বাস্তবে যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় যাওয়ার সুযোগ থাকে, তবে সে সুযোগ কে না লুফে নিতে চাইবে? দুর্গম হিমালয় পর্বতমালার ভেতর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সড়ক পথে সাইক্লিং করা বেশ কঠিন হলেও এমন সুযোগ হাত ছাড়া করার মতো বোকামি করিনি।
শুরুটা ছিল হঠাৎ করেই।
তথ্য নজরে আসার পরের দিনই ব্যক্তিগত খরচে আমার সাইক্লিং করার ঘোষণা অফিস সহকর্মী ও বন্ধুমহলে অত্যন্ত হাসির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক অর্থে অবশ্য তাদের হাসির যথেষ্ট কারণও ছিলো, কারণ, এটা কোনো ছেলে খেলা নয়। ৬০০ কিলোমিটার পথে ৩০০ কিলোমিটার সমান উঁচু পাহাড়ি পথে সাইক্লিং করার জন্য শারীরিকভাবে যথেষ্ট সামর্থ থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, বৈরি আবহাওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭,০০০ ফুটেরও অধিক উচ্চতায় অক্সিজেন কম থাকায় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণেও কষ্ট হয়।
এই অভিযানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিল, মানসিকভাবে এমন অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া, যেখানে জনবসতি নেই, নেই পর্যাপ্ত খাবার আর পানিও।
সবচেয়ে কঠিন কাজের প্রথম যে কাজটি অভিযানের আগের করতে হয় তা হলো, একটি দামি ও উন্নতমানের পাহাড়ে চালনোর উপযোগী সাইকেল যোগাড় করা এবং পর্যাপ্ত অর্থ যোগাড় করা।
স্বপ্নের পাশাপাশি আমার ছিলো ভালো একটি সাইকেল।
উঁচু-নিচু হিমালয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সড়ক পথে চলতে মানসিক এবং আর্থিক প্রস্তুতির পর আমি পথের একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা করে নিই। তা ছিল এমন:
দিন ০১: মানালি থেকে মাড়ি, দিন ০২: মাড়ি থেকে শিশু, দিন ০৩: শিশু থেকে পাতসিও, দিন ০৪: পাতসিও থেকে সারচু, দিন ০৫: সরচু থেকে পাং, দিন ০৬: পাং থেকে লাতো, দিন ০৭: লাতো থেকে লেহ্
পরিকল্পনা যখন বাস্তবায়নের পথে যখন পা বাড়ালাম, তখন অফিসের সহকর্মী ও বন্ধুমহল থেকে আমাকে পাগল খেতাব পেতে হয় এবং বলা হয়, এ অভিযান সফলভাবে শেষ করতে পারবো না। আবার কেউ কেউ বলে এটি আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই নয়। একটি মজার প্রশ্নও করেছিল অনেকে, যেখানে বিমানে যাওয়া সম্ভব সেখানে কেনো সাইকেল? সেটা আমি জানতে না চাইলে, আমার জানা ছিল পরবর্তী ১০টি দিন খুবই কষ্টকর যাবে, যেটা সাধারণ জীবনযাত্রা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
যেহেতু দীর্ঘদিন সন্ধান করার পরও সহযোগী আরেকজন সাইকিলিস্ট পাওয়া যায়নি, অগত্যা একাই যাত্রা শুরু করতে হয় পৃথিবীর সেই দুর্গম পথে। আনুষঙ্গিক পোশাক, মেরামত করার যন্ত্রপাতি ও সাইকেল নিয়ে ২০১১ সালের আগস্ট মাসের ২০ তারিকে যাত্রা করি প্রথমে বিমানে করে দিল্লি। পরবর্তীতে দিল্লি থেকে বাসে করে ১২ ঘণ্টার যাত্রা শেষে মানালি। মানালি, যেখান থেকে যাত্রা শুরু আমার উত্তেজনাপূর্ণ অভিযানের।
দিন ০১: মানালি থেকে মাড়ি
প্রথম দিন হিসেবে দিনটি ছিল যথেষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ, স্বদেশ থেকে বহু দূরে একা আমি হিমালয়ের মত জনশূণ্য পাহাড়ে সাইক্লিং করছি। একটি স্বপ্ন পূরণের আশায় এগিয়ে যাই সামনের দিকে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, সকালবেলা মানালি পৌঁছানো মাত্র চলতে শুরু করি বহুল প্রতিক্ষিত মানালি-লাদাক সড়ক পথে। জায়গাটি হিমালয়ে হওয়াতে শুরু থেকেই উচ্চতার দিকে সাইক্লিং শুরু করতে হয়। যতই উঁচুতে যাচ্ছি ততই ঠাণ্ডা বাড়ছিল।
শুরুতেই যে পাহাড়টিতে সাইক্লিং শুরু করি তার নাম হল রোথাং। ধীরে ধীরে পলচান নামক জায়গা পার হয়ে রোথাং এর সোলান উপত্যকার মাঝদিয়ে গুলাবা নামক স্থানে পৌঁছি, যেটা মানালি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। এখানে হালকা খাবার খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করি মাড়ির দিকে। রোথাং নামের সবুজ পাহাড়টি পযর্টকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। রোথাং এর গায়ে আছড়ে পরা মেঘ ভেদ করে, ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ভেতর দিয়ে চলে যাই মাড়ি।
এ জায়গায় কোনো বসতি চোখে পড়বে না, কেবল কিছু তাঁবু ছাড়া। তাঁবুগুলো মূলত পর্যটকদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হয়। মাড়ি পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে যায়, তাই সিদ্ধান্ত নিই, এখানেই আমার প্রথম দিনের যাত্রাবিরতি এবং রাতের খাবার জলদি শেষ করেই ঢুকে যাই নিজের তাঁবুতে। যেহেতু পাহাড়ে খুব দ্রুত রাত নামে এবং প্রথম দিনে যথেষ্ট পরিশ্রমের পর, নির্জন পাহাড়ে তাঁবুই ছিল রাত কাটানোর জন্য আমার সোনার প্রাসাদ। এভাবেই তাঁবুতেই রাত কাটতে হবে প্রতি রাতে।
দিন ০২: মাড়ি থেকে শিশু
দ্বিতীয় দিনটি শুরু হয় হিমাঙ্কের নিচে ৭০ সেলসিয়াস তাপমাত্রার পরিবেশে সাইক্লিং করে। একটি তাঁবুর দোকানে নুডলস দিয়ে সকালের নাস্তা শেষে চা পান করে শরীর গরম করে আবার শুরু হয় সাইক্লিং রোথাং এর চুড়ার দিকে। প্রথমে বেশ খানিকটা পথ ভালই ছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় ভাঙা পথ। মাটি ও পাথরের টুকরোর ওপর দিয়ে যেতে হয় প্রায় ১৮ কিলোমিটার ওপরের দিকে। সম্পূর্ণ যাত্রার মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে খারাপ পথ। কারণ বৃষ্টির জন্য ভূমি ধ্বসের কারণে কোথাও কোথাও রাস্তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও ছিল না। অবশেষে ১৩ হাজার ১০০ ফুট উচ্চতায় রোথাং পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করি। ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মাত্র ২ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করতে সক্ষম হই। যায়গাটি ভ্রমণ-পিয়াসীদের জন্য একটি অনন্য স্থান। চূড়ায় পৌঁছানোর পর আবার শুরু হয় নিচের দিকে নামা। রাস্তার এতটাই বাজে অবস্থা যে, বলে বোঝাবার মত নয়। একটু পিছলে গেলেই হাজার ফুট নিচে পড়ে যাবার আশংকা। ধীরে ধীরে নামতে নামতে হয় খোকসার নামক স্থানে। এখানে একটি বাধ্যতামূলক বিরতি নিতে হয়। কারণ, প্রথমবারের মতো একটি পুলিশ ফাঁড়ি দেখতে পাই। এখানে সবাইকে পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্র লিপিবদ্ধ করতে হয়।
বলে রাখা ভাল, অভিযানের এই পথটি সাধারণ পর্যটকদের জন্য গত ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। এ পথটি মূলত ইন্ডিয়ান সামরিক বাহিনীর প্রযোজনে ব্যবহৃত হয়। যার জন্য মাঝে মাঝে পুলিশ বা সামরিক বাহিনির চেকপোস্টে লিপিবদ্ধ করে সামনে যেতে হয় এখনও।
একজন পুলিশ অফিসার প্রথম বাংলাদেশি সাইকেল পর্যটক বলে আমাকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। তার সঙ্গে দুপুরের খাবার শেষে আবার বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ি পথে। এখান থেকে রাস্তাটি যথেষ্ট ভাল বিধায় কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই বয়ে চলা বাঘা নাদীর পাশ দিয়ে চলে যাই শিশু।
শিশুতে এক পাহাড়ির বাড়ির সামনে একটু ভালো যায়গা দেখে তার অনুমতি নিয়ে আমার তাঁবু ফেলি। যখন আমি আমার তাঁবু ফেলতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ সেই পাহাড়ি লোকটি তার বাড়ির ভেতর থাকার আমন্ত্রণ জানান। শুধু এখানেই শেষ নয়, তিনি তার বাড়িতে গরম পানি, দুধ এমনকি গরম বিছানারও ব্যবস্থা করেন আমার জন্য। রাতের খাবার তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ করে, কিছুক্ষণ আমার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করি। গল্প শেষে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম বিদায় নিয়ে বিছানায় চলে যাই, যেহেতু খুব ভোরে তাদের ঘুম ভাঙার আগেই আমি বেরিয়ে পড়বো লাদাখের পথে।
দিন ০৩: শিশু থেকে পাতসিও:
যাত্রার তৃতীয় দিনে খুব ভোরবেলা ৫টা বাজতেই বেরিয়ে যাই সাইকেল নিয়ে। জিনজিনবার পর্যন্ত রাস্তা কিছুটা উঁচু হলেও গনডালা পর্যন্ত রাস্তা ছিল খুবই উঁচু। এখান থেকে হিমালয়ের এক অদ্ভুত সৌন্দর্য চোখে পড়ে। সূর্যের আলো যখন দূর পাহাড়ের চূড়ায় পড়ে, তখন মনে হয় যেন কেউ পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কিংবা স্বর্ণ দিয়ে পাহাড়কে মুড়িয়ে রেখেছে, আর খুবই নিচে দিয়ে বয়ে চলা সেই বাঘা নদী, সে এক অপূর্ব দৃশ্য!
এভাবে চলতে চলতে পৌঁছে যাই তানডি, যেখানে দেখা মেলে বিপরীত দিক থেকে আসা আরো দুই সাইকেল আরোহীর সঙ্গে। তাদের একজন জার্মান ও অপর জন স্প্যানিশ। তাদের মতে, এ পথে একা যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু কী আর করা? তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলতে থাকি কেলংয়ের পথে। পথে বরফ গলা পানির ঝরণা থেকে পানির তেষ্টা মেটাই। এই ঝরণাগুলোই ছিল আমার জীবন রক্ষার একমাত্র পানির উৎস।
কেলং থেকে ইসতিংরি পর্যন্ত কিছুটা নিচু পথ হলেও ইসতিংরি থেকে জিপসা ছিল ৮০০ ফুট উঁচু পাথুরে পথ, মাঝে ৪০০ ফুটের কিছুটা ঢালু পথও ছিল। এই পথটি ছিল কিছুটা বিপজ্জনক। কারণ একটু অন্যমনষ্ক বা নিয়ন্ত্রণ হারালে মুহূর্তেই পড়ে যেতে হবে হাজার ফুটেরও বেশি নিচু খাদে। এভাবেই উঁচু পথ ধরে পৌঁছে যাই বারালাছা লা পাহাড়ের পাদদেশে এবং সেখান থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে দারচা পুলিশ ফাঁড়িতে।
দারচা পুলিশ ফাড়িতে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবারও শুরু করি বারালাছা লা পাহাড়ে ওঠা। প্রায় ১০ কিলোমিটার ওঠার পরই সন্ধ্যে হয়ে আসতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত। পাহাড়ে খুব অল্প সময়েই রাত হয়ে যায়। কারণ সূর্য পাহাড়ের আড়াল হলেই অন্ধকার। সুতরাং পাতসিও নামক এই স্থানেই তাঁবু ফেলতে হয় এই দিনের জন্য। অপ্রত্যাশিতভাবে কিছুটা দূরে আরও দুটি তাঁবু নজরে আসে, কিন্তু রাত হওয়ায় জানা সম্ভব হয়নি কারা ছিল সেই তাঁবুতে। সঙ্গে থাকা শুকনো রুটি আর ঝরণার পানি খেয়ে সেদিনের জন্য ঢুকে পড়ি স্লিপিং ব্যাগের ভেতর।
দিন ০৪: পাতসিও থেকে সারচু
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই আগের মত শুকনো রুটি খেয়েই রওয়ানা হওয়ার সময় পরিচিত হই সেই তাঁবুবাসীদের সঙ্গে। একটি তাঁবুতে ছিল কারলো (ইতালি) ও অপর তাঁবুতে ছিল যাদক দম্পতি (ইসরায়েল)। এত দিন পর তিন জন সাইকেল সঙ্গী পেয়ে একটু সাহস বেড়ে গেলো। কিন্তু বেশিক্ষণ তাদের সঙ্গে সাইকেল চালানো যায়নি, তারা আমাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। এর কারণ, তাদের ছিল ট্যুর গাইড যারা তাদের মালামাল বহন করছিল। আর আমি আমার ভারী মালপত্র একাই বহন করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকি।
পাতসিও থেকে দৃশ্যপট হঠাৎই বদলে যায় শুকনো ও ধুসর হিমালয় অঞ্চলে। এ জায়গাটি মূলত সামরিক ঘাঁটি। তাই যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করি একা একা যাত্রার এই অংশটুকুতে। এখান থেকে ২ কিলোমিটার দূরেই বারালাছা লা পাহাড়ের বেস ক্যাম্প। এই বেস ক্যাম্প থেকে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকি যার উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ ফুটেরও বেশি। ধীরে ধীরে যখন চূড়ায় পৌঁছি সেখানে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেই। উচ্চতা, অক্সিজেন স্বল্পতা ও ক্লান্তি সব মিলিয়ে ঘুম যেন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এখান থেকে সারচু মাত্র ২৫ কিলোমিটার।
সারচু এ যেন এক যাদুর এলাকা, ভৌগালিক অবস্থান এমনই যে, এখানে কোনো রকম চেষ্টা ছাড়া সাইকেল আপনা থেকেই প্রায় ২০ কিলোমিটার বেগে চলতে থাকে। কারও মতে এখানে একরকম চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে যা লৌহজাতীয় যেকোনো বস্তুকেই টানতে থাকে। জায়গাটি আসলে ঢাল বলেই মূলত এমনটি হয়ে থাকে, যা দৃশ্যত সমতল মনে হয়। প্রায় সন্ধ্যে বেলা সারচু গিয়ে প্রথমেই একটি সামরিক ঘাঁটি চোখে পড়ে। এই যায়গায় এসে সেই তিন জন সাইক্লিস্টের সঙ্গে দেখা হয় আবার। তারা আমার তিন ঘণ্টা আগেই এখানে চলে আসেন। সিদ্ধান্ত নিই, আমরা এখানেই রাত কাটিয়ে পরদিন এই ঘাঁটি পার হবো।
দিন ০৫: সারচু থেকে পাং
আগের রাতগুলো এতটা ঠাণ্ডা ছিল না, যেমনটা আজ অনুভূত হচ্ছে। স্বল্প সময়ে সামরিক ঘাঁটিতে কার্যাদি সম্পন্ন করে বেরিয়ে পড়ি নকিলা পাহাড়ের দিকে। পাহাড়টির উচ্চতা প্রায় ১৬ হাজার ২৩০ ফুট। আজকের দিনটা খুবই স্মরণীয় ৩টি ঘটনার জন্য। প্রথমত, নকিলা পাহাড়ে ওঠার জন্য ২১টি লুপ যা গাতা লুপ নামে পরিচিত, সহজভাবে বললে ২১টি বিপরীতমুখী রাস্তা, যা মানসিক ও শারীরিক উভয় দক্ষতার জন্য অগ্নিপরীক্ষা। দ্বিতীয়ত, আকস্মিক ও ভয়াবহ আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং তৃতীয়ত, সাইকেলের বা পার্শের প্যাডেল নষ্ট হওয়া।
প্রথমে বা পার্শের প্যাডেলটি সঙ্গে থাকা যন্ত্রপাতির সাহায্যে তার দিয়ে বেধে চালানো শুরু করি। শুরু থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় ওঠার জন্য সেই ২১টি বিপরীতমুখী রাস্তা যে কী ভয়ঙ্কর কষ্টকর তা বলে বোঝাবার মত নয়। একটি শেষ করতে না করতে আরেকটি শুরু হয়ে যায়। এ যেন আর শেষ হয় না...। এরইমধ্যে খাবার পানিও শেষ। রাস্তার পাশে ঝরণার পানি পান করে কোনরকম শেষ হয় গাতা লূপ। এই কষ্টকর লুপ শেষ করে দুপুরের খাবারের বিরতি নেই। সারচু থেকে তৈরি করা খাবার দিয়েই দুপুরের খাবার শেষ করে আবারও শুরু হয় যাত্রা। ধীরে ধীরে আরও ওপরে উঠতে উঠতে প্রায় দুপুর ২টা বেজে যায় নকিলা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে। সেখানে কিছুক্ষণ ছবি তুলে আবার পাহাড়ের অন্য পাশ ধরে নিচে নামতে শুরু করি। নিচে নামাটা সব সময়ই আনন্দদায়ক। কারণ, নকিলা পাহাড়ের নিচে নামতে মাত্র ১ ঘণ্টারও কম সময় লাগে। এভাবেই বেলা ৩টার মধ্যে পৌঁছে যাই হুইস্কি নুল্লাহ।
হুইস্কি নুল্লাহ থেকে পাং মাত্র ৩২ কিলোমিটার এবং এর মাঝে আছে আরও একটি ১৬ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতার লাচুং চূড়া।
ঘণ্টা খানিকের মধ্যেই ভয়ঙ্করভাবে বদলাতে শুরু করে আবহাওয়া। হিমালয়ের পাহাড়ে যে কখন কী হয় বলা খুবই মুশকিল। হঠাৎ করেই এলাকাজুড়ে বরফ পড়তে শুরু করে ১৫ মিনিট। চারদিক সাদা হয়ে ওঠে। ভয় শুধু যদি রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে যায়, তাহলে চালানো তো দূরের কথা পালাবো কোথায়? ওপরওয়ালার বিশেষ কৃপায় ১৫ মিনিট পর বরফ ছাড়া ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করে। এরই মাঝে পানি শেষ হয়ে যাওয়াতে বরফ চুষেই পানির তৃষ্ণা মেটাতে হয়। আনুমানিক ৫টার দিকে এভাবেই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে সব শেষে লাচুং চূড়ায় পৌঁছে যাই। এখানে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ৫১% প্রায়। এখান থেকে শুধু নিচের দিকেই নামা আর নিচে নামলেই পাং নামক স্থানে রয়েছে আরও একটি সামরিক ঘাঁটি। সব মিলিয়ে শরীর এতটাই ক্লাস্ত ছিল যে বিশ্রাম নেবার সময় কখন যে ঘুমিয়ে যাই বুঝতে পারিনি। এতদিনের জীবনে এত তৃপ্তির ঘুম কখনোই ঘুমাইনি মনে হলো।
যখন ঘুম ভাঙে, নিজেকে আবিষ্কার করি সেই সামরিক ঘাঁটির হাসপাতালে এবং সন্ধ্যে হয়ে গেছে ততক্ষণে। প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ কিছুই মেলাতে পারিনি, কোথায় আমি? আর হাসপাতালেই বা কেন? পরে ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারলাম, দুই ইউরোপীয়ান ভ্রমণকারী আমাকে ঘুমস্ত অবস্থায় লাচুং চূড়ায় পায় এবং তারা আমাকে ডাকে, তাদের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় ওরা ধরে নেয় আমার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর তাই তাদের গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তার পরীক্ষা করে আমাকে ছেড়ে দেয়, আর বলে দেয়, এমন অবস্থায় না ঘুমানোর জন্য। পাহাড়ে এমন জায়গায় ঘুম পেলে সাইক্লিং বাদ দিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে। কারণ, যেখানে অক্সিজেন কম থাকে, তখন রক্তে ও মাস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে যা ঘুম থেকে মুত্যুর দিকে গড়িয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের কাছেই তাঁবুতে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি।
দিন ০৬: পাং থেকে লাতো
পরের দিন ঠিক ডক্তারের কথা মাথায় রেখেই সকাল ৭টায় আবার সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। প্রথম ১০ কিলোমিটার সাইক্লিং করে ১৫ হাজার ৬০০ ফুট উচ্চতার মরি প্লেইন নামক স্থানে পৌঁছি। জায়গাটি দৈর্ঘ্যে ৪০ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৫০ কিলোমিটারের মত পাহাড়ঘেরা সমতল ভূমি। প্রায় ৪০ কিলোমিটার সাইক্লিং করে আবার ৬০০ ফুট নিচে নেমে আসি। এখানে একটি ঝরণার পাশে পানি আর বিস্কুট খাবার সময় একটি খালি সামরিক গাড়ি এসে থামে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেই তার চুলা, চাল, ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না শুরু করে দেন। তিনি আমাকে শুধু বিস্কুট খেতে দেখে তার খাবার খাওয়ার আমস্ত্রণ জানান। যেহেতু একা চলছি, তাই সেরকম ভারী খাবার বয়ে বেড়ানো একেবারেই অসম্ভব ছিল আমার জন্য। তার এক প্রস্তাবেই সাড়া দিয়ে দিই। মনে হচ্ছিল, কতো যুগ পরে একটু ভাল খাবার পেলাম। তারপর এখান থেকে আবার শুরু হয় ১৭ হাজার ৫৮০ ফুট উচ্চতার তাংলাং চূড়ায় ওঠা। মাত্র ২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবো সেই চূড়ায় পৃথিবীর দ্বিতীয় উঁচু সড়ক পথ। পাহাড়ি নদী, মেঘ, মেঘের ছায়া, বরফ ঢাকা পাহাড় এসব দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে অবশেষে আমি তাংলাং চূড়ায়। এখান থেকে শুধুই নিচের দিকে নেমে যাওয়া লাতো পর্যন্ত। যতই নিচে নামছিলাম ততই মানুষের সভ্যতার চিহ্ন চোখে পড়ছিল। রুমপটসে, গয়া ও অন্যান্য ছোট ছোট গ্রাম এর পাশ দিয়ে পৌঁছে যাই লাতো। জায়গাটি এতই সুন্দর যে মনে হচ্ছিল সম্পূর্ণ যাত্রায় এই জায়গাটিই সবচেয়ে সুন্দর। চারদিকে সবুজ গাছপালা ঘেরা ও পাহাড়ি নদীর পাশে এমনই একটি জায়গা তাঁবু করে থাকার জন্য উপযুক্ত স্থান। এরই সঙ্গে মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল একটাই চিন্তা আর মাত্র ১ দিন আর তার পরই সেই স্বপ্ন পূর্ণ হবে।
দিন ০৭: লাতো থেকে লেহ
৭০ কিলোমিটার মাত্র লেহ ও আমার মাঝে দূরত্ব। ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত নিচু পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া উপসি পর্যন্ত। তারপর ৫০ কিলোমিটার এ মত উঁচু-নিচু পথ ধরে সাইক্লিং করে থিকসে নামক জায়গার দিকে এগোতে থাকি। পথে কারু নামক স্থানে ছোট একটি যাত্রা বিরতি নিই। কারু হচ্ছে সেই যায়গা, যেখান থেকে পৃথিবীর তৃতীয় উঁচু সড়ক পথ চ্যাং লা যাওয়া যায় এবং একই রাস্তা ধরে যাওয়া যায় প্যানগং লেকম যা কিনা ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। থিকসে পৌঁছে যাই স্বল্প সময়ের মধ্যেই। তারপর যে শহরটি আছে, তা হচ্ছে চংলামসার যা লেহ থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে। ধীরে ধীরে সরকারি ভবন, স্কুল, মন্দির ইত্যাদি চোখে পড়তে থাকে। অবশেষে দুপুর ২টায় লেহ শহরে পৌঁছে যাই। শহরে পা রেখেই দুপুরের খাবার সেরে হোটেল খুঁজে বের করি। এত দিন পর একটু আরাম করে রাত কাটানোর জন্য।
বিকেল বেলা বের হই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি অনুমতিপত্র নেওয়ার জন্য। তবে একটি খবর আমার মনকে একেবারেই ভেঙে দেয়। তা হলো বাংলাদেশীরা খারদুং লা যেতে পারবে না। মনে হলো, আমরা আমাদের দেশের ভাবমূর্তি এতটাই নিচে নামিয়েছি যে আমরা যেতে পারব না। অবশেষে পরদিন ঠিকই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি খারদুং লার পথে। যাই হোক অবশেষে খারদুং লা পৌঁছি। কিন্তু খারদুং লার চূড়ায় যাওয়ার পথেই একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে ফিরে আসতে হয়। সান্ত্বনা এতটুকুই যে, সেই চূড়াতে পৌঁছাতে না পারলেও সেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পথে তো গিয়েছি!
শুধু মানালি থেকে লেহ পর্যন্ত সাইক্লিং করে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সড়ক পথে ওঠা নয়। বরং তারচেয়েও বেশি কিছু। এটা সেই সকল মানুষের পুরস্কার, যারা জীবন বাজি রেখে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যতিক্রম কিছু করার ক্ষমতা রাখে। আর বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেয় আমরা বাংলাদেশিরাও পারি, সুযোগ পেলে ভালো, ব্যাতিক্রম কিছু করার।
দেশে ফিরে বন্ধু আর সহকর্মীদের যখন গল্প করছিলাম, তখন বুঝতে পেরেছি আমাদের ছোট্ট এই জীবনে আসলে কী অর্জন করেছি। নিজের চোখে পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখার অভিজ্ঞতার কাছে ১০ দিনের কষ্ট এখন আর কিছুই মনে হয় না।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়
বাংলাদেশ সময়: ২০৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর