হুট করেই সিদ্ধান্ত। এবার ঈদের ছুটিতে নেপাল যাওয়া হবে।
বাই এয়ার এ নেপাল যেতে ভিসা নিতে হয় না। শুধু বিমানের টিকিট করে নিলেই হয়। আর সাথে করে এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিতে হয়। নেপাল এয়ারপোর্ট নেমে ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে ছবিসহ জমা দিলেই ভিসা পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় অন-এরাইভেল ভিসা। তবে বাই রোডে নেপাল যেতে হলে ভারতের ভিসা নিতে হবে, কেননা বাংলাদেশ থেকে নেপাল যেতে হলে ভারত সীমান্ত হয়ে যেতে হয়। আর আমরা যেহেতু বিমানে করে গিয়েছি তাই প্রথমে ভেবেছিলাম আমরা নিজেরাই এয়ার টিকেট কিনে ফ্লাইটে চড়ে বসবো। নেপাল নেমে অ্যাডভেঞ্চার করে করে সব কিছু খুঁজে নেব।
কিন্তু আমরা যখন ঈদের পরদিন যাব বলে ঠিক করলাম, তখন পর্যটকদের ভিড়ে হোটেল পাওয়া, না পাওয়া নিয়ে একটু সংশয়ে পড়ে গেলাম। তাই এবার আপাতত অ্যাডভেঞ্চারের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে একটি ট্যুরিজম ক্লাবের দ্বারস্থ হলাম। সফলও হলাম। আমরা যখন ট্যুরিজম ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম তখন তাদের বুকিং নেওয়া বলা যায় শেষ পর্যায়ে। অবশেষে ক্লাবের এমডি আমাদের আশাহত না করে আমাদের জন্য ৭টি বিমান টিকিট এবং থাকার হোটেলসহ যাবতীয় দায়ভার নিলেন। আর আমরা, সব কিছু সেই ক্লাবের উপর ছেড়ে দিয়ে যেন স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম!
এখানে বলে রাখি, আপনি যদি নেপাল যেতে চান তবে শুধু এয়ার টিকেট আর থাকা খাওয়া ছাড়া তেমন কোনো খরচ নেই। তবে আপনি যদি এক বছরের মধ্যে দুইবার নেপাল যান, তবে দ্বিতীয়বার নেপাল ইমিগ্রেশনে আপনাকে ২৫ ইউ.এস ডলার ফি দিতে হবে। প্রথমবার গেলে তা লাগবে না।
দিন গণনা শুরু...
বিধান আর সোহেল মিলে প্রতিদিনই ছুটছে শপিং করতে, কি কিনবে, কি পরবে নেপাল গিয়ে, নানান টেনশন শুরু হয়ে গেছে তাদের। প্রতিদিনই নেপাল সর্ম্পকিত কোনো না কোনো মিটিং হচ্ছে ইউনুছ ট্রেভেলসে! ইউনুছ ট্রেভেলস এ জন্য বল্লাম যে, কোনো ধরনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করা হলে ইউনুছের দোকানে বসেই করা হয়। আর তাই সবাই এর নাম দিয়েছে ইউনুছ ট্রেভেলস। ওদের অতি উৎসাহি হওয়া দেখে আমিও চিন্তায় পড়ে গেলাম, আসলেই কবে হবে নেপাল দর্শন ?
আমরা এমন ভাবে টিকিট করলাম যে, রোজা ৩০টা পূর্ণ করে ঈদ করেই ফ্লাইট ধরবো। কিন্তু রোজা ২৯টা হওয়ায় আমরা হাতে আরও একদিন পেলাম। কি যে খুশি আমার! যাক অন্তত ঈদের দিন তো যাত্রা করতে হচ্ছে না!
১১ আগষ্ট ২০১৩
ভোর ৬ টা...
মোবাইল এ রিং বেজে উঠলো। অপর প্রান্ত থেকে ইউনূস ফোন দিয়ে জানালো ওরা ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। বলা বাহুল্য আমি আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় চলে আসি। ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলাম। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায়। কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে, ভোরের ব্যস্ততাহীন ঢাকায় সিএনজি নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে যেতে মনে একটা সংশয় জাগলো ফ্লাইটটা ঠিক মতো হলেই হয়।
এয়ারপোর্টে ঢুকেই দেখি ইউনূছ আর আদিল বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আর বেচারা সোহেল তো পিছনের পুরো একটা সিট নিয়ে ঘুমানোর চেস্টা করে যাচ্ছে! তাদের সারা রাতের বাস জার্নি করে ঢাকা আসা, আর ফ্রেসমুড নিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্ট ঢুকেই ওদের এমন কাণ্ড কারখানা দেখে একটু দয়া হলো। আহারে...ঘুম ! কি আর্শ্চয্য তুমি! সময়মতো কাছে না এলে যেন বহুকাল ধরে অধরাই রয়ে যাও তুমি!!!
সারা রাতের বাস জার্নি, তার ওপর ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া নেই। অপু আর কাজল ভাই ছুটেছেন কাছের কোনো রেঁস্তোরার খোঁজে, কাজল ভাই ফোন করে ইউনূছকে জানালেন সব কিছু বন্ধ, শুধু কলা আর ব্রেড পাওয়া গেছে!
এদিকে আমাদের ফ্লাইট টাইম সকাল ১০টা। যদিও কোনো কারণ ছাড়াই এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ফ্লাইট। সবার মুখেই দেখা দিল একটু বিরক্তির ছাপ। আরও এক ঘণ্টা! কিন্তু, কিছু সময় পর আবার অন টাইমে ফ্লাইট দেখে সবাই একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
সকাল ৮টা বেজে ৩০ মিনিট...
আমরা বোর্ডিং পাস নেওয়ার জন্য লাইন এ দাঁড়িয়ে গেলাম। তখনো তেমন একটা ভিড় লাগেনি। খুব অল্প সময়েই সিট নম্বর নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু এখানে এসে তো যা-তা অবস্থা! প্রায় ৭/৮টি লাইন এবং প্রত্যেক লাইনেই কম বেশি জটলা লেগে আছে।
বোর্ডিং করার সময় নির্দিষ্ট ফ্লাইটের নির্দিষ্ট কাউন্টার থাকলেও ইমিগ্রেশনে এমনটা নেই। এখানে এসে সবাই আবার এক কাতারে দাঁড়াতে হয়। তাই সবসময় এখানে ভিড় লেগেই আছে। তার ওপর খুবই ধীর গতির সার্ভিস! আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশের এমন অবস্থা দেখে সত্যিই খুব কষ্ট লাগলো। দক্ষ জনবল এবং জরুরি এ জায়গায় ডিজিটাল’র ছোঁয়া মনে হয় এখনও লাগেনি। অথবা আমরা সঠিক ভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমার মতে এ জায়গাটায় আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
বহু ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে ইমিগ্রেশন লাইন পার হলাম। কিন্তু বিধি বাম! আমাদের শেষ যাত্রী বিধান আটকা পড়লো ইমিগ্রেশন ডেক্সে। পুরোদমে ইন্টারভিউ শুরু হলো বেচারার। আমরা ৫/১০ মিনিট এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে এসে দেখি বেচারা বিধান এখনো ইমিগ্রেশন ডেক্সে আটকা পড়ে আছে ইন্টারভিউর জন্য।
বিধান’র মুখ তো একেবারে শুকনো হয়ে গেছে। হয়তো মনে মনে ভাবছে যদি আমাকে না যেতে দেয়, তাহলে তো সব শেষ! নয়তো ও ঠিক করেই ফেলেছে আর যাবো না নেপাল, আমাকে এবার রেহাই দাও! হঠাৎ আমাদের দেখে একটু যেন নড়ে চড়ে বসলো বেচারা বিধান। ইশারায় ডাক দিতেই এগিয়ে গেল ইউনূছ। অবশেষে ইমিগ্রেশন অফিসারকে বুঝাতে সক্ষম হলো যে আমরা গ্রুপ ট্যুরে নেপাল যাচ্ছি। আমাদের ভিসা নেপাল ইমিগ্রেশন প্রদান করবে।
ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন, এ কথাটাই তো আমি উনার (বিধান) কাছ থেকে শুনতে চাইলাম! উনিতো বলছেন না এ কথা! ফ্লাইটের বাকি আরো ৪০ মিনিট, তাই আপাতত আমরা বিধানকে নিয়ে ইমিগ্রেশন লাইন অতিক্রম করে বিমান দর্শনের জন্য এগিয়ে চললাম।
আমরা বসে আছি এখন একেবারে শেষ লাউঞ্জে। সব ঝামেলা শেষ। বিশাল বড় বড় গ্লাস দিয়ে মোড়ানো ঘরের বাইরে দিয়ে আমাদের নিয়ে বয়ে যাওয়া বিমান ৭০১ টি দেখা যাচ্ছে। চলছে ফটো স্যুটের কাজ। যে যার মতো ছবি তুলছে। তবে এবারের বিদেশ সফরে এই প্রথম আমার সাথে কোনো ক্যামেরা ছিল না! তাই আইফোনকে সঙ্গী করে এবারের যাত্রাটা সুখকর করতে চাইলাম।
সকাল ১০টা ২৫ মিনিট
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
ফ্লাইট নং -৭০১
গন্তব্য: ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, কাটমন্ডু নেপাল...
আমরা সবাই মিলে বিমানের ভেতর প্রবেশ করলাম। যার যার সিটে বসে বিমানের ছোট ছোট জানালার ফাঁক গলে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে বিমানের সিটগুলো পূর্ণ হতে শুরু করলো। দেখে অবাক হলাম, সবাই যাব নেপাল?
হুম.. আমরা সবাই নেপাল যাব, যাব হিমালয়ের দেশে, যাব মেঘ পাহাড়ের দেশে, যেখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় আর পাহাড়ে হেলান দিয়ে যেন মেঘরাশি দাঁড়িয়ে আছে! আহ! ভাবতেই যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছবি।
বিমান চলতে শুরু করেছে। কেবিন ‘ক্রু’ বলে চলেছেন, ৩৪ হাজার ফুট উচুঁতে উড়ে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটে ইন-শা-আল্লাহ্ আমরা ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করবো।
অবশেষে মিনিট পাঁচেক’র মধ্যেই বিমান নামক আশ্চর্য্য এ বাহনটি প্রায় শ’দুয়েক যাত্রী নিয়ে উড়াল দিলো আকাশে। নিচে পড়ে রইলো আদিল-ইউনূছদের ক্লান্তিকর বাস জার্নি, অপু-কাজল ভাইয়ের খুঁজে ফেরা বন্ধ রেঁস্তোরা, সোহেল’র চোখ জুড়ানো ঘুম আর বিধান এর ইমিগ্রেশন দর্শন! আর আমাদের সবার শহর ঢাকা, আমাদের বাংলাদেশ।
বিমান আমাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ৩৪ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো মেঘ রাশির ভেতর দিয়ে, কখনো বা আবার মেঘের উপর দিয়ে, তারও উপরে তাকালে দেখা মেলে শুধু নীল আর নীল আকাশ!
বিমানের কেবিন ‘ক্রু’ ইতোমধ্যে খাবার পরিবেশন শুরু করেছেন। যথারীতি আমাকেও একটি মিনি ট্রেতে করে খাবার দেওয়া হলো। খাবার আইটেমেও ছিল যেন ঈদ আয়োজন। সেমাই, কেক, চিজ বন ও একটি করে কোমল পানীয়।
অনেক উঁচু থেকে ছোট ছোট পাহাড়ের অস্তিত্ব অনুভব করছি, ভাবছি আমরা নেপাল’র সীমানায় ঢুকে পড়েছি। কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা এলো আমরা নামতে যাচ্ছি ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ধীরে ধীরে আমাদের বহন করা বিমানটি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে রানওয়ে ছুঁইছুঁই করছে। পাহাড় কেটেই যেনো এয়ারপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। নিচে সারি সারি বাসা-বাড়ি, রাস্তাঘাট, আর পাহাড়ের চূড়ায় সমান্তরাল যেন এক টুকরো এয়ারপোর্ট!
বিমান ল্যান্ড করার সময়টা কারো জন্যই সুখকর ছিলো না। যেন মনে হলো বিমানের চাকাটা রানওয়ে ছুঁয়েই জাম্প করে আবার আকাশে উঠে গেল, তার ১০/১৫ সেকেন্ড পর আবার রানওয়ে ছুঁলো। পিছন থেকে তো ইতোমধ্যে ভয়ের সোরগোল শুরু হয়ে গেলো। আমি এই ল্যান্ডিং’র সাথে আগেও দুইবার পরিচিত থাকলেও এবার সাবার সাথে ভয়টা আবারো মনে অল্প সময়ের জন্য জায়গা করে নিয়েছিল। অবশেষে পাইলটের দক্ষতার জন্য সফলভাবেই আমরা রানওয়ে স্পর্শ করলাম। আমাদের বন্ধু ইউনূছ তো বলেই ফেললো মনে হলো শেষ মিনিটে আমি যেন লোকাল বাসের শেষ সিটে বসা ছিলাম!!!
দুঃসহ এই ল্যান্ডিং’র পরও আমরা সবাই না হেসে থাকতে পারলাম না।
এয়ারপোর্টে নেমেই মনে হলো এখনো অনেক পিছিয়ে নেপাল। তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। ধীরে ধীরে এয়ারপোর্টের কাজ চলছে। একতলা বিল্ডিং বিশিষ্ট এয়ারপোর্ট দেখে মনে হলো অনেক পুরোনো। তবে এয়ারপোর্টের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। চারদিকে পাহাড় ঘিরে আছে যেন নিরাপত্তার চাদরে। মাঝে মাঝে মেঘ এসে খেলা করে পাহাড়ের সাথে! তবে সবচেয়ে আশার কথা বিভিন্ন দেশ থেকে যে ভাবে পর্যটক আসছে নেপালে, দেখে মনে হয় শুধু মাত্র এই পর্যটন শিল্প ধরে রাখতে পারলেই নেপাল আজকের এ নেপাল থাকবে না। পরিবর্তন আসন্য।
নেপাল আর আমাদের দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই। অথচ তারা পর্যটন শিল্পে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের কতোই না অবহেলিত পর্যটন শিল্প!
বিমান থেকে নেমেই বাসে উঠলাম, এই বাসে করেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। তারপর আমরা সবাই একে একে ইমিগ্রেশন রুল মেনে লাগেজ কাউন্টার থেকে লাগেজ কালেক্ট করে বেরিয়ে পড়লাম এয়ারপোর্ট এর বাইরে। আগে থেকেই বলা ছিলো আমাদের জন্য পাকিং এ গাড়ি থাকবে, আমরা বেরিয়ে গাড়ি খুঁজতে লাগলাম। প্রথমেই ঘটলো বিপত্তি। ইতোমধ্যে এক মেয়ে এসে আমার কাছে জানতে চাইলো আমরা মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল এ যাব কিনা। আমি না বলায় মেয়েটি চলে গেল।
তারপর আবার আমাদের খোঁজা শুরু হলো। মিনিট দশেক খুঁজেও কোথাও পেলাম না। হঠাৎ দেখি সেই মেয়েটি আমরা যে ক্লাবের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি, সেই প্লেকার্ডটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কি আর করা! আবার আমি আস্তে আস্তে মেয়েটির কাছে গেলাম এবং বললাম আমরা তো এই ক্লাবের মাধ্যমেই এসেছি। মেয়েটি কিছুটা বিরক্ত হলো আমার ওপর। না জানি পারলে প্লেকার্ডটি ছুড়ে মারে আমার দিকে!
বললো ঠিক আছে আমার সাথে আসো। মেয়েটিকে বললাম তুমি যে হোটেলের নাম বলেছ আমরা তো সেই হোটেলে উঠবো না। মেয়েটি বললো, তোমাদের এ হোটেল থেকে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমরা শুধু থাকবে অন্য হোটেলে কিন্তু লাঞ্চ, ডিনারসহ যাবতীয় সব এ হোটেলেই হবে। অবশেষে গাড়িতে ৩০ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে পাঁচ তারকা মানের হোটেল মাউন্ট এভারেস্টের লবিতে পা রাখলাম। সময় তখন দুপুর ২টা।
স্বপ্না...
আমাদের নেপাল’র অভ্যন্তরীণ গাইড স্বপ্না। লবিতে যাওয়ার সাথে সাথেই নিজের পরিচয় দিয়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন। এবং বললেন নেপালে কোথাও কোনো সমস্যায় পড়লে তাকে যেন মনে করি। আমরা তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য তৈরি হলাম।
যেহেতু আমরা নেপালে গিয়েছিলাম প্যাকেজ এ তাই আমাদের আর কিছুই করতে হয়নি। সব কিছুই যেন অধিকতর সহজ মনে হয়েছে। যেখানেই গিয়েছি সব কিছু যেন আগে থেকেই তৈরি ছিল আমাদের জন্য। তাই তেমন বেগ পেতে হয়নি।
দুপুর আর রাতের খাবারের জন্য বুফে ব্যবস্থা ছিল। আমাদের সোহেল তো খুব খুশি খাবার দেখে। দেশেও তার নাম আছে খাবার দাবারের ব্যাপারে। আর তার উপর বুফে আইটেমের শেষ নেই, সব খাবারেই ছিল বাংলা আর ইন্ডিয়ার সংমিশ্রণ। সোহেলের খাওয়া দেখে মনে হয়নি যে কোনো খাবার সে বাদ দিয়েছিল! তার রেকর্ড ছিল শেষ রাতে এক সাথে ৮টি মিষ্টি খাওয়ার। যদিও সে রাতে সে আমার সামনে আসেনি লজ্জায়। খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা না হলেও কিন্তু বুফেতে ১৫/২০ আইটেমের খাবার সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হতো দুপুর কিংবা রাতে। দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৪টার মাঝখানে ঘণ্টা তিনেক বিরতি দিয়ে আবার রাত ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলতো খাবারের পসরা। সেই সাথে রাতে থাকতো বাহারি গানের আয়োজন ও বিভিন্ন দেশের ড্যান্স শো। রাতজুড়ে চলে লাইভ কনসার্ট।
নেপালে থাকাকালিন একদিন শুভ্রদেব এবং পরদিন মনির খানের সাথে দেখা ও তাদের গান শুনার সুযোগ হয়েছিল। তাই ক্লাব প্যাকেজ মূল্যে বিমানে যাওয়া-আসা, তিনরাত চারদিন থাকা-খাওয়া এবং হাফডে সাইট সিইং সহ কাটমন্ডুতে ২৭,৫০০ টাকা জন প্রতি খুব একটা বেশি ছিল বলে আমাদের মনে হলো না।
এবার চলুন, বন্ধুদের গল্পর বিরতি দিয়ে জেনে নেই নেপাল সর্ম্পকে...
নেপাল: বই-পুস্তক আর ইন্টারনেট ঘেটে যতদূর জানা গেছে, মা এবং মাতৃভূমি স্বর্গ থেকেও প্রিয় নেপালিদের কাছে। হিমালয় ঘেরা এশিয় দেশ নেপাল। যার উত্তরে চীন এবং দক্ষিণে ভারত সীমান্ত।
আবহাওয়ার দিক থেকে নেপাল আদ্র আবহাওয়াবিশিষ্ট। তার সাথে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট নেপালকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময়।
বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস থাকলেও এখানে প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
‘নেপাল’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। জনপ্রিয় মত অনুসারে নেপাল নামটি দু’টি শব্দ থেকে সৃষ্টি হয়েছে, যার একটি ‘নে’ অন্যটি ‘পাল’। ‘নে’ শব্দটির অর্থ ‘পবিত্র’ আর ‘পাল’ অর্থ ‘গুহা’। অর্থ্যাৎ পবিত্র গুহা। নেপাল’র বছর শুরু হয় মধ্য এপ্রিল থেকে, আর সাপ্তাহিক ছুটি শনিবার। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নেপাল এ অব¯তিব্বত, যার নাম মাউন্ট এভারেস্ট বা সাগরমাতা। এভারেস্টের উচ্চতা ২৯০২৮ ফুট। চীন ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ এই শৃঙ্গে প্রথম আরোহন করা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে।
স্বয়ম্ভুনাথ বা মাংকি টেম্পল: এই মন্দিরটা গড়ে উঠেছিল প্রায় ২ হাজার বছর আগে। সোনা মোড়ানো আর ভাস্কর্যের বিপুল সমারোহ দেখে সবাইকে অবাক হতেই হয়। স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরের চারপাশে বহু ছোট ছোট মন্দির। আর এসব মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকান পাট। তবে বেশির ভাগ দোকানেই ধর্ম সম্পর্কীয় জিনিসে ঠাসা।
আরও জানা যায়, এই পাহাড়ে বৌদ্ধমন্দির নির্মাণ হয়েছিল ৪৩০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। আর ওই সময় থেকেই এটি হয়ে উঠে বৌদ্ধদের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান।
বানরের আনাগোনায় আর লম্ফ-ঝম্পে আমাদের সময়টা বেশ ভালই কেটেছিলো। তবে সবাই সতর্ক ছিল,পাছে বানর আবার ছোঁ মেরে কিছু ছিনিয়ে নেয় হাত থেকে!
এই পাহাড় সম্পর্কে আরও জানা গেল, নিজ থেকেই নাকি স্বয়ম্ভুনাথ পাহাড়টি একদিন জেগে উঠেছিল, আর তাই নামকরণ করা হয়েছিল স্বয়ম্ভুনাথ বা স্বয়ং সৃষ্ট। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ভিক্ষুরা এখানে দিক্ষা নিতে আসতেন। আর এক সময় মোঘলরা এখানে সোনার খোঁজে আসেন। তাদের আক্রমনে মূল অংশটা ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে রাজা পরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে আবার স্বয়ম্ভুনাথ ফিরে পায় তার পুরনো চেহারা।
দরবার স্কোয়ার: একসময় এখানে ছিল নেপালি রাজবংশের প্রাচীন রাজধানী। নেপাল এ পুরোনো রাজকীয় এলাকায় এসব মন্দির ও অন্যান্য স্থপনাগুলো গড়ে উঠেছে রাজা রত্নমল্ল ও রাজা পৃথ্বী শাহের সময়। দরবার স্কোয়ারগুলি নেপালে যারা পুরাতন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিশিষ্ট অবশিষ্টাংশ হয়, বিশেষ করে একীকরণের আগে, সেখানে তিনটি সাম্রাজ্যর অর্ন্তগত কাঠমন্ডু অধিষ্টিত হয়। সব চেয়ে বিখ্যাত হলো কাঠমন্ডু দরবার স্কোয়ার, যা ইউনোস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থান পেয়েছে।
পাটান: নেপালের একটি অন্যতম শহর পাতান। কাঠমন্ডুর দক্ষিণাংশে অবস্থিত পাতান। উঠতি সাংস্কৃতিক সভ্যতার জন্য পাতান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এর ঐতিহ্যবাহী চারু ও কারু শিল্পের জন্য।
উৎসব এবং পাবর্ণের শহরও এটি। প্রাচীন আর্ট একে সূক্ষ্ম প্রাচীন শিল্পের শহর হিসেবে বিদেশিদের কাছে পরিচিতি দিয়েছে। এছাড়া পাথর আর ধাতব দ্রব্য কেনার জন্য পৃথিবীতে পাতারের জুড়ি মেলা ভার।
নাগরকোট: নাগরকোট নেপালের কাঠমন্ডুর একটি গ্রাম। এ গ্রামের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ঘর থেকে বের হলেই এখানকার অধিবাসীদের ছুঁয়ে যায় মেঘ। দরজা খুললেই খণ্ড খণ্ড মেঘের ভেলা। হিমালয়ের প্রতিবেশী এ গ্রামটি আবার পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থিত। ভূমি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৭২০০ ফুট।
হিমালয়ের বুকে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্যও উপভোগ করা যায় এ গ্রাম থেকে। এ গ্রামের আরও মজার বিষয় হলো আমরা যখন আকাশ দেখার জন্য কোনো বিস্তৃত মাঠে এসে দাঁড়াই, তখন এ গ্রামের অধিবাসীরাই হয়ত আকাশ দেখতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক যেনো স্বর্গ থেকে মর্ত্য দেখার মতো। পাঠক ভাবতে পারছেন...
যেহেতু আমাদের সময় প্রায় শেষের দিকে, তাই নাগরকোট দর্শনের মধ্যে দিয়ে আবার কাঠমন্ডুতে ফিরে আসতে হলো। আমরা ঘণ্টা দুয়েক নাগরকোট অবস্থান করে মেঘের ফাঁকে হিমালয় সীমানা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা শেষে ফিরে এলাম হোটেল লবিতে। দুপুর প্রায় শেষের পথে, এদিকে ‘পেটে রাক্ষস’ পেটের ভেতর উথাল পাতাল শুরু করেছে। কাজেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম বুফে লাঞ্চে।
আগামীকালই আমাদের দেশে ফেরার কথা। তাই দুপুরের খাবার খেয়েই শপিং করার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম। বিকেল ৪টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত আমরা নিজেদের মতো করে মানিব্যাগ থেকে টাকা সপে দিতে থাকলাম নানান বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে বসা দোকানিদের।
১৪ আগাস্ট ২০১৩, সকাল ৭টা...
আজ আমাদের বিদায়ের দিন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গুছিয়ে নিয়েছি যার যার ব্যাগগুলো। সকালের নাস্তার টেবিলে সবাই যেন নীরব। কারো মুখে হাসি নেই। আরাম আয়েশ যা ছিল সবই আজ বিসর্জন দিয়ে ফিরে যেতে হবে আগের গন্তব্যে। যার যার কর্ম ক্ষেত্রে। শুরু হবে আবার ব্যস্তময় দিন। একটু পরেই আমাদের গাড়ি চলে আসলো হোটেল লবিতে। যাত্রা করতে হবে ত্রিভুবন এয়রপোর্টের দিকে।
সকাল ১০টায় পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। কিন্তু এখানে এসে শুনলাম আমাদের বিমান ৩ ঘণ্টা ডিলে! কি আর করা! ইমিগ্রেশন করে আমরা ডিউটিফ্রি শপে ঘোরাফেরা আর ফ্রি ওয়াই ফাই নেট নিয়ে বসে পড়লাম। ঘণ্টাখানেক পর অবশ্য বিমান কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য হালকা খাবারের ব্যবস্থা করলো।
সবাই মিলে প্রায় শ’দুয়েক যাত্রী। অবশেষে বিকেল ৩টার দিকে বাংলাদেশ বিমানের সেই বিলম্বিত ফ্লাইটটি নেপাল এয়ারপোর্ট স্পর্শ করলো আরও নতুন শ’দুয়েক পর্যটক নিয়ে। নেপালে আসা নতুন পর্যটকরা হয়তো আমাদের মতোই আবার আনন্দে মেতে উঠবেন, হয়তোবা আমাদের চেয়ে একটু বেশিই! আমরা ফিরে যাচ্ছি, আর আমাদের শূন্যস্থান পূরণ করতে বাংলাদেশ থেকে আরও শ’দুয়েক পর্যটক নিয়ে বিমানের এভাবে আনাগোনা চলতে থাকবে। হয়তো কারও সফর শেষ দিয়ে শুরু হবে, নতুন কারও সফর! হয়তো ফিরে আসার সময় সবাই বলে উঠবে আমাদের মতোই, গুডবাই নেপাল! দেখা হবে আবার!! হয়তো তোমাকে, নয়তো আবার নতুন কোনো দেশ!!!
নেপাল ভ্রমণের কিছু জরুরি তথ্য:
১. বাই এয়ারে নেপাল যেতে ভিসা নিতে হয় না। শুধু বিমানের টিকেট করে নিলেই হয়। সাথে এক কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিতে হয়। নেপাল এয়ারপোর্ট নেমে ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে ছবিসহ জমা দিলেই ভিসা পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় অন-এরাইবেল ভিসা। তবে বাই রোডে নেপাল যেতে হলে অবশ্যই ভারতের ভিসা নিতে হবে।
২. আপনি অবশ্যই এয়ারপোর্টে ২/৩ ঘণ্টা আগে যাবেন, কেননা বেশ কিছু নিয়ম মেনে আপনাকে উঠতে হবে আপনার কাঙ্খিত যাত্রাপথের বিমানে।
৩. আপনি নেপাল বা যে দেশে ভ্রমণে যাচ্ছেন, সে দেশের ভিসা সম্পর্কে আগেই জেনে নিন। অর্থাৎ আপনার ভিসার প্রকার কি, কতো দিনের ভিসা, কোথায় বা কতোদিন থাকবেন ইত্যাদি। কেননা এ সব কিছুই আপনাকে একটা মিনি ইন্টারভিউ’র মাধ্যমে ইমিগ্রেশন অফিসারকে আশ্বস্ত করতে হতে পারে। ইমিগ্রেশন বিভাগ চাইলে (যে কোনো দেশের ইমিগ্রেশন বিভাগ) আপনার ভ্রমণ বাতিল করারও ক্ষমতা রাখে।
৪. নেপাল’র আছে নিজস্ব নেপালি রুপি। তবে আপনি ইচ্ছে করলে ভারতীয় রুপিও চালিয়ে নিতে পারেন না ভাঙিয়ে। তবে অন্য দেশের টাকা হলে আপনাকে মানি এক্সচেঞ্জ থেকে পরিবর্তন করে নিতে হবে।
৫. নেপালে মানি এক্সচেঞ্জ করার ব্যবস্থা আছে, তাই টাকা পরিবর্তন করার আগে আপনি বেশ কিছু মানি এক্সচেঞ্জ ঘুরে যাচাই করে টাকা পরিবর্তন করুন।
৬. নেপালে কোনো ঝামেলায় পড়লে অবশ্যই আপনি ট্যুরিস্ট পুলিশ’র সাহায্য নিতে পারেন। পর্যটকদের জন্য নেপাল সরকার আলাদা ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর মাস শেষে তো ‘ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখকদের জন্য থাকছেই বিশেষ আকর্ষণ...
আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- [email protected] এই ঠিকানায়
লেখক: নাদিম নেওয়াজ আহমেদ
ফটোগ্রাফার ও সম্পাদক, আই ম্যাগাজিন বিডি
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৬, ২০১৪
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর