বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা যখন প্রায়-অসম্ভব, তখন, ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ‘যাত্রা’ নামের উপন্যাসের লেখকের এই মহাযাত্রা নিঃসন্দেহে বেদনার।
দীর্ঘদিন অসুস্থতা ও শেষ পর্যায়ে চেতনাহীন অবস্থায় শওকত আলী পরিণত বয়সেই মৃত্যুকে বরণ করেছেন।
বিভাগ-পূর্ব বাংলার উত্তরবঙ্গে জন্ম গ্রহণকারী শওকত আলী দেশভাগ ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে মূর্ত করেছেন তাঁর রচনায়। উত্তর জনপদের ভাষা ও বিষয়কে যেমন স্থান দিয়েছেন, তেমনিভাবে মধ্যবিত্তের সঙ্কটাপন্ন-দোদুল্যমান চেতনালোককেও ছুঁয়ে গেছেন বেগবান কলমের আখরে। মূলত ত্রয়ী উপন্যাস ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ ও ‘পূর্বদিন পূর্বরাত্রি’ রচনা করে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তাঁর আরেক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। অনেক অপ্রকাশিত লেখা ছাড়াও শওকত আলীর ৩২টি উপন্যাস ও ৫টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
শওকত আলীর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘যাত্রা’ মুক্তিযুদ্ধের পরপরই রচিত হলেও প্রকাশ পায় ১৯৭৬ সালে। ১৯৭১ সালের শুরুর দিককার ঘটনাকে আশ্রয় করে লেখা উপন্যাসে তিনি ২৫শে মার্চের বর্বরোচিত হামলার ফলে ঢাকায়-সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়কে চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন। পাকিস্তানি নৃশংসতা ও নির্মমতার ভাষ্যচিত্র বলা যায় শওকত আলীর ‘যাত্রা’ উপন্যাসকে।
কাহিনির মূলে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা শহর ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছে নানা দিকে। বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে নৌকা করেও নিজস্ব শহর ছেড়ে সরে পড়ছে উপদ্রুত মানুষ। আদিঅন্তহীন যাত্রাপথে কেউই জানে না, তারা কোথায় যাবে! অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে ধাবমান সেই জনস্রোতে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান সপরিবারে যুক্ত হয়েছেন। আক্রান্ত ঢাকা শহরে অধ্যাপক তাঁর স্ত্রী বিনু ও দুই সন্তান নিয়ে দুইদিন আত্মগোপনে থেকে অবশেষে জনস্রোতে ভেসে নদী পেরিয়ে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশে আশ্রয় নিয়েছেন অচেনা এক গ্রামের স্কুলঘরে।
অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী লীলা, ইকবাল হলে প্রতিরোধ করতে গিয়ে আহত ছাত্র হাসান, সখিনা, ফার্নান্ডেজসহ অনেকেই এসে আশ্রয় নিয়েছেন দুঃসহ স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে। যুদ্ধকালীন নিপীড়নের প্রভাব জনজীবনে কী ভয়াবহ আঘাত হানে, সেই চালচিত্রটিই ফ্রেমবন্দি করেছেন তিনি ‘যাত্রা’ উপন্যাসে: “দূরে সারা বাংলাদেশ জুড়ে তখন হত্যা আর অত্যাচার। হয়তো অন্য কোন গ্রামের আকাশে তখন ঘর জ্বালানো আগুনের শিখা আকাশমুখী লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে কিংবা কে জানে, হয়তো আরেক শহরের আকাশে ধবল জোসনা, নীল তারা আর দক্ষিণের বাতাস আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ”
‘যাত্রা’ উপন্যাসে ঢাকা শহর, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত গণহত্যা, প্রাথমিক প্রতিরোধ, স্বাধীনতার স্পৃহা ইত্যাদি বাস্তবতা ধরা আছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক আঘাত ও প্রত্যাঘাতের সলতে পাকানোর প্রহরগুলো ফুটে উঠেছে। আক্রান্ত অথচ মুক্তিকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার যথার্থ প্রতিফলন বলা যায় শওকত আলীর ‘যাত্রা’ উপন্যাসকে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উপন্যাসের মূল সম্পদ, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালের বিরুদ্ধ পরিবেশে ১৯৭১-এর সংগ্রামী ঘটনাপ্রবাহের পুনরুচ্চারণ। একজন কমিটেড ও জনমুখী লেখকের দায় থেকেই তিনি বিস্মৃতির ঘেরাটোপে বন্দি মুক্তিযুদ্ধ নামের মহত্তম প্রপঞ্চকে উপন্যাসের আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন।
শুধু উপস্থাপনের সাহসিকতাই নয়, তিনি পাকিস্তানি আক্রমণের মধ্যেও বিজয়ের সুপ্ত স্বপ্নটিকে অঙ্কন করেছেন তাঁর নির্মিত চরিত্রের মাধ্যমে: “জখম শরীর, এক হাতে রাইফেল, জানালা দিয়ে দেখতে পায় নদীর ওপারে, দিগন্তরেখার কাছে তখনও তুমুল গুলি হচ্ছে, গ্রাম জ্বলছে, হাট জ্বলছে, খামার বাড়ি জ্বলে যাচ্ছে। দু’জনেই দেখতে পায় লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবং আত্মচিৎকারময় আকাশের ওপারে সূর্যোদয় হচ্ছে। ”
অবরুদ্ধ ও আক্রান্ত সময়ে নতুন সূর্যের উদয়ের প্রতীক দিয়ে বিজয়ের স্বপ্ন-দেখা কথাকার শওকত আলীর মৃত্যু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৭ ঘণ্টা, জানুযারি ২৫, ২০১৮
এমপি / জেএম