতেই বোঝা গেলো। রাজন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো তার সাথে। কিন্তু আমার তো রাজনের সাথে আরেকজনকে দেখার কথা। মনের মধ্যে এটা নিয়ে একটা খচখচি ভালো রকমেরই হচ্ছিল। রাজনকে একপাশে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মেয়ে কে?

মুখে বিরাট একটা হাসি মাখিয়ে রাজনের উত্তর, আরে ধুর! তেমন কেউ না, আমার ছোটবোনের মতো। আমি আশ্বস্ত হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, শীলা কোথায়? ওকে দেখছি না কেন? রাজনকে এইবার বিব্রত হতে দেখলাম। নিজেকে সামলিয়ে নিলো এক ঝটকায়। আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল- বাদ দে, শীলা এখন আমার জীবনে এক ভুলে যাওয়া অতীত।

রাজনের ভারী গলার স্বরে বেশ বুঝতে পারলাম, যতোই মুখে শীলাকে অতীত বলুক না কেন, এখনও শীলা তার সমস্তটা জুড়েই আছে।

আমি কিছুতেই মানতে পারলাম না ব্যাপারটা। জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী? খুলে বল।

রাজন একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। তারপর আমাকে বলল, আসলে পুরাতন বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই সবাই শীলার কথা জানতে চায়। আমার বলতে ভালো লাগে না। ঠিক আছে, কবিতা শুনি। তারপর বাসায় যাওয়ার আগে শীলার কাহিনী বলবো। আমাকে এক পাশে আর সেই নতুন পরিচিত তরুণীকে আরেকপাশে বসিয়ে কবিতা শোনা হলো। হলঘরে শিমুলের ভারী গলার আবৃত্তি। আমি রাজনের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করলাম অনেকবার তার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু রাজনকে আমি চিনি অনেক বছর ধরে। কোনো প্রকার আবেগ তার চেহারায় ফুটে ওঠে না। কিন্তু পূর্ব পরিচিতির কারণেই আমি জানি যে, তার ভেতরে মারাত্মক রকম আবেগ আছে।

অনুষ্ঠান শেষে তরুণীকে বিদায় দিয়ে আমি রাজনকে আবার চেপে ধরলাম, এইবার বল ঘটনা কী?

কোন ঘটনা?

তোর আর শীলার ছাড়াছাড়ির ঘটনা বল।

ওহ! আমি আরও ভাবলাম এই মেয়ের সাথে আমার কী সম্পর্ক, কতোটা মাখামাখি এইসব জিজ্ঞেস করবি।

আমি সিগারেট জ্বালালাম, দোকানীকে বলে আরেকটা সিগারেট দিতে বলতেই রাজন বলে- না, লাগবে না। আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি। অবাক হলাম। আমি বললাম, খুব ভালো করেছিস কিন্তু আমি এখনও ছাড়তে পারিনি।

ঠেলায় পড়লে ছেড়ে দিবি। বলেই আবার হা হা করে হাসলো রাজন। আমি কায়দা করে সিগারেট টেনে যাচ্ছি। রাজন কথা শুরু করলো।

শীলার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর নিজের শরীরের উপর অনেক অত্যাচার গেছে বুঝলি। ডাক্তার অনেক কিছু নিষেধ করেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজেই আর সিগারেট নিতে পারছি না। শরীরে কুলায় না। তবে চা খাই। চায়ের কথা বল। চায়ের কথা বললাম দোকানীকে। চায়ে শব্দ করে চুমুক দিতে দিতে আবার রাজনের কথা শুরু হলো।

আচ্ছা দোস্ত মনে আছে? লেডিস হলের সামনের দোকানে ইচ্ছা করে শব্দ করে চা খেতাম আমরা। আমি সিগারেটে টান দিয়ে বললাম, মনে থাকবে না আবার। মেয়েগুলো এমনভাবে তাকাতো যেনো দুনিয়ার সবচেয়ে খ্যাত ছেলেরা তাদের সামনে বসে আছে। আমরা দু’জনেই ব্যাপারটা নিয়ে হাসলাম। রাজন বলল, কিন্তু শীলা ছিলো ব্যতিক্রম। সে এইগুলো গায়ে মাখতো না। অন্যসব মেয়েদের মতো সেজেগুজে ছেলেদের আকর্ষণ করার মন তার না। আমার মতো আউলা টাইপ ছেলেই সে পছন্দ করে বসে, এতে আমি নিজেই অবাক হই।

আমি বললাম, সেসব তো জানি, কীভাবে ছাড়াছাড়ি হলো সেটা বল।

চায়ের কাপ দোকানীকে ফেরত দিয়ে আমি আরেকটা সিগারেট ধরালাম। ব্যস্ত রাস্তার ধারের ফুটপাতের মাঝে একটা বেঞ্চে বসে রাজনের দুঃখের কথা শুনতে আরম্ভ করলাম।

রাজন বলতে থাকলো, তখন আমরা এম.এ শেষ করেছি। রেজাল্ট বের হলো। আমি পাশ করতে পারলাম না এম.এ। জানিস তো, আমার গানের দলের শখ ছিলো। গানের দলের পিছনে সময় দিতে দিতে পরীক্ষায় খারাপ করলাম।

শীলা সেবারই পাশ করে গেলো। আমাকে নানানভাবে তাড়া দিতো পড়ালেখা করার জন্য। কিন্তু আমি তেমন গুরুত্ব দিতাম না। ফেল করবো ভাবতে পারিনি। এরই মধ্যে একটা প্রাইভেট কলেজে লেকচারের চাকরি হয়ে যায় শীলার। তখনও আমাদের প্রেম আগের মতোই ছিলো। শীলার চাপাচাপিতেই পরের বছর পাশ করে ফেলি। যা তা পাশ। কিন্তু তখনও অনেক পাগলামি আমার মধ্যে। আমি কিছুতেই সিরিয়াস ছিলাম না।

শীলা সংসারেরে বড় মেয়ে। বাসা থেকে তার বিয়ের জন্য অনবরত চাপ। সেই চাপ শীলা আমাকে রোজ রোজ দেখা হলেই দিচ্ছে। আমি শীলার চাপে পড়ে দু-চারটা চাকরির দরখাস্ত করি। কিন্তু আশানুরূপ উত্তর আসে না।

এদিকে শীলার ব্যাংকে একটা চাকরি হয়ে যায়। আমি টিউশনি শেষ করে তার অফিস ছুটির সময় মাঝে মধ্যে যেতাম। শীলার পারিবারিক চাপ আর আমার ক্রমাগত উদাসীনতায় শীলা খুব বিরক্ত ছিলো বুঝতাম। কিছুদিন যেতেই খেয়াল করলাম, শীলা আর আমার সাথে খুব বেশী কথা বলে না। এমনকি হু, হ্যাঁ বলেই কথা শেষ করে বাসায় চলে যায়।

একসময় আমার উপস্থিতি তার বিরক্তির কারণ হয়ে যায়, বেশ বুঝতে পারি। আমি তার অফিস ছুটির সময় দেখা করাটা প্রায় বন্ধই করে দেই। ফোন করলে সে খুব ব্যস্ততা দেখায়। তারপরও আমি মাঝে মধ্যে ফোন করি। এর মধ্যে গানের দলের নিজেদের ঝগড়া, আর দলের একজন চাকরি পেয়ে ঢাকা চলে যায়। দলটাও ভেঙে যায়। আমি অনেক চেষ্টা করেও দলটা আর বাঁচাতে পারলাম না। টিউশনি করি নিজের পকেট খরচ চালাবার জন্য। চাকরি খুঁজি। একে-তাকে বলি একটা চাকরির কথা। কিন্তু চাকরি আমার আর হয় না।

শীলা এখন আর আমাকে নিজ থেকে ফোন করে না। একদিন গভীর রাতে শীলাকে স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, স্বপ্নে শীলা এসে আমাকে একটা কথাই থেমে থেমে বলছে, ‘রাজন তুমি ফেল করেছ! রাজন তুমি ফেল করেছো’। ঘুম ভেঙে গেলো। বাতি জ্বালিয়ে একগ্লাস পানি খেলাম। শীলাকে একটা ফোন করলাম। দেখি তার নাম্বার ওয়েটিং! বিশ মিনিট পরে আবার ফোন করলাম। এবারও ওয়েটিং পেলাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।

অনেকক্ষণ পর আমাকে একটা ফিরতি কল করে শীলা ধমকের সুরে বলল-রাজন, এতো রাতে ঘুমাচ্ছ না কেন? আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না কেন জানি। বললাম- এমনি, তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছিল। স্বপ্নের কথাটা আর তাকে কিছুতেই বলতে পারলাম না। আমাকে বাচ্চাদের মতো বুঝিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় শীলা যা বলল তার মানে হলো, সকালে তার অফিস আছে, এখন ঘুমাতে হবে। পরে অন্য সময় কথা বলবে। আমি কেমন আছি, কী খবর কিছুই জানতে চাইলো না। সেদিন সারাটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। কয়েকবার মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিতে গিয়েও আর দিলাম না।

পরের দিন আম্মা আমাকে নাস্তার টেবিলে বার কয়েক জিজ্ঞেস করলো, ও রাজন! বাবা, তোর কী হয়েছে? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মায়েরা সব কিছু বুঝে ফেলে হয়তো। শীলার কথা মা জানতো, আমার দিকে তাকিয়ে বলল রাজন, তুই তো জানিস। মা আবার জিজ্ঞেস করলো- বাবা, শীলার সাথে কথা হয় না? আমি মাকে মিথ্যে বললাম। একটু লজ্জা আর তোতলানো গলায় বললাম, ভালো আছে মা। এ.. এইতো কাল রাতেও কথা হলো।

আম্মা বলল, ও আচ্ছা! তুই এবার একটা ভালো চাকরি-বাকরি ধর। মেয়েটা আর কতো অপেক্ষা করবে বাবা? আমারও বয়স হয়েছে। এইবার শীলাকে ঘরে আন। বউয়ের সেবা যত্ন নিতে ইচ্ছা করে বাবা!

সেদিনই বিকাল বেলা অফিস ছুটির অনেক্ষণ আগে গিয়ে আমি শীলার জন্য অপেক্ষা করছি আর টংয়ের দোকানে চা-সিগারেট খাচ্ছি। দেখলাম, শীলা আরেকটা ছেলের সাথে হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে।

নিজের চোখকে অবিশ্বাস করলাম। দোকানীকে বিল না দিয়ে জোর পায়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম। নিজের মাথাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো কষ্ট হলো। আমার সাথে হাঁটলে শীলা যেভাবে আমার হাতের ভেতর দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাঁটতো, অবিকল সেইরকম করে নতুন ছেলেটার সাথে হাঁটছিলো। নিজেকে খুব তুচ্ছ, অপ্রয়োজনীয় মনে হলো। ভাবলাম, এই দৃশ্য না দেখার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। নিজের কাছে নিজে এর আগে এতো বেশী অপমানিত বোধ করিনি জীবনে!

সন্ধ্যা গেলো, রাত হলো, আমি সেই টংয়ের দোকানে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেলাম। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। বার কয়েক শীলাকে ফোন করলাম। সে ফোন ধরলো না। সেদিন কী মনে করে মিঠা গলিতে গিয়ে কেরু কোম্পানির একটা নিপ কিনে হাঁটা শুরু করলাম। পাগলামির চূড়ান্ত করলাম।

তখন থেকে আমার নাওয়া-খাওয়া একেবারে নিয়মহীন হয়ে পড়লো। খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমের ঠিক নেই। সারাদিন খালি সিগারেট আর চা খাই। যা হওয়ার তাই হলো। একদিন কাশির সাথে রক্ত বমি করলাম। একটুও ভয় পাইনি। বরং মনে হলো এভাবে মরে যেতে পারলে শান্তি! সপ্তাহখানেক হাসপিটালে ছিলাম। ছাড়া পাওয়ার পর শরীর ভালো হলেও মনের অসুখটা ভালো হয়নি তখনও। দিন কয়েক পরে নিয়ম করে শীলার অফিসের সামনে আবার বসে থাকতাম।

শীলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম। আমাকে দেখে প্রথম দিন শীলা ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠেছিল। ভাবখানা এমন, জীবনে আমাকে প্রথমবার দেখছে। আমি কোনো অপরিচিত আগন্তুক। জানতে পারলাম, যে ছেলেটির সাথে শীলার সম্পর্ক সে তার একই অফিসের কলিগ। দেখতে দারুণ ছেলেটা।

একদিন তাদের হাঁটার রাস্তা আগলে দাঁড়ালাম। শীলাকে বললাম, এমন তো কথা ছিলো না। কথা ছিলো, যদি কোনোদিন কেউ ছেড়ে চলে যেতে চায়, তো বলে যাবো। শীলা মুখে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান করলো। তার নতুন প্রেমিক ছেলেটা আমাকে দু’দিন শাসালো। তিন দিনের দিন আমাকে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখে ছেলেটা কাকে যেনো ফোন করলো। কিছুক্ষণ পরে ছয়-সাতজন ছেলে এসে আমার কলার ধরে কথা ছাড়াই আমাকে কয়েকটা থাপ্পড় আর কিল ঘুষি দিলো। শীলা এগিয়ে এসে আমাকে ছাড়ালো। আমার ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হয়ে গেলো।

আমি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে শীলার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তার চোখে আগের সেই মায়া নেই। রাস্তায় অপরিচিত লোকের জন্য মানুষের এর চেয়ে বেশী মায়া থাকে। আমাকে শেষ যে কথাটা সে বলে তা হলো, এর পর যদি আমাকে ডির্স্টাব করিস তোকে পুলিশে দেবো! লজ্জা-ঘৃণায় আমি পিঁপড়ার মতো ছোট হয়ে গেলাম। আত্মহননের মতো সাহস আমার ছিলো না। না হলে সেদিনই রাস্তায় গাড়ির নিচে ঢুকে পড়তাম। এরপর আর কোনোদিন তার সাথে আমার দেখা হয়নি।

একটানে কথা শেষ করে রাজন মুখ বিষণ্ন করে আমাকে বলে, এই হলো কাহিনী।

চল, এবার যার যার বাসায় যাই। আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস না করলেই মনে হয় ভালো হতো ভাবতে ভাবতে একটা গাড়ি করে রাজনকে পথে নামিয়ে দিলাম। গাড়ি চলছে, আমি ভাবছি এমন তো হওয়ার কথা না। যখন আমরা ইউনিভার্সিটি পড়তাম, কী দুর্দান্ত প্রেমই না ছিলো তাদের দু’জনের। আমার দেখা অনেক অনেক-প্রেমিক জুটি ছিলো। কিন্তু তারা অন্য সবার চেয়ে আলাদা ছিলো। শীলা-রাজনের বাসাতে সবাই জানতো তাদের সম্পর্কের কথা। কোনো উপলক্ষে আমরা বন্ধুরা যখন মদ খেতাম, শীলা আমাকে ফোন করে বলে দিতো শোন, রাজনকে কিন্তু বেশী দিবি না। বেশী খেলে ওর শরীর খারাপ করবে।

একবার রাজনের বাসায় বন্ধুরা সবাই একসাথে বেড়াতে গেলাম। শীলা সেবার আমাদের সাথে বসার ঘরে আড্ডা না দিয়ে রাজনের মায়ের সাথে রান্না ঘরে কাজে সাহায্য করছিল, আর কী সব যেনো আলাপ করছিল। থেমে থেমে হাসির শব্দে আমি আগ্রহী হয়ে উঁকি দিয়েছিলাম। শীলা আর রাজনের মায়ের সেই অদ্ভুত সুখের দৃশ্য আমার এখনও স্বচ্ছ ছবির মতো মনে পড়ে।

আরেকবার শীলার বাসায় বেড়াতে গেলে, শীলার ইমিডিয়েট ছোটবোন রাজনকে দুলাভাই-দুলাভাই বলে খুনসুঁটি করার কথাও আমি এখনও মনে করতে পারি। আমাদেরই এক বন্ধু রউফ, সেই ভাবি শালিকার মন পাওয়ার আশায় রাজন আর শীলার পিছনে ঘুর ঘুর করতো।

হাতখরচের জন্য শীলাকে আমি অনেকবার জোর করে টাকা গুঁজে দিতে দেখেছি রাজনের পকেটে। এমনকি রাজনের গানের দল শুরু করার জন্য প্রথম যে স্প্যানিশ গিটার সেটাও শীলারই কিনে দেওয়া। আমাদের বন্ধুদের একটা মেসঘর ছিলো। সেই মেসঘরে শীলা-রাজন একা একা কতো দিন কতো দুপুর একসাথে কাটিয়েছে। এক সাথে তাদের রুম থেকে বের হতে দেখে বন্ধুদের একজন একদিন তো অশ্লীল মজা করে বলেই ফেলেছিলো- হায়রে! খালে আর পানি নাইরে, পানি নাই। সেদিন লজ্জায় শীলার গাল লাল হতে আমি নিজেও দেখেছি। আমি বাসায় ফিরে গেলাম।

এখনও মাঝে মাঝে রাজনের সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। একবার দেখা হলো বড়পুল মোড়ে। এখানে কী যেনো একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে সে। চা খেতে বললাম। রাজি হলো না। মনে হয় আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলো। বললাম- বিয়ে করেছিস? মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে সে বলে, বিয়ে-টিয়ে আমার হবে না। আমি যেমন আছি, ভালোই আছি।

আরেকবার দেখা হলো প্রেসক্লাবের নিচে বাতিঘরের সামনে। সেবারও তার সাথে আরেকটা নতুন মেয়ে। দু’জনে কথা বলছিল। আমি নিজ থেকে গিয়ে কথা বললাম। মেয়েটাকে বিদায় করে সে আমার সাথে কথা বলে। দেখে মনে হচ্ছিল অনেক তাড়া তার।

খবর কী জিজ্ঞেস করলাম। বলল, চাকরি চলে গেছে। মার্কেটিংয়ের চাকরি, টার্গেট ফুল হয়নি, তাই ছাঁটাই। আমাকে একটা চাকরি হবে কিনা জিজ্ঞেস করলো। আমি তাকে নিছক মজা করার জন্যই বললাম, আচ্ছা তুই কী সব মেয়ের মাঝেই শীলাকে খুঁজে বেড়াস নাকি? একেক দিন একেক মেয়ের সাথে দেখছি কিনা। অবাক হয়ে আমার চোখে তাকিয়ে কিছু না বলেই সে হন হন করে হেঁটে চলে গেলো। এইবার রাজনকে দেখে আগের চেয়ে অনেক বিষণ্ন ও উদ্ভ্রান্ত মনে হলো। এরপর আর এ যাবত রাজনের সাথে আমার দেখা নেই।

কয়েক মাস পর আমি একটা কাজে আগ্রাবাদের একটা ব্যাংকে গেলাম। বিশাল লাইন দেখে হতাশ আমি। আমাকে অবাক করে দিয়ে হাই হিল পায়ে এক শাড়ি পরা নারী এগিয়ে এলো। দেখলাম, শীলা মুখ টিপে হাসছে। সে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো- কিরে, কী খবর?

আমি ভালো আছি, জানালাম। এরপর আমাকে নিয়ে তার নিজের টেবিলের সামনে বসিয়ে কফি খাওয়ালো। মাঝে বেল টিপে একজন জুনিয়রকে আমার কাজ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমার ভালো-মন্দ খবর নিলো। ছেলে মেয়ে কয়জন, কী করছি এইসব। আমিও তার মতো একই ধরনের প্রশ্ন করলাম। সে খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, আগে অন্য শাখায় ছিলো, নতুন জয়েন করেছে এখানে। মোবাইল ফোন বের করে তার হাসব্যান্ড আর একটা ফুটফুটে বাচ্চার ছবি দেখালো। বুঝলাম, এইটা তার ছেলে। আমাকে বলল, যা দুষ্টু হইছে জানিস! সারাক্ষণ শুধু অস্থির করে রাখে। আমার ধ্যান-জ্ঞান এখন আমার ছেলে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছবিটা কোন জায়গার? সে মুখে সুখের হাসি ফুটিয়ে বলে- পাতায়া, থাইল্যান্ড। এইতো মাস দু’য়েক আগেই গেলাম।

কফিতে চুমুক দিয়ে একবার আমার রাজনের কথা মনে এলো। ভান করে তার কথা তুলবো ভাবছিলাম, কিন্তু পারলাম না। কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম-

আচ্ছা- তোর ছেলের নাম কী? শীলা এতোক্ষণ কলম নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছিলো। আমার প্রশ্ন শুনে সে এবার একটু থেমে গেলো। এতোক্ষণ যে স্বাভাবিকতা তার ভেতর ছিলো তা যেনো উবে গেলো আমার কথায়। আমি আবার বললাম, মানে ছেলের কী নাম জিজ্ঞেস করছি।

শীলার চোখের কোণায় কিসের একটা দুঃখ লুকিয়েই ছিলো মনে হয়। স্পষ্ট উচ্চারণে পরপর দুবার সে বলে, “শিহাব মোহাম্মদ রাজন”, “শিহাব মোহাম্মদ রাজন”। আমি বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম।

বন্ধু রাজনের সাথে আমার অনেক দিন দেখা হয় না। দেখা হলেই তাকে এই কথাটা বলতে হবে। কী উপকার হবে জানি না, তবে খবরটা দেওয়ার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৮
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।