সুন্দরবন থেকে ফিরে : ``ও ভাই তুমি কনে? বনে মানুষ পুড়েছে (বাঘে মানুষ মেরে ফেলেছে)। লাশ পাওয়া যাচ্ছে না।
কোনো রকমে নামাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়েন গণি। বাইরে এসে জানতে পারেন জোতিন্দ্রনগর এলাকার সাইফুলকে সুন্দরবনের দাঁড়গাঙ এলাকা থেকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে। লাশ আনতে না পেরে তার সঙ্গীরা ফিরে এসেছেন এলাকায়।
লাঠি-সোঁঠা, আর কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ট্রলারে করে দাঁড়গাঙ এলাকার দিকে রওনা হয়ে যান গণি। মশাল জ্বালিয়ে বনের ভেতর ঢুকে ওই এলাকায় গিয়ে গণি ও তার সঙ্গীরা সাবধানী ভঙ্গিতেই খুঁজতে থাকেন বাঘের পায়ের ছাপ, লাশ টানার দাগ, মানুষের রক্ত, হাড় গোড় বিবিধ। হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে একটি লাশের টুকরা। তারা পেয়ে যান কাঙ্ক্ষিত সাইফুলকে।
লাশের আশেপাশে বাঘ থাকতে পারে এমন আশঙ্কায় সবাই মিলে চিৎকার আর লাঠি দিয়ে কয়েকবার গাছের গায়ে বাড়ি দিতে দিতে লাশের দিকে এগিয়ে যান তারা। কাছে গিয়ে দেখতে পান সাইফুলের দেহের নিম্নাংশ খেয়ে ফেলেছে বাঘটি। গন্ধে পিছিয়ে যায় কয়েকজন। এগিয়ে যান গণি। হাত দিয়ে লাশের বেরিয়ে যাওয়া নাড়ি-ভুড়ি পেটের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে লাশটি কাঁধে তুলে নেন তিনি।
পিছনে সঙ্গীদের পাহারা নিয়ে নৌকায় আসতে আসতে গণি লক্ষ্য করেন লাশের একটি হাতের কব্জি খুলে পড়ে গেছে। একটু নিচু হয়ে সেটি তুলে নিজের পকেটে রাখেন।
এরপর নৌকা করে লাশ নিয়ে এসে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন তিনি। শোকার্ত পরিবেশে দাফন শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে পকেটে হাত দিতেই গণির খেয়াল হয় পকেটে থাকা হাতের কব্জিটি দাফনের সঙ্গে দেয়া হয়নি।
এরপর পকেট থেকে সাইফুলের কব্জিটি বের করে নদীর পানিতে ধুয়ে তার পরিবারের লোকদের সহায়তায় সেটি কবরে দিয়ে আসেন গণি।
এই গণি শ্যামনগরের কালিঞ্চী গ্রামের আব্দুল গণি। যাকে সুন্দরবন এলাকার মানুষেরা চেনে ``গণি টাইগার`` নামে।
এভাবেই বাঘের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার শিকারে পরিণত হওয়া নিহতের লাশ উদ্ধার করে তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কাজ করেন তিনি।
গণি টাইগার এখন বনজীবীদের দুঃসময়ের বন্ধু। গণির ভাষায়- ``যেখানে শোকের ছায়া, সেখানেই আমি। `` ২৪ ঘন্টার জন্য খোলা থাকে গণির মোবাইল ফোন। যাকে সে বলে হট লাইন। হটলাইনে খবর পেয়ে লাশ আনতে বনে-বাদাড়ে ছুটে যান গণি। কখনো অনেক দূরে গিয়ে পাওয়া যায় বাঘের আহার শেষে ফেলে রাখা নিহত মানুষের শরীরের কিছু অংশ।
পচা-গলা সে অংশগুলোকেই পরম মমতায় আগলে নিয়ে আসেন গণি। নিহতের শেষ চিহ্নটুকু তুলে দেন তার পরিবারের হাতে। দাফন না হওয়া পর্যন্ত ওই পরিবারের সঙ্গে থাকেন গণি। লাশ খোঁজা থেকে শুরু করে দাফন না হওয়া পর্যন্ত একফোঁটাপানিও গ্রহণ করেন না তিনি। লাশ খুঁজতে খুঁজতে কখনো-সখনো দুই থেকে তিন দিনও পার হয়ে যায়।
২০০৭ সাল থেকে এ কাজ করে যাচ্ছেন গণি। এ পর্যন্ত ৭৩টি লাশ বন থেকে নিজের কাঁধে করে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। লাশ আনার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে গণির বর্ণনা এরকম- ``বনে পাওয়া লাশ কখনো টাটকা থাকে না। ``
মানুষের মল, রক্ত, নাড়ি-ভুড়ি সব মিলিয়ে বীভৎস এক অবস্থার তৈরি হয়। লাশ কাঁধে তুলে নিতে আমি পিছপা হই না। কারণ, ওরা আমার ভাই। ওই লাশটার অপেক্ষায় থাকে তার মা-বাবাসহ পুরো পরিবার। ``
গণি বলেন, ``মানুষের গলিত লাশ কাঁধে করে আনার সময় পঁচা মাংস মুখে দিয়েও দেখেছি আমি। `` এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, ``নাড়ি-ভুড়ি বের হওয়া পচা লাশের উৎকট গন্ধ যাতে আমায় আর কষ্ট না দেয়- সে কারণে আমি তাদের পচা মাংস মুখে দিয়েছি। এতে করে তাদের প্রতি ভালবাসা বেড়েছে আমার। ``
সুন্দরবনে যারা জীবিকার প্রয়োজনে ছুটে বেড়ায় তাদের সবার কাছে আছে- গণি টাইগারের হটলাইন নম্বর। বনের ডাকাতদলও চেনে তাকে। সম্মানও করে তারা। তবে গনি জানান, তার জীবনটা শুরু থেকে এমন ছিল না। প্রচণ্ড অভাবে দিন কাটত তার। ঘরে ২ কেজি চালও থাকত না। বাঘ আর ডাকাতের ভয়ে জীবিকার জন্য বনে যেতে ভয় পেতেন।
কিন্তু আয়ের অন্য কোনো উপায় না থাকায় মাঝে মাঝে বনে যেতেই হত তাকে। ২০০৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লুৎফর গাইন ও আমীর আলীর একটি দল বনে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতে চায় গণিকে। কিন্তু ভয় আর আলসেমির কারণে তাদের সঙ্গে যাননি তিনি।
কিন্তু দুপুর ২টার দিকে খবর আসে আমীর আলীকে বাঘে নিয়ে গেছে। নিজের সঙ্গীর এমন খবর পেয়ে আর বসে থাকতে পারেন না। নৌকায় কয়েকজন লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এমন সময় কয়েকজন বিদেশি তাদের সঙ্গে যেতে চায়।
একই নৌকায় তুলে নেন তাদের। বনের ভিতর অনেক খোঁজার পর চারপাশে পায়খানা, লালা, রক্ত, ডান পা বিহীন মুখ হা করানো একটি লাশ দেখতে পান তারা। বিদেশি দলটি লাশটির ছবি তোলে। তাদের হাতের ক্যামেরাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দেখে বেশ মজা পান গণি।
এরপর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশটি কাঁধে তুলে নেন তিনি। গ্রামে এনে খালে ফেলে নিজ হাতে গোসল করান। বাহবা দেয় বিদেশি দলটি। লাশটির দাফন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সঙ্গে থাকে বিদেশি দলটি। তারা যাওয়ার আগে গণিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে যায়- এমন সাহসী কাজের জন্য।
এরপর থেকে এ কাজে বেশ অনুপ্রেরণা পান গণি।
এর মাঝে একটি এনজিওর তত্ত্বাবধানে গ্রামে তৈরি হয় ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম। ছয় জনের দলে অন্তর্ভুক্ত হন গণি। তারা পেয়ে যান টর্চলাইট, লাঠি, বাঘে ধরা রোগীর চিকিৎসার কিছু প্রাথমিক সরঞ্জাম আর একটি ট্রলার।
এতে করে এখন প্রায় ২৪ ঘণ্টায় বনে বনে ঘুরে বেড়ান তিনি। দুঃসাহসিক এ কাজের জন্য তিনি এখন মাসিক কিছু বেতনও পান। এখন বেশ স্বচ্ছলভাবেই চলছে তাদের চার জনের সংসার।
এখন গণির কাজ শুধু বাঘ বা অন্য কারণে নিহত ব্যক্তির লাশ খুঁজে আনাই নয়। এ এলাকায় বন থেকে বাঘ উঠে এলে বাঘটিকে না মেরে সুস্থভাবে বনে পাঠানোও গণির দলের কাজ।
এভাবে বন থেকে উঠে আসা চারটি বাঘকে বনে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
``গ্রামে বাঘ এলে গ্রামবাসীকে সতর্ক করা, বাঘটিকে পালাতে সাহায্য করা, সুন্দরবন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। বাঘের হামলায় নিহত বা আহত হওয়া মানুষটিকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়াই আমার টিমের কাজ`` --বলেন গণি।
তার দলের এ তৎপরতায় এখানকার মানুষ সুন্দরবনকে রক্ষায় এখন সচেতন হয়েছেন। সুন্দরবনের বিভিন্ন রেঞ্জেই এখন টাইগার টিম কাজ করে। সুন্দরবনের ৬৩টি এলাকার মধ্যে ২৯টিতে টাইগার টিম কাজ করে চলেছে। গণি এখন সাতক্ষীরা রেঞ্জের ফরেস্ট রেসপন্স টিমের প্রধান।
গণি জানান, তার এ সাহসী কাজের স্বীকৃতি তিনি অনেক পেয়েছেন। এ এলাকার মানুষের ভালবাসাই তার প্রমাণ। এছাড়া ২০১০ সালে থাইল্যান্ডের রাজকন্যাও বাংলাদেশে এসে দেখা করেন গণির সঙ্গে।
সে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে গণি বলেন, ম্যাডামের কথা আমি কিছু বুঝিনি। কিন্তু তিনি আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এছাড়া গণি উদ্ধার করেছেন ডাকাতের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত ফরেস্ট অফিসারের লাশ। খুঁজে দিয়েছেন তাদের হারানো অস্ত্রও।
এসব কাজে কয়েকবার বাঘের মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাকে। একবারতো লাশ আনতে গিয়ে বাঘ তেড়ে আসে তার দিকে। কিন্তু সাহস, নিজের জানা কিছু কৌশল আর পিছন থেকে এগিয়ে আসা সঙ্গীদের কারণেই সেবার বেঁচে ফেরেন গণি। ``আল্লাহর রহমত আর গ্রামবাসীর দোয়ায় সে বিপদ থেকে উদ্ধার হয়ে এসেছি``-- বলেন গণি।
গণি আরো বলেন, আমার উদ্ধার করা ৭৩টি লাশের ৭৩ রকম গল্প আছে। সেসব বলে বোঝানোর মত নয়, শুনলে গল্প মনে হবে। কিন্তু এখানকার মানুষের কাছে এসব গল্প নয়, জীবনের বাস্তবতা। আর এমনই বাস্তবতার মধ্য দিয়েই চলছে সুন্দরবনজীবীদের জীবন।
গণি কথা বলেন শুদ্ধ বাংলায়।
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি নিজের নামটাও স্বাক্ষর করতে জানতাম না। কিন্তু এ কাজে আসার পর শহর থেকে আসা মানুষদের কথা শুনে শুনে আমি এখন অনেক ইংরেজি কথা বুঝতে শিখেছি। ভালভাবে কথা বলতে শিখেছি।
এসব কাজে এখন তার পরিবার থেকেও অনুপ্রেরণা মেলে গণির। গণি বলেন, আমার বউ এমন খবর শুনলেই বলে, তাড়াতাড়ি যাও। ও জানে আমি গেলে লাশটা তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে।
জীবনের সময়টা মানুষ আর সুন্দরবনের প্রয়োজনেই ব্যয় করতে চান টাইগার গণি। বলেন, আমি চাই না এভাবে আরো লাশ উদ্ধার করতে হোক। তবে চাই নিরাপদে সকল মানুষ বন থেকে তাদের জীবিকা নিয়ে ফিরে আসুক।
বাংলাদেশ সময় : ১২২৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১২
জেপি/ সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর
[email protected];
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর