ভাষা আন্দোলনের ৬৬তম বছর চলেছে যখন, তখন একজন মন্ত্রীকে বলতে হলো, তাঁর মন্ত্রণালয়ে যেন বাংলায় চিঠিপত্র পাঠানো হয়। আরেকজনকে বেতারসহ নানা মিডিয়ায় বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধের সঙ্কল্প প্রকাশ করতে হলো।
বিশ্বায়ন ও দ্রুততর যোগাযোগের এই বিশ্বে অন্য ভাষা শিখতে কেউ নিষেধ করছে না। কিন্তু মাতৃভাষাটিকে ভালোভাবে না শিখে কিংবা মাতৃভাষাকে নানা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে বিকৃত করে ফেলে এগিয়ে চলাটা একবারেই ভুল একটা পথ। এই পথে শিক্ষা বা উন্নতি হবে বলে যারা ভাবেন, তাদের অবস্থান বোকার স্বর্গে।
কারণ, বিকৃতি বা অশুদ্ধতা বা ভাষার জগাখিচুড়ির মধ্য দিয়ে প্রদেয় শিক্ষার ফলে কোনও ভাষার প্রতিই সুবিচার হয় না। এতে মুখে এক ধরনের লাগামছাড়া কথ্য বুলি ফোটে বটে, কাজের কাজ বা চিন্তা-বিশ্লেষণের ক্ষমতা জন্মায় না। সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এইসব শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে সফলতা দূরআস্ত, জায়গাই পায় না।
অতি-উৎসাহী অভিভাবকরা অতি-উচ্চাশার ফলে সন্তানদের এক লাফে সবজান্তা-পণ্ডিত বানাতে গিয়ে এমন বিপদ ঘটান। মতলববাজ কিছু শিক্ষা-ব্যবসায়ী সুযোগটিকে কাজে লাগায়। সুপরিকল্পিত সিলেবাস অনুযায়ী না চলে পাবলিক স্কুল, গ্রামার স্কুল নাম দিয়ে একটি আলগা চমক বা আকস্মিক বাহবা দেখিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়। মৌলিক ভাষাশিক্ষাটি থেকে যায় সুদূরপরাহত।
দ্বিতীয় আরেকটি বিপদ আসে টিভি-রেডিও’র কারণে। বাচ্চারা কানে যা প্রবেশ করছে, সেটাকে আসল ও আদর্শ ভাষা বলে ধরে নিচ্ছে। খিস্তি-খেউড়, বিকৃত প্রকাশ, নানা ভাষার অসামঞ্জস্যপূর্ণ মিশ্রণ তাদের মগজে আশ্রয় পাচ্ছে। বিশুদ্ধ ভাষাপ্রবাহ থেকে যাচ্ছে নব প্রজন্মের অধরা।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন, বাংলা একাডেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন মারাত্মক ভুল করেও ভাষার বিপদ বাড়াচ্ছে। বাংলানিউজেই মৌলভীবাজার এলাকার কথিত এক লেখকের বিকৃত তথ্য সম্বলিত পুস্তক নানা স্কুলেপাঠ্য করার বিষয়ে সিরিজ লেখা বের হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভুল তথ্যপূর্ণ বই নিয়ে রিপোর্ট এসেছে। মুক্তিযুদ্ধসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ে ভুল, বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বই প্রকাশের খবর প্রায়শই মিডিয়ায় আসে। ফলে ভাষাচর্চা ও ভাষাশিক্ষা নিয়ে আশার বদলে হতাশাই বাড়ছে।
ভাষার মাসে বইমেলার আয়োজনের পেছনে মূল লক্ষ্য ভাষার সমৃদ্ধি হলেও বাণিজ্যিক মতলবই প্রকট হচ্ছে। বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্য, গল্প, কবিতা, জ্ঞানগর্ভ পুস্তকের অনুবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে না। বাংলা ভাষাকে বৈশ্বিক ভাষার মণি-মাণিক্য দিয়ে সমৃদ্ধও করা যাচ্ছে না। এর বদলে বের হচ্ছে চটকদার নানা বই।
প্রকাশিত বইগুলোও সুলিখিত, সুসম্পাদিত নয়। তথ্য ও বানানের ভুল থাকছে। বাক্য গঠন ও শব্দ প্রয়োগের ক্রুটিও চোখে পড়ছে। বইমেলার আগে স্রোতের মতো বই বের করে লেখক হতে গিয়ে গুণগত বা ব্যকরণগত মান বজায় রাখা হচ্ছে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, গুণ ও মান নিরূপণের আদৌ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে অজস্র ফ্রি-স্টাইল প্রকাশনা থেকে ভাষার উপকারের চেয়ে বিপদই বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিপদের প্রধান কারণ এটাই যে, ভাষার দুর্বলতা মানুষের বোধ, উপলব্ধি, চিন্তা ও গ্রহণশক্তিকে ক্ষুণ্ন করে। ভাষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দুর্বলতা যখন সমষ্টিগত দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সামাজিক কোনও চিন্তায় বা নীতি-নির্ধারণে গোষ্ঠীগত বা জাতিগত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তখন সেই সমাজের জন্য তা ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে দেখা দেয়। কারণ, চিন্তন-ক্ষমতার দুর্বলতা সমাজের যুক্তি ও বিশ্লেষণকে ভোঁতা করে ফেলে এবং অবনতি ও অবক্ষয়ের কারণ হয়। যার শেষ পরিণতি স্থবিরতা ও ধ্বংসাত্মক ধারা।
অতএব, ভাষা ও ভাষাশিক্ষা নিয়ে হেলাফেলা বা দায়িত্বহীনতা মোটেও কাম্য হতে পারে না। কারণ, মানুষ হিসাবে আমাদের সার্থকতার বহুলাংশই নির্ভর করছে ভাষার ওপরে। ভাষার মাসে এবং সারা বছরই মাতৃভাষা নিয়ে হতাশা কাটিয়ে আশা জাগাতেই হবে
বাংলাদেশ সময়:১১৫০ ঘণ্টা, ২০১৮,২০১৮
এমপি / জেএম