এ উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া কমপ্লেক্সে বাংলানিউজ কার্যালয়ে জুয়েল মাজহারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসে ঐহিক প্রতিনিধি দল।
এ দলে ছিলেন- ঐহিকের প্রধান সম্পাদক তমাল রায়, ‘ঐহিক বাংলাদেশ’র সম্পাদক কবি মেঘ অদিতি ও পশ্চিমবঙ্গের কবি সুব্রত সরকার।
প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাংলানিউজ কার্যালয়েই দীর্ঘ এক সাহিত্যআড্ডায় মেতে ওঠেন তারা। এ পর্বে জুয়েল মাজহার, সুব্রত সরকার, তমাল রায়, মেঘ অদিতির সঙ্গে যোগ দেন বাংলানিউজের ইংরেজি বিভাগের আউটপুট এডিটর এসএম সালাউদ্দিন, কালের কণ্ঠের সাহিত্য সম্পাদক কবি মাসুদ হাসান ও বাংলানিউজের নিউজরুম এডিটর কবি হিজল জোবায়ের।
আড্ডাপর্বের বিভিন্ন মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেন বাংলানিউজের ফটো করেসপন্ডেন্ট রাজীন চৌধুরী।
বাইরে তখন দুপুর ঢলে পড়ছিল বিকেলের দিকে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, দেশভাগ, রাজনীতি, বিভেদ সম্প্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা অজস্র বিষয় নিয়ে কবিরা কথার ফুলঝুরি ছোটাতে থাকেন। বাগ্মিতা ও পাণ্ডিত্যে আড্ডার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন জুয়েল মাজহার ও সুব্রত সরকার।
বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার সাহিত্য সমাজের পারস্পরিক অপরিচয়ের দূরত্ব নিয়ে কথা তোলেন কবি সুব্রত সরকার। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় বাংলা ভাষার অপরাপর সাহিত্য পড়তে গেলে যে কারোরই শুরুতে কিছুটা অপরিচয়ের দূরত্ব তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে আসলে প্রত্যেক অঞ্চলের সাহিত্যকে তার নিজস্ব জীবনাচার, রাজনীতি ও সংস্কৃতি দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে অপরিচয়ের দূরত্ব ঘোচানো যাবে না। বাংলাদেশ, আসাম বা ত্রিপুরার সাহিত্য পড়তে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ লেখকেরই সম্ভবত সচরাচর এমন দূরত্ব বোধ হয়ে থাকে।
কোনো অঞ্চলের সাহিত্যকে বুঝতে হলে তার নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যাপারে বোঝাপড়া থাকা উচিত, এ প্রসঙ্গে ঐক্য পোষণ করলেও, অপরাপর অঞ্চলের বাংলা সাহিত্যের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সমাজের অপরিচয়ের দুরত্ব প্রসঙ্গে দ্বিমত করেন জুয়েল মাজহার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি মেল্টিং পট। আমরা সব অঞ্চলের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা অন্য অঞ্চলের সাহিত্যিকরা ততোটা আন্তরিকতা বোধ করেন না। এটিকে কিছুটা উন্নাসিকতা হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা সব অঞ্চলের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত খোঁজখবর রাখেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ সাহিত্যিককেই চেনেন না। এর কারণ হিসেবে কেবল ভৌগোলিক দূরত্বকে আমলে নিতে নারাজ জুয়েল মাজহার। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সমাজ ও পাঠকদের আরও বেশি করে বাংলাদেশের সাহিত্যের ব্যাপারে আন্তরিক ও মনযোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আড্ডার এক পর্যায়ে উপমহাদেশব্যাপী সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা, বিদ্বেষসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রবণতার প্রসঙ্গ ওঠে। সমাজ ও রাষ্ট্রে এসব ঠেকাতে নিজেদের অতীত ইতিহাস ও সংস্কৃতির পাঠ প্রয়োজন বলে মনে করেন আড্ডারুরা। বৃহৎ বঙ্গ বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্মিলনে গড়ে ওঠা। প্রত্যেক ধর্ম সংস্কৃতির কাছেই এ জনপদের মানুষের ঋণ রয়েছে। ফলে চাই পারস্পরিক সহনশীলতা। বাংলার মানুষ অন্তর্গতভাবে কখনোই সাম্প্রদায়িক নয়। এরা মূলত বাউলস্বভাবী, মিশুক ও আন্তরিক। সেই চেতনা বারবার পুনরাবিষ্কারেরে মধ্য দিয়েই এ অঞ্চলের মানুষ মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। বর্তমান প্রজন্ম না হলেও আগামীর প্রজন্ম সে সুফল ভোগ করবে।
সুব্রত সরকার বলেন, আমার মতে এখানকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী বৌদ্ধের অহিংস মতবাদের বীজমন্ত্রে দীক্ষিত।
জুয়েল মাজহার বলেন, এখানকার মানুষ যেমন বাউলস্বভাবী, তেমনি প্রয়োজনে একজোট হয়ে শত্রুপক্ষকে প্রতিরোধেও তারা সিদ্ধহস্ত। এখানকার মানুষ অনন্ত রক্তবীজের ঝাড়। গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের বাহিনীও গঙ্গারেডি জনপদে আক্রমণের সাহস করেননি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মূলত একটিই ভূখণ্ড। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার আফিমে এখানকার মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। ইংরেজ উপনিবেশ ও ৪৭-এর দেশভাগ এ অঞ্চলে এই আফিমকে আরও বড় আকারে ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলা ভাগ হওয়ার ব্যাপারটিকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত বলে উল্লেখ করেন কবিরা।
এ প্রসঙ্গে তমাল রায় বলেন, দুই বাংলা বিভক্ত হলেও আমরা মনে করি শিল্প-সাহিত্যের কোনো কাঁটাতার নেই। শিল্পীসাহিত্যিকরাই রাষ্ট্রীয় কাঁটাতারের বাইরে দুই বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরস্পরের আরও নিকটবর্তী করতে পারে। ধরে রাখতে পারে মৈত্রীভাব।
আলাপে আলাপে বেলা বাড়তে থাকে। বাইরে হেমন্ত বিকেলের শেষ রোদ চোখে পড়ে। এবারে কবিরা আলাপ তোলেন কবিতার বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে। আলোচনায় আসে আশির দশকে একদল তরুণ সাহিত্যিকের হাতে বাংলাদেশের সাহিত্যে পালাবদলের প্রসঙ্গ।
ওদিকে সন্ধ্যা উঁকি মারতে শুরু করেছে। এ পর্যায়ে কবিরা সব আলাপ তুলে রেখে নিখাদ কবিতার কাছে ফিরে যান। শুরু হয় কবিতাপাঠ। একে একে স্বকণ্ঠে কবিতা পড়ে শোনান তারা। সুব্রত সরকারের কবিতায় পাওয়া যায় মহাজাগতিক এক বিপন্নতার সুর। জুয়েল মাজহারের কবিতায় ফুটে ওঠে অস্ত্বিত্বের লঘুভার ও বিষাদময়তা। কবিতা পড়েন অন্যরাও। কবিতার সেই রহস্যকুহেলিতে মোড়ানো হেমন্তের সন্ধ্যা ক্রমে ক্রমে রাতের অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সাঙ্গ হয় দীর্ঘ সেই সাহিত্যআড্ডা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৯
এইচজে