ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

ধরাছোঁয়ার বাইরে ইউনাইটেড, খুঁটির জোরে মন্ত্রী!

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৫
ধরাছোঁয়ার বাইরে ইউনাইটেড, খুঁটির জোরে মন্ত্রী!

ঢাকা: ‘যারা মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট, তাদের সঙ্গে ঝামেলায় যাবো! আমাদের ঘাড়ে কয়টি মাথা, যে ওই টাকা আদায়ে চাপ দেবো। ’

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) শত কোটি টাকা পাওনা কেন আদায় হচ্ছে না? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নে সংস্থাটির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার উত্তর ছিলো এমনই।



এ বিষয়ে কথা বলাও এমন স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে যে, নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা।

বেসরকারি এয়ারলাইন্সটির কাছে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাবদ ১০০ কোটিরও বেশি অর্থ পাওনা দাঁড়িয়েছে এয়ারলাইন্সের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির।  

ওই কর্মকর্তা জানান, দেড় বছর ধরে এই অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেবিচক। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। গত দেড় বছরে মাত্র তিন কোটি ২৪ লাখ টাকা আদায় হয়েছে।

একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের কাছে দেশের সব বিমানবন্দরের অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই অসহায়ত্বের খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া গেল প্রকৃত রহস্য।

জানা গেলো, সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আর্শীবাদপুষ্ট হয়েই বেবিচককে থোরাই পাত্তা দিচ্ছে ইউনাইটেড। আর ওই মন্ত্রীর কারণেই এই অর্থ আদায়ে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বেবিচক।

সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে শুরু হয় বেবিচকের পাওনা পরিশোধে টালবাহানা।   একই সঙ্গে চলতে থাকে নানা ধরনের অনিয়ম। ফ্লাইট পরিচালনায় সেবার মান শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেও বহাল তবিয়তে চলে এর কার্যক্রম। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর হলেও, যাত্রীরা ভ্রমণ শেষে হয়রানি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করলেও তাতে পাত্তা দেয়না ইউনাইটেড।  

এরই মধ্যে ইউনাইটেড এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্বে নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ত‍াকে তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সূত্র জানায়, অনিয়ম করে শেয়ার বাজার থেকে ৪১৫ কোটি টাকা তুলে নেওয়া, বেবিচকের ১০০ কোটি টাকা পাওনা না দেওয়া, মালিকানা দ্বন্দ্বসহ নানা অভিযোগের মুখে  গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবির পদত্যাগ করেন।

এ অবস্থায় গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেডের সব ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় এক যাত্রী সঠিক সময়ে বিদেশে যেতে না পেরে এয়ারওয়েজটির বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ মামলাও ঠুকে দেন।
   
পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন তাসবিরকে শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাময়িকভাবে চেয়ারম্যান করা হয় এয়ারওয়েজের অন্যতম মালিক মাহতাবুর রহমানকে।

এরপর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ফের ফ্লাইট অপারেশন্স শুরু করে। কিন্তু  বেবিচকের পাওনা, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি থেকে এখনো নিজেকে সরিয়ে আনতে পারে নি।

এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এয়ারওয়েজটির বিরুদ্ধে জমতে থাকে অভিযোগের পাহাড়।

একবার কলকাতার আকাশে বিদেশি একটি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় ইউনাইটেড। ঢাকার আকাশে উড়োজাহাজের ককপিটের গ্লাস ভেঙে দুই বৈমানিক আহত হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে তাদের। সেবার মান এতোই খারাপ যে এয়ারলাইন্সটি ‘গরুর গাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

এতকিছুর পরেও নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ পাতে ইউনাইটেড। শেয়ার বাজার থেকে ৪১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর নতুন করে আবার টাকা তোলার উদ্যোগ নেয়। এ দফায় তাদের এ পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বেবিচক।  

এরপরই বেবিচকের অর্থ যাতে দিতে না হয় সেজন্য তারা নতুন করে পরিকল্পনা আঁটে ইউনাইটেড।  

সেপ্টেম্বর মাসের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নতুন এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান নিয়োগ হয় ইউনাইটেডে। তিনি ড. এ কে আবদুল মুবিন। এই আকস্মিক নিয়োগে পরিস্থিতি ইউনাইটেডের নিয়ন্ত্রণে যেতে থাকে।

ড. একে আবদুল মুবিনের কারণেই প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হতে শুরু করে বেসরকারি এয়ারলাইন্সটি। আর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসে বেবিচকের কণ্ঠস্বর।

নাম প্রকাশ না করে এয়ারলাইন্স সংশ্লিষ্টরা ড. মুবিনের নিয়োগের কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন বাংলানিউজের কাছে। আর তার অন্যতমই হচ্ছে বেবিচকের পাওনা অর্থ দেওয়ার চাপ থেকে নিজেদের মুক্ত করা।
একই সঙ্গে শেয়ার বাজার থেকে আবারও টাকা তোলার ফন্দি আঁটছে ইউনাইডেট এমন জোর গুঞ্জন রয়েছে। আর এয়ারওয়েজটির উড়োজাহাজ কেনার দুর্নীতিও এখন অনেকটা ধামাচাপা পড়েছে।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই এয়ারওয়েজের ১১টি উড়োজাহাজের অর্ধেকের বেশিই অচল রয়েছে। যখনই কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় তখন একটি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ খুলে আরেকটিতে লাগিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে ফ্লাইট। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ফ্লাইটসূচি ঠিক থাকে না।

অথচ এসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেবিচক আর কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মন্ত্রীর প্রভাব আর নির্বাহী চেয়ারম্যানের ক্ষমতায় ইউনাইটেড এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম-পিআর এন্ড মার্কেটিং সাপোর্ট) কামরুল ইসলামের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি দাবি করেন, ইউনাইটেডের পাওনা পরিশোধ কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের সঙ্গে মন্ত্রীর কিংবা চেয়ারম্যানের কোনও ধরনের প্রভাব নেই।

তিনি বরং এ বিষয়ে সরকারকেই দোষারোপ করেছেন।

কামরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ কমানোর দাবি করা হয়েছে। সরকার বিষয়টি কমানো আশ্বাসও দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা কমানো হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘন্টা, এপ্রিল ১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।