সেই শামীমুল হক শামীম ঢাকায় এলেন ‘অনিকেত শামীম’ হয়ে! চাকরির পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা, লোকপত্রিকা প্রকাশ, লোকসাহিত্য পুরস্কার, লেখক অভিধান প্রকাশ, লিটলম্যাগ আন্দোলন- বিবিধ কার্যক্রমের ডেরা পাতলেন শাহবাগ আজিজ মার্কেটের দোতলায়। আমার অফিস তিনতলায়।
আসল অফিস শেষ করে প্রায় প্রতিদিন সান্ধ্যঅফিস জমাতেন লোক’র কার্যালয়ে। যেনো মৌচাক, ঘিরে থাকতো তরুণেরা। ছফা ভাইয়ের উত্থান পর্বে আড্ডা বসতো কিছুটা বয়স্কদের, আমার স্বরব্যঞ্জনে আসতো প্রায় সব বয়সের লেখক আর ‘লোক’ উঠতি আর তরুণ লেখকদের আড্ডাসর বসতো। অনেকেই ছুটে আসতো ঢাকার বাইরে থেকে!
শামীমকে দেখছি, নব্বই দশক থেকে কবি এবং সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে। নিরলসভাবে নীরবে, নিভৃতে বহুমাত্রিক কাজ করে যাচ্ছেন। আর তা শুধু নিজের জন্য নয়; বন্ধুদের জন্য, সবার জন্য।
শামীমের এই সার্বজনীনতা নিয়ে লিখেছিলাম- ‘বিজয় দিবসে লেখকদের জন্য একটি বিজয় সংবাদে মনটা নেচে উঠলো। গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রায় ৩০ একর জমির ওপর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো ১০৩ জন কবি-সাহিত্যিকের জন্য ‘লেখক পল্লী’! স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দীতেও কেউ এ কাজটি করেননি। সবাই ব্যক্তিগতভাবে নিজের স্বার্থে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন, কিন্তু কেউ সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেননি। এবার বিরল ভূমিকায় দৃষ্টান্ত রাখলেন কবি অনিকেত শামীম। লেখক পল্লী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা শামীমকে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ’।
২]
অনিকেত শামীমের কবিতা কেমন? শামীম সহজ-সরল মানুষ এবং তার কবিতাও সহজ-সরল। জটিলতা নেই। তিনি দেখেন স্বচ্ছ দৃষ্টিতে- ‘শস্য কাটা হয়ে গেলে পড়ে থাকে হাহাকার’। একটু বাড়িয়ে বললে, বলা যায় জীবননান্দ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। যেমন, ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে,-হেমন্তের মাঠে– মাঠে ঝরে, শুধু শিশিরের জল;...ধানক্ষেতে– মাঠে, জমিছে ধোঁয়াটে, ধারালো কুয়াশা’! শামীমের ‘হাহাকারের’ মধ্যেই লুকিয়ে আছে- শিশির, বাঁশপাতা, মরাঘাস, মেটে ইঁদুর, ধোঁয়াটে কুয়াশা!
আবার, ঋতুকন্যা হৈমন্তীর প্রেমে হাবুডুবু খায় পুরো প্রকৃতি। কবির চোখে হেমন্ত অসাধারণ। কিন্তু জীবনানন্দীয় হেমন্ত আর শামীমীয় হেমন্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন, ব্যতিক্রম:
‘হেমন্তের পাখি ডানা ঝাপটায়
অবেলায়
পাখি উৎসব আজ!
...স্ফূর্তিতে মেতে উঠি আমিও
ছোট্ট ঘরে আজ পাখি উৎসব।
...পাখি বড় হারামি
তাদের সঙ্গে সখ্য গড়তে নেই
শীত শেষে যে-যার মতো চলে যায়’!
এই বেদনা বুকে নিয়ে শামীম খুঁজে পান- ‘ইতিহাসের ঘুনপোকা’, ‘অন্ধ বালকের প্রতি ঈর্ষার দৃষ্টিতে আকাশে তাকিয়ে দেখেন রক্তমেঘ, মেঘপুঞ্জ। এভাবেই তিনি বেদনা ছড়িয়ে দেন ইতিহাসে, আকাশে, বাতাসে।
তাই তিনি বলেন- ‘ঐ যে দূরে শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি, আমার হৃদয়ে নূপুরের নিক্কন হয়ে বাজে। চুপি চুপি কথা বলি শুকনো পাতার সঙ্গে। আমি একা হয়ে যাই। দীর্ঘ শীতনিদ্রা আমাকে আমূল বদলে দেয়। আরও একটি শীতনিদ্রার জন্য দীর্ঘ দীর্ঘ প্রস্তুতি’...
শামীমের কবিতায় সরলতা প্রকাশ পায় সরল রেখার মতো। তাই তিনি জীবনের জ্যামিতিতে চক্র, বক্র বা বৃত্তবিরোধী। যেমন,
‘তুমি যে বৃত্তটি আঁকছো তা হচ্ছে এককেন্দ্রিক
একই পথে যাওয়া-আসা
জীবনের জন্য চাই বহুমাত্রিকতা
......
বৃত্ত আঁকতে আঁকতে তোমাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মহাবৃত্ত’।
মানুষের পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকে ছায়া। ছায়া এক অদ্ভুত ভৌতিক ব্যাপার। দেহ থেকে প্রাণ উড়াল দিয়েও ছায়া থাকে যায় শরীরের সঙ্গে! এ যেনো এক মায়াজাদুর খেলা। শামীমের কবিতায় সেই ছায়া এসেছে এভাবে:
‘দীর্ঘ হতে হতে ক্রমশ ছোট হয়ে আসে
দু’টি ছায়া। আবারও দীর্ঘ হয়...
অনন্তকাল ধরে এই পথহাঁটা শেষ হয় না।
আর কতদূর যাবো আমরা, কতদূর?’
শামীমের গন্তব্য অনেক দূর, দিগন্তে। এবং তার দৃষ্টিও সুদূরপ্রসারী। এই মুখোশ, মাকাল ফল, নষ্ট পচা ‘হেরোইন সময়’ অতিক্রম করে তিনি দেখতে পান-
‘হাসির উলটোপিঠেই ক্রোধ
সব সুন্দরই সৌন্দর্য নয়
এর পরেও কিছু কথা থেকে যায়। ’
তাই শামীম আশাবাদী। অতীত অথবা বর্তমানের চেয়ে আগামী দিনের স্বপ্নবীজ বপন করেন তিনি। তার দৃষ্টান্ত ‘নব্বই দশক’ কবিতা। অত্যন্ত প্রতীকী অর্থে সব দশকে উড়িয়ে দিয়ে নিজের নব্বই দশকের জয়গান গান উপস্থাপন করেন:
‘ষাটের ঝলকানো চমক
অচল মুদ্রার মতো পড়ে থাকে
প্রথাবৃত্তে ঘুরপাক প্রাক-আশি
যেন মধ্যমাঠে পড়ে থাকা পিনাদ্ধ যন্ত্রণা।
আমাদের কিংবদন্তির মাইলস্টোন
ত্রিশের মহাদিকচক্রবাল আভা
পঞ্চপাণ্ডবের মেধাবী বাঁশির সুর
এঁকেবেঁকে ভেসে
থমকে দাঁড়ায় নোতুন মোড়ে...
...নব্বইয়ের অনিন্দ্য শিল্পের মহিমায়। ’
৩]
এই কবি ঝরা জীর্ণ, পুরনোকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি তারুণ্যের পতাকা বহন করেন, তুলে ধরেন তারুণ্যের বিজয়! শামীমের আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তার তারুণ্যের রিলে রেসের কাঠি তুলে দেবেন আরেক নতুন প্রজন্মের কাছে। এভাবেই এগিয়ে যাক আমাদের বাংলা কবিতা!
বাংলাদেশ সময়: ১২৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৮
এএ