ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মুর্তজা বশীরের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

আমরা একুশের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি 

দীপন নন্দী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২০
আমরা একুশের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি  শিল্পী মুর্তজা বশীর

[২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি। রাজধানীর মণিপুরী পাড়ায় নিজ বাসভবনে বেশ রেগে ছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর।

হাতে পাওয়া নতুন মোবাইল ফোনটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারায় মেজাজটা তার বিগড়ে ছিল। কাছে বসতেই বললেন, মোবাইলটা অপারেট করা শেখাতে পারবে? ইতিবাচক উত্তর দিতেই, শুরু হলো আলাপন। যার খণ্ডিত অংশ বিভিন্ন প্রতিবেদনে সংযুক্ত হলেও, পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি কখনও ছাপা হয়নি।

শনিবার (১৫ আগস্ট) না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন শিল্পী মর্তুজা বশীর। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিনের সেই আলাপনের পূর্ণাঙ্গ রূপ বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। ছবি তুলেছেন দৈনিক কালের কণ্ঠের আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আসাদ]

একুশের চেতনা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে?
মুর্তজা বশীর: আমরা যে একুশের চেতনার কথা বলি, সেটা আমরা আদৌ প্রতিষ্ঠা করতে চাই কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আমার কাছে একুশের চেতনা মানে, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র। সেটি থেকে আমরা এখনো দূরে।

ভাষা আন্দোলন কেন হলো?
মুর্তজা বশীর: ভাষা আন্দোলনটি আসলে বাহ্যিক দিক থেকে এসেছে। ভাষা ছাপিয়ে এ অঞ্চলের ওপর পশ্চিম অঞ্চলের শোষণের প্রতিবাদ ছিল সেখানে।

এর কারণ কী?
মুর্তজা বশীর: পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষেরা বেশি সক্রিয় ছিল। কেননা বৃটিশ আমলে এ অঞ্চলের মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরিতেও তারা পেছনে ছিল। আবার সাধারণ মানুষেরা গ্রামের জমিদার-মহাজনদের শোষণে জর্জরিত। ইংরেজি শিক্ষায় মুসলমানদের অনীহা থাকার ফলে বাংলার হিন্দুরা অনেক এগিয়ে ছিল। ফলে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের ইচ্ছা তাদের মধ্যে ছিল। তাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হলে সব সমস্যার সমাধান হবে। দেশভাগে হিন্দুদের একটা বড় অংশ ভারতে চলে যাওয়ায় মুসলমানরা অগ্রসর হতে থাকে।

কিন্তু সেটি তো বাস্তবায়িত হয়নি?
মুর্তজা বশীর: যে স্বপ্ন নিয়ে এ অঞ্চলের মুসলমানরা পাকিস্তান স্বাধীন করার আন্দোলন করেছিলেন, তা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ভেঙে যেতে থাকে। দেশভাগের পর ভারত থেকে অবাঙালিরা এ অঞ্চলে এসে সমস্ত কিছুতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ফলে এ অঞ্চলের মুসলমানদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। যার কারণেই ভাষা আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল।

আপনি কীভাবে যুক্ত হলেন এ আন্দোলনের সঙ্গে?
মুর্তজা বশীর: ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত। সে সময় আমি বগুড়ায় ক্লাস টেনে পড়ি। সে সময় দেয়ালে লিখেছিলাম, ‘সাড়ে ছয় কোটি জনগণের কণ্ঠ রোধ চলবে না, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এভাবেই যুক্ত হলাম।

২১ ফেব্রুয়ারি তো আপনি ঢাকা মেডিকেল এলাকায় ছিলেন?
মুর্তজা বশীর: ছিলাম।

কেমন ছিলো সেদিন?
মুর্তজা বশীর: সকাল থেকেই থমথমে অবস্থা। তখন আমার একটি যৌথ চিত্র প্রদর্শনী হওয়ার কথা পুরাতন জাদুঘরে, আজকে যেটা এশিয়াটিক সোসাইটি। সেখানেই ছিলাম। তখন অ্যাসেম্বলি চলছিল। সেখানেই স্মারকলিপি দেওয়ার কথা ছিল। চারপাশে তখন ‘চল চল অ্যাসেম্বলি চল’ স্লোগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেলের প্রাচীর ভেঙে পড়েছিলো মানুষের চাপে। এ ভিড় ঠেলে আজকে যেখানে শহীদ মিনার সেখান হাজির হলাম।

আপনি একা ছিলেন?
মুর্তজা বশীর: না, আমি আর হাসান হাফিজুর রহমান একসঙ্গে ছিলাম। তো, ছাত্রদের ভিড় দেখে সৈন্যরা ভয় পাচ্ছিল। ছাত্ররা যখন অ্যাসেম্বলির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন গুলি চালানো হয়। দৌড়ে পালানোর সময় একজন আমার গায়ের মধ্যে এসে পড়ে। তার সারা গায়ে রক্ত। তার মুখের উপর আমি পড়েছিলাম। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে জানতে পারি, তিনি ছিলেন ভাষা শহীদ আবুল বরকত।

আপনি বাসায় ফেরার পর আপনার আব্বা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিছু বলেন নাই?
মুর্তজা বশীর: আমি যখন ঘরে ফিরি, তখন পুরা শরীরে রক্ত। আমার আব্বা রাশভারী মানুষ ছিলেন। তিনি রাজনীতি করা পছন্দ করতেন না। ফলে ভয়েও ছিলাম। তিনি আমাকে দেখে বলেছিলেন, আজকে ভাষার জন্য যদি তোমার প্রাণও যেত তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। সেদিন আমি সাহস পেয়েছিলাম। এবং রাজনীতিতে সক্রিয়ও হই। পরে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশেই আমি চারুকলায় ভর্তি হই।

আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মারক স্থানগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারিনি কেন?
মুর্তজা বশীর: আমরা ইতিহাসের বিষয়ে বেশ উদাসীন। যেসব স্থানে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রয়েছে সেসব জায়গায় একটি ফলক স্থাপন করা যেতে পারতো। তাহলে নতুন প্রজন্ম বা যারা ইতিহাসটা সঠিকভাবে জানে না, তারা জানতে পারতো। আমার একটি দাবি আছে।

কী দাবি?
মুর্তজা বশীর: শহীদ মিনারের সামনের সড়কটির নামকরণ করা উচিত শহীদ মিনার সরণি। এটা হলে সবাই শহীদ মিনার সম্পর্কে জানতে পারবে। সেই সঙ্গে ইতিহাসটি থেকে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০২০
ডিএন/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।