অবেশেষে কাগজে গল্পটা ছাপা হলো। সেখান থেকে লেখার সম্মানি বাবদ ১৫ টাকা দেওয়া হলে বন্ধুদের নিয়েই উড়িয়ে দেন টাকাটা।
‘আমার জীবন আমার রচনা’ শিরোনামে শনিবার (১ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত হয় সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে এপার বাংলার লেখক-পাঠকদের আলাপচারিতা। প্রকাশনা সংস্থা বাতিঘরের আয়োজনে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অষ্টম তলায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে নিজের সম্পর্কে বলেছেন পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার।
আলাপচারিতায় গল্পকথক সমরেশ মজুমদার আড্ডার ছলে শোনালেন জীবনের চরম বাস্তবতার কথা। রসিকতা করলেন বন্ধুর মতো। আলাপনে তিনি মানবজীবন ও সাহিত্যকে এক সুতোয় গেঁথে দিলেন অনন্যতায়।
শুরুতেই সমরেশ শোনালেন তার জীবনের কঠিন বাস্তবতার কথা। বলেন, ‘দুই বছর আগে লেখালেখি শেষ করে রাতে ঘুমাতে যাই। এর পর যখন ঘুম ভাঙে, তখন নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের বিছানায়। যখন আমার স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায়। কোনকিছুই মনে করতে পারছিলাম না। চিকিৎসকরা জানালেন, আমি আমার সবকিছুই ভুলে গেছি। এমনকি আমার নিজের নামটাও। ’
এতটুকু বলে একটু থামলেন। আবার শুরু করলেন কথা বলা, ‘বাসায় ফেরার পরে আমার হাতে ‘বর্ণপরিচয়’ বই এবং একটি স্লেট তুলে দেওয়া হয়। যাতে আমি নতুন করে অ আ এবং এ বি সি শিখতে শুরু করলাম। প্রথমেই নিজের নাম মনে পড়লো। এর পর আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়তে শুরু করলো। ’
তিনি আর লিখতে পারবেন না বলেও জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তাদের সে শঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে সমরেশ মজুমদার আবারও লিখতেন শুরু করেন। কিভাবে শুরু করলেন লেখক হিসেবে তার দ্বিতীয় জীবন?
বহুমাত্রিক এ লেখক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি ফুলস্কেপ কাগজে প্রতিটি লাইনে ১২টি করে শব্দ লিখতাম। অসুস্থতার পরে যখন লেখা শুরু করি, তখন ৮ থেকে ১০ শব্দ করে ছয় লাইনের বেশি লিখতে পারিনি। আস্তে আস্তে লাইনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অসুস্থ হওয়ার আগে আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যায় আমার একটি উপন্যাস লেখার কথা ছিলো। অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া সেই উপন্যাসটি দিয়েই আমি আবার পাঠকদের কাছে ফিরে আসি। এখন আর কষ্ট হয় না লেখার সময়। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আমি এখন দেশ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি। ’
দীর্ঘ এই আড্ডায় বারবার উঠে আসে তার উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ প্রসঙ্গ। উপন্যাসত্রয়ী নিয়ে তিনি বলেন, ‘এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লিখিনি। বলা যেতে পারে, বাধ্য হয়েই লিখেছি। উত্তরাধিকার প্রকাশের পর পাঠকদের আগ্রহের জের ধরে প্রকাশক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে বাকি দুই পর্ব লেখা হয়। ’
উঠে আসে ‘সাতকাহনে’র দীপাবলির কথাও। এ প্রসঙ্গে ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার পাওয়া এ লেখক বলেন, ‘আমার বাড়ির পাশে বারো বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের দিন সকালে সে আমার হাত ধরে বলেছিলো, কাকু, আমাকে বাঁচাও। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন মেয়েটির বিয়ে ঠেকাতে পারিনি। তবে বিয়ের আটদিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে এসে আমাকে বলেছিলো, কাকু, আমি বেঁচে গেলাম। এখান থেকে দীপাবলি চরিত্রটি তৈরি হয়। ’
দীপাবলি চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে সমরেশ মজুমদার বলেন, ‘আমরা পুরুষরা মেয়েদের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করি। কিন্তু দীপাবলি সে ধরনের মেয়ে না। কোন পুরুষই তাকে স্ত্রী হিসেবে চায় না। আর মেয়েরা তাকে জীবনের আদর্শ মনে করে। এটাই এ চরিত্রের সার্থকতা। ’
নিজেকে শুধু গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি সমরেশ মজুমদার। ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী থেকে কিশোর উপন্যাস লেখনীতেও তার জুড়ি মেলা ভার। সমরেশ মজুমদারের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ উল্লেখযোগ্য। তবে এ আলাপচারিতায় শুধু নিজের লেখা বা গল্প নয়, তিনি জানালেন তার স্বপ্নের কথাও।
বাংলা ভাষার অন্যতম পাঠকপ্রিয় লেখক হিসেবে পাঠকমন জয় করা এ লেখক বলেন, ‘ত্রিশ বছর ধরে একটি উপন্যাস লেখার কথা ভাবছি। যেটি শুরু হবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বিকেল থেকে। যখন ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হলো। আর শেষ হবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের বিকেলে। এ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির অভ্যুত্থানের গল্প শোনাতে চাই। একই সঙ্গে দেশভাগ ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে এক করে একটি আখ্যান রচনা করতে চাই। ’
এক পাঠক জানতে চাইলেন আত্মজীবনী প্রসঙ্গে। তিনি জানান, আত্মজীবনী লিখলে ঘরে এবং বাইরে শত্রু তৈরি হবে। তার দ্বারা এ ‘কু-কার্য’ হবে না বলেও জানালেন সমরেশ মজুমদার।
প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের বাতিঘর; পুরোটা পরিপূর্ণ হয়ে যায় অনুষ্ঠান শুরুর আধাঘণ্টা আগে থেকেই। যত মানুষ ভেতরে ছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ ফিরে গেছেন জায়গা না পেয়ে। মানুষের এ ঢলে আপ্লুত সমরেশ মজুমদার জানালেন মুগ্ধতার কথা। বললেন, ‘আপ্লুত বললেও বোধহয় কম বলা হবে। এখানে এসে, এত মানুষের মুখোমুখি বসে যেন নতুন এক জীবন খুঁজে পেলাম। ’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার ইতিহাস চেতনার পাশাপাশি সমাজ ও জীবন বাস্তবতার অনন্য মিশেলে বাংলাসাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য সব সাহিত্যসৃষ্টি। পেয়েছেন খ্যাতি; অপরিমেয় ভালোবাসা-শ্রদ্ধা, হয়েছেন-বাংলাসাহিত্যের এক নন্দিত লেখক।
অনুষ্ঠানে সবাইকে স্বাগত জানান বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাস। উপস্থিত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। সবশেষে তিনি বলেন, ‘ঔপনাসিকরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী। তারা কোটি কোটি পৃষ্ঠাজুড়ে যা লেখেন, তার একটিও সত্য নয়। কিন্তু এর ভেতরটা সত্য, স্বপ্ন সত্য। যার প্রমাণ সমরেশ মজুমদার ও তার ভক্তরা। ’
বাংলাদেশ সময়: ২১১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৮
এইচএমএস/এমজেএফ