ঘাসভরা প্রায় বিশাল একটা মাঠের শেষভাগে দাঁড়িয়ে আমি। সামনে ইছামতি।
একেবারে গোল ঝকমকে চাঁদ আমার চোখের সামনেই, পৃথিবীর অনেকটাই কাছাকাছি। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাই ইছামতির দিকে। পায়ের নীচে পট পট শব্দ, নীচে তাকাতেই শুকনো কচুরীপানা। নদীর পাড় ঘেষে অনেকদূর পর্যন্ত।
বুঝা যায় কিছুদিন আগেও মাঠটাতে নদীর পানি ছিল। নদী এখন ছোট, শান্ত। তিরতিরে ঢেউ ইছামতির বুকে। মাঝে মাঝে কচুরীপানার দল সামনে এগুচ্ছে এলোমেলো। ডানে অনেকদূর নদীটা। কতদূর দেখা যায় না। বামে একটু এগুতেই দু’ভাগ। একভাগ সামনে এগিয়ে আরো ডানে আর বামেরটা খানিকদূরে ছোট সেতুর নীচ দিয়ে। সেতুর ওপাশটা অন্ধকার।
হালকা হালকা ঠাণ্ডা। তবু উৎসাহে আনন্দে কপালে, মুখে ঘামের বিন্দু। কাঁধে ঝোলানো গামছায় মুখ মুছতেই পেছন থেকে শব্দ শোনা যায়।
‘পারে কে যাবি তোরা আয় না ছুটে।
দয়াল চাঁদ মোর দিছে খেওয়া ভবের ঘাটে॥
দয়াল বড়ো দয়াময়, পাড়ের কড়ি নাহি সে লয়,
এমন দয়াল মিলবে কোথায় এই ললাটে। ’
বটগাছটার নীচে বুড়ি ফকিরানী তখনো গাইছিলেন। নদীর ধারে আসার আগেও তাকে গাইতে দেখে এসেছি। এটা তার দ্বিতীয় গান।
টেকেরহাটের এই সাধুধাম সত্যিই অন্যরকম। সিরাজদিখানের দোসরপাড়া আমার স্মৃতিতে অনন্য এক অধ্যায় হয়ে থাকবে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাবুবাজার ব্রিজ পার হয়ে মাওয়ার পথ ধরে সিরাজদিখান পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত সাড়ে নয়টা। যতটুকু জেনেছিলাম সিরাজদিখান থেকে চিকন লম্বা ট্রলারে করে দোসরপাড়া যেতে হবে।
কল্পনায় দেখছিলাম লম্বা ইঞ্জিন নৌকাটির দু’পাশে নিশ্চুপ বসে থাকবে কতগুলো নর-নারী আর পূর্নিমা রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ঠা ঠা শব্দে কচুরিপানা সরিয়ে এগিয়ে যাবে মাঝ নদী বরাবর।
কিন্তু গুলিস্তান থেকে ছেড়ে আসা সিরাজদিখানের এই বাস থেকে নেমে শুনলাম আজ ট্রলার বন্ধ হয়ে গেছে। সিএনজি বা ব্যাটারি দিয়ে চালানো অটোরিকশাই ভরসা। দুই দিকে তাকিয়ে যখন কিছুই দেখলাম না, একবার মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়েছিলাম। পৌঁছুতে পারবো কি না, নাকি আবার ফিরতি পথ ধরতে হবে?
পুরো সিরাজদিখান বাজারের এই ছোট ফার্মেসিটার ঝাপ খোলা। এখন যে ছোট ছোট অনেকগুলো বাল্ব ওয়ালা চার্জার লাইট পাওয়া যায় তারই একটা জ্বলছে টেবিলের উপরে। ডাক্তার আছেন লেখা একটা লম্বা তিনকোনা কাঠের টুকরার গায়ে ঠেস দেওয়া সেই চার্জার।
আলোটা চোখে লাগে। ফার্মেসির লোকটার বয়স ৩৪ কি ৩৫। আমাকে বলল, দেরি করেন, কিছু না কিছু পেয়ে যাবেন। মেলায় আসছেন তো ... যাওয়া যাবে, চিন্তা কইরেন না।
চিন্তা করা শুরু করব কিনা ভাবছি এমন সময় একটা সিএনজি পাওয়া গেল। ফার্মেসির লোকটার পরিচিত। তিনিই ঠিক করে দিলেন। ১০০ টাকায় চড়ে বসলাম। আধা ঘণ্টার পথ।
খুব ভালো রাস্তা। পিচ ঢালা। মনে হয় নতুন রাস্তা। একটা বড় ব্রিজ পার হয়েই খানিক মাটির রাস্তা। এটাও নতুন।
দূরে আলো দেখা যায়। চারদিকের আবছা কুয়াশার চাদরের মধ্য দিয়ে আলোটা যেন ডাকছে উৎসবের আয়োজনে। কাছে গিয়ে দেখি সত্যিই উৎসব। পদ্মহেম সাধুধামে টেকেরহাট বটতলা লালন সাধুসঙ্গ। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত চলছে উৎসব। আমি প্রথমবার। মানুষে মানুষে একাকার। বটতলায় তখন বুড়ি ফকিরানী গাইছিলেন-
দ্বিদলের মৃণালে, সোনার মানুষ উজলে
মানুষগুরু নিষ্ঠা যার, তবে জানতে পাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
পুরনো বিশাল এক বটগাছ। চারদিকে ছড়ানো তার ডালপালা। গাছের গোড়ায় পাকা, গোল করে বাঁধানো। গাছের
উঁচু একটা ডালে ঝুলে আছে একটা গোল ফ্ল্যাশলাইট, হালকা হলুদ আলো। চাঁদ বলে হটাৎ ভুল হয়ে যায়। বটগাছের বেদীতে বসে বাউল শিল্পীরা, যন্ত্রীরা। তাদের আলোতেই বুঝি ফ্ল্যাশ লাইটের আলো ম্লান।
এই বট গাছকে কেন্দ্র করেই লালনের গানের আসর, লালন বন্দনার আসর।
আসরকে ডানে রেখে বামে এগিয়ে যাই সামনের দিকে। সাদা একটা সাইনবোর্ডকে লক্ষ্য করেই এগুই। তাতে লেখা ‘পদ্মহেম ধামের লালন সঙ্গীত বিদ্যালয়’। কঞ্চি বেড়ার ভেতরে ছিমছাম লালন গানের বিদ্যালয়। সামনে
ইছামতির পানি বর্ষা হয়ে এসে পড়েছে বিদ্যালয়টার দরজা অব্দি। স্কুলের পাশেই কতগুলো চুলায় খিচুড়ি হচ্ছে।
বাবুর্চিরা বড় বড় খুন্তি-চামচ নিয়ে ব্যস্ত। বুঝলাম রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুরে নদীর পাড় হয়ে এসে বসলাম চাটাই পাতা সামিয়ানার নীচে। সারারাত চলল লালনের গান। শুধু বুঁদ হয়ে মিশে যাওয়া লালন আর পূর্ণিমা রাতের সাথে। সারা রাত।
পদ্মহেমধাম সাধুসঙ্গ - লালন গানের, লালন কথার, লালন দর্শনের এক আর অদ্বিতীয় নাম। যারা লালন সাঁই কে ভালবাসেন, তার গান, বাণীর আস্বাদন পেতে চান, নির্দ্বিধায় চলে আসবেন।
সন্ধ্যায় শুরু হয়ে একটানা সারারাত গান হয়ে ভোরে শেষ। এভাবেই দুই রাত।
ঢাকার গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া থেকে সিরাজদিখান বাজার এর বাসে সরাসরি সিরাজদিখান বাজার নামতে হবে অথবা ঢাকা-মাওয়া’র বাসে নিমতলি বাস স্ট্যান্ড এ নেমে সিএনজিতে সিরাজদিখান বাজার। ওখান থেকে অটো-তে
দোসরপাড়া পদ্মহেমধাম সাধুসঙ্গ, লালন শাহ বটতলা।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়
লেখক: রেজাউল করিম নোমান
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৮ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর