ঢাকা: রূপচর্চা, অশ্লীলতা বা নগ্নতা নিয়ে নয়, মেধা আর কর্মদক্ষতা দিয়েই নারী বড় হয়। দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে নারী-পুরুষ উভয়ের যোগ্যতা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে।
এ মন্তব্য অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ (এডাব) চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের ((বিএনপিএস) প্রতিষ্ঠাতা রোকেয়া কবীরের।
সম্প্রতি বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
``এ সময় টেলিভিশনে নারীদের রূপচর্চার যত অনুষ্ঠান হয়, নারীশিক্ষার জন্য তত অনুষ্ঠান হয় না`` বলে অতৃপ্তি প্রকাশ করেন একাত্তরে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্লাটুন কমান্ডার রোকেয়া কবীর।
দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ``বর্তমানে নারীরা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলোর সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে। নারীর দেহকে পুঁজি বানিয়ে বড় বড় কোম্পানিগুলো বিশাল মুনাফা লুটে নিচ্ছে। ``
এক প্রশ্নের জবাবে ``কোনো নারী অভাবের তাড়নায় দেহ বিক্রি করলে তার কাজটাকে পতিতাবৃত্তি না বলে শ্রম বিক্রি হিসেবে দেখা যেতে পারে`` বলেও মন্তব্য করেন রোকেয়া কবীর।
``নারী আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়`` দাবি করে তিনি বলেন, ``নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের জন্যই নারী আন্দোলন। গণতন্ত্র বা কোনো অধিকারের আদায় বা বাস্তবায়ন অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে বাদ দিয়ে হয় না। ``
বিয়ে বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ``জীবনটাই বোঝাপড়ার। কিন্ত নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করা সম্ভব নয়। যখন বনিবনা হয় না, তখন বিয়ে বিচ্ছেদই সমাধান। ``
``বাংলাদেশে মোল্লাদের কারণে নারীনীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না`` অভিযোগ তুলে রোকেয়া কবীর আরো বলেন, ``ধর্মের নামে মিথ্যা কথা বলে মোল্লারা নারীনীতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। যারা নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে, তারা জাতীয় উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেশে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চাইছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করতেই তারা এসব অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। ``
এছাড়া নারী উন্নয়নের অন্যান্য প্রতিবন্ধতা, আসন্ন বাজেটে তাদের প্রত্যাশা, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ও উঠে আসে তার বক্তব্যে।
বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তার সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
বাংলানিউজ: আপনার শিক্ষা, কর্ম ও ব্যক্তিজীবনে নারীচেতনা নিয়ে কিছু জানতে চাই।
রোকেয়া কবীর: আমি নেত্রকোনা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল ও ঢাকার সরকারি বদরুন্নেছা কলেজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। স্কুলজীবন থেকেই খেলাঘর শিশু সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বদরুন্নেছা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা ৩ বোনই ঢাকায় পড়াশোনা করেছি। আমি এদেশে নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন চাই। যেখানে নারী অবহেলিত হবে না। সব মানুষই তার সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে।
বাংলানিউজ: অনেক সামাজিক ইস্যুর ভেতর থেকে কাজ করার জন্য নারী বিষয়টিকে বেছে নিলেন কেন? কেন আপনার কাছে নারী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ?
রোকেয়া কবীর: ব্যাপারটার শুরু ছোটবেলা থেকে। আমি দেখেছি আমার মা শুধু বাড়িতে ঘরের কাজ করতো। অনেক সম্ভাবনা বা মেধা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার যোগ্যতাকে কোনো কাজে লাগাতে পারেননি। এ ব্যাপারটা আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। তখন থেকেই আমার ইচ্ছে ছিলো নারীদের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি পরিবর্তনে কিছু করবো।
সব সামাজিক ইস্যুই জরুরি। কিন্তু একটি সমাজের অর্ধেক মানুষ নারী । গণতন্ত্র বা কোনো অধিকারের বাস্তবায়ন অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে হয় না। আমাদের সংস্কৃতি ও রীতিতে পুরুষকে ভাবা হয় রক্ষক, প্রতিপালক, জন্মদাতা ও হুকুমদাতা। আর নারীকে দেখা হয় অধীনস্ত, ঘরকুনো ও সেবাদাত্রী। তাই পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযাগ্য ভূমিকা রাখবে ৷ দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে নারী-পুরুষ উভয়ের যোগ্যতা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে। এভাবেই গণতন্ত্র বাস্তবায়িত হবে।
বাংলানিউজ: জাতীয় বাজেটে নারীদের জন্য বিশেষ বাজেট আন্দোলন করছেন আপনারা। আগামী বাজেটে নারীদের জন্য আপনারা কি চান? কেন চান?
রোকেয়া কবীর: আমরা বিজ্ঞান, তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বাজেটে উপযোগী বরাদ্দ চাই। তাই নারীকে দক্ষ মানবসম্পদে উন্নীত করার জন্য ১৯টি সুপারিশ করেছি। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বাজেটেকে নারীসংবেদী করার একটি প্রচেষ্টা ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। আমাদের এক যুগের অভিজ্ঞতা বলছে, বাজেটে কেবল বরাদ্দ বাড়ানোই শেষ কথা নয়। নির্দিষ্ট বরাদ্দের ব্যয় নিশ্চিত করা, ব্যয়ের যথাযথ পরিবীক্ষণ করা এবং যে উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা---এসব না-থাকলে বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দ থাকলেও তা নারীর উন্নয়নে যথাযথ ফল দেবে না।
শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীর সমান অভিগম্যতা চাই। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এ আহ্বানকে সরকারসহ আমরা সবাই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। সরকারের গৃহীত উদ্যোগ কতটা নারীসহায়ক হয়েছে, না-হলে তার সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায় তা খতিয়ে দেখতে এবার আমরা বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গত তিন বছরের (২০০৯-১০ থেকে ২০১১-১২) বাজেট বিশ্লেষণ করেছি । এ বিষয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রণীত হতে যাচ্ছে, তা প্রধানত তৃণমূল পর্যায়ের নারী-পুরুষ, সমাজকর্মী, নাগরিক সমাজ, সংবাদজনদের সচেতন ও তথ্যসমৃদ্ধ করার জন্য; যাতে সব মহলের সক্রিয় প্রচেষ্টা ও উদ্যোগী ভূমিকায় নীতিনির্ধারক মহল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা নারীর ক্ষমতায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়।
বাংলানিউজ: আপনারা সরকার, রাজনৈতিক দল, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কতটুকু সমর্থন পেয়েছেন? আপনাদের তহবিল আসছে কোথা থেকে?
রোকেয়া কবীর: বর্তমান সরকার সমর্থন দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ( আইডিবি) সহযোগিতা করে থাকে। জাতিসংঘ নতুন করে ‘ইউএন উইম্যান’ নামে নতুন শক্তিশালী সংগঠন করেছে। এছাড়াও জার্মানি, বেলজিয়ামের বিভিন্ন সংগঠন থেকে আমরা অর্থ ও অন্যান্য সহযোগিতা পেয়ে থাকি। তবে ব্রাক বা বড় বড় এনজিওর মতো সাহায্য পাই না। আশা করি, আগামীতে এসব ক্ষেত্রে আমরা আরও এগিয়ে যাবো। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সহযোগিতা করছে।
পুরুষের তুলনায় বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী নিরক্ষর এবং অল্প শিক্ষিত হওয়ার কারণে তথ্যসংযোগের মাধ্যমেই বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সচেতন করে তোলা যায়। সরকারি মাধ্যম বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা দেখেছি, স্বাস্থ্যরক্ষা এবং পুষ্টি বিষয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে, যদিও তা পর্যাপ্ত নয়।
সরকারের গণযোগাযোগ অধিদপ্তর নারী উন্নয়নের ওপর বছরে ১,৬০০ টিরও অধিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০টি নারীবিষয়ক প্রবন্ধ এবং ৪টি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়। তথ্য অধিদপ্তর গড়ে প্রতি বছর নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত ২৬০টি, প্রেস ইনস্টিটিউট ২০০টি এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ১০০টি ফিচার প্রচার ও প্রকাশ করে থাকে। এসব কার্যক্রম নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য নিরসনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে সন্দেহ নেই। এসব কাজ আমাদের সহযোগিতা করছে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারভুক্ত ‘রূপকল্প ২১’ এর আওতায় বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ, যে স্বপ্নের বাস্তবায়নে তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তিই প্রধান হাতিয়ার। নারী উন্নয়নের জন্য সরকারের আরো সুনির্দিষ্ট ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও অঙ্গীকার রয়েছে; যার মধ্যে উল্লেখ করতে হয় ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ ও ২০১১ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আহ্বানের কথা।
বাংলানিউজ: আগামীর কেমন বাংলাদেশ চান? আপনার সংগঠন নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? আপনারা নারীদের জন্য কি করছেন?
রোকেয়া কবীর: বাংলার মানুষ যে ধরনের একটি দেশের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছিলো সেই স্বপ্নের দেশের প্রত্যাশা করি।
আমি এদেশে নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন চাই। যেখানে নারী অবহেলিত হবে না। সব মানুষই তার সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে। নারী-পরুষ সমান অধিকারভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাজই আমাদের কাম্য।
আপনি জানেন যে, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) ১৯৯৯ সাল থেকে জাতীয় বাজেটের জেন্ডারভিত্তিক বিশ্লেষণ শুরু করেছে এবং ২০০০ সালে প্রথম জাতীয় বাজেটে নারীর ন্যায্য হিস্যার দাবি উত্থাপন করেছে। এরপর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত আমরা এই কাজটি অব্যাহত রেখেছি। পরবর্তী সময়ে এদেশের অন্য অনেক সংস্থাও জাতীয় বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবিটি সামনে তুলে এনেছে। আমরা আগামীতেও এই ধরনের কাজ করবো। আমরা আমাদের পরিধির মধ্যে বস্তিবাসী নারীদের নিয়ে কাজ করছি। ঢাকার বিভিন্ন বস্তি, নেত্রকোনা, নড়াইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপে আমরা কাজ করছি। আগামীতে আমরা কাজের পরিধি ও এলাকার পরিধি বাড়াবো। আমরা সন্দ্বীপের জন্য একটি কমিউনিটি রেডিও করার কথা ভাবছি।
বাংলানিউজ: নারী সংগঠনগুলোর দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছু বলুন।
বাংলানিউজ: নারী সংগঠনগুলোর দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সবদেশেই এটি অন্যতম প্রধান ইস্যু।
পশ্চিমা সংগঠনগুলো জাতিসংঘের মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকসহ জীবনের নানা পর্যায়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা চালিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি বের করার প্রয়াস পেয়েছে। যাতে নারীর অধিকারগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে জাতিগুলোর স্বকীয় চেতনা ও বৈশিষ্ট্যের যে দেয়াল বা অন্তরায় রয়েছে তা নির্মূল করা যায়। এসব চেষ্টারই সারসংক্ষেপ সিডও তথা নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ।
সিডও এসে নারী অধিকারকে মানবাধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। যা তাকে নারী অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণায় রূপ দেয়। এ চুক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নাগরিকসহ সব অঙ্গনে নারী-পুরুষের অধিকারে পূর্ণ সমতার দাবি জানায়। এতে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য চুক্তিকে আইনিভাবে বাধ্যতামূলক হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব রাষ্ট্রের নারীর প্রতি বৈষম্যকে সমর্থনকারী সব প্রকার স্থানীয় আইন ও বিধান বাতিলের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে।
বাংলানিউজ: মিডিয়ায় নারীর অবস্থান নিয়ে আপনার মতমত দিন। বর্তমান পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন কিভাবে করছেন।
রোকেয়া কবীর: মিডিয়াতে নারীদের অবস্থান আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পদে সংখ্যায় তারা কম। সম্পাদক, প্রতিবেদক, নির্মাতা, গবেষক, লেখক, ভিডিওগ্রাফার, প্রচারক বা প্রযোজকের পদে বা দায়িত্বে নারীদের খুব কমই দেখা যায়। বরং উপস্থাপনাতে বেশি দেখা যায়। এভাবে তারা বড় পদবঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশের মিডিয়ায় নারীদের অবস্থান আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হলেও সার্বিকভাবে তারা এখনও প্রান্তিক পর্যায়েই রয়েছে। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সবার আগে প্রয়োজন সবার মানসিকতার পরিবর্তন। মিডিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ দিন দিনই বাড়ছে। বাংলাদেশের মিডিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এ পেশার সর্বোচ্চ পদে নারীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
বর্তমান মিডিয়ায় নারীদের নেতিবাচক সংবাদের পাশাপাশি ইতিবাচক সংবাদও প্রকাশিত হচ্ছে। নারী একটি পণ্য হিসেবে মিডিয়ায় আসছে। কারণ নারীদের রূপচর্চার যত অনুষ্ঠান হয়, নারীশিক্ষার জন্য তত অনুষ্ঠান হয় না। বর্তমানে নারীরা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলোর সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে। নারীর দেহকে পুঁজি বানিয়ে বড় বড় কোম্পানিগুলো বিশাল মুনাফা লুটে নিচ্ছে। অথচ এখানে নারীরা প্রতিনিয়তই সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর বা সাংবাদিক রুনির ঘটনা দেখুন। নানা বাজে কথা ছড়ানো হয়েছে। রুমানা মঞ্জুরের পরকীয়া সম্পর্ক, অসততা, স্বামী কর্তার প্রতি দায়িত্বশীলতা নিয়ে মিডিয়া বিস্তর দোষারোপ করতে শুরু করেছিলো। মিডিয়ায় ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এভাবে কেন আসবে? ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, লাক্সের বিজ্ঞাপন মেয়েদের বুদ্ধি বিবেকের চেয়ে রূপচর্চাকে উৎসাহিত করে। টিভি চ্যানেলগুলোর সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এভাবে নারীদের পণ্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তবে সাংবাদিকতায় মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলানিউজ: অনলাইন মিডিয়ার অগ্রগতি ও বাংলানিউজ নিয়ে আপনার অনূভুতি কি রকম?
রোকেয়া কবীর: গণমাধ্যম খুবই গতিশীল মাধ্যম। অনলাইন মিডিয়া প্রতি মিনিটের আপডেট দিচ্ছে। এখন সিরিয়া বা লেবাননে কি ঘটছে তা জানতে আর দেরি হয় না। আমি নিজে বাংলানিউজ এবং বিদেশি অনলাইনগুলো দেখি। এখানে খুব দ্রুত তথ্য পাচ্ছি। তবে নির্ভুল ও নিরপেক্ষ সংবাদ দেওয়ার চেষ্টা থাকতে হবে। একটি সংবাদ অনেক প্রভাব রাখে। তাই সতর্কতার সঙ্গে এই প্রভাবকে ব্যবহার করতে হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে অনলাইন মিডিয়াই অগ্রগণ্য হবে। তবে অনলাইনগুলোকে গ্রামের সাধারণ মানুষের আরও কাছে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলানিউজ: নারীর কর্তৃত্ব, নাকি বোঝাপড়ার সম্পর্ক কোনটি প্রতিষ্ঠা হলে ভালো হয় বলে মনে করেন? তালাক বা সেপারেশন কি সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে না?
রোকেয়া কবীর: সংসারে অবশ্যই বোঝাপড়া থাকতে হবে। জীবনটাই বোঝাপড়ার। কিন্ত নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করা সম্ভব নয়। যখন বনিবনা হয় না, তখন তালাকই সমাধান। অনেক কিছুইতো সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়, আপনারা সেসবের দিকেও দৃষ্টি দিন। নিজের জীবনটাই আসল নারীর জন্য। সে যেভাবে ভালো থাকবে সেভাবেই থাকা উচিত।
বাংলানিউজ: প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি কি পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন।
রোকেয়া কবীর: বাংলাদেশে মোল্লাদের কারণে নারীনীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ইসলাম শান্তি ও সাম্যের ধর্ম । ইসলামে উত্তরাধিকার সম্পদে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেখানে তো সমান অধিকার দিতে বাধা দেয়া হয়নি। ধর্মের নামে মিথ্যা কথা বলে মোল্লারা নারীনীতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে ।
যারা নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে, তারা জাতীয় উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেশকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চাইছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত করতেই তারা এসব অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। কারণ, তারাই এসব আন্দোলনে জড়িত। অথচ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে নারীরা সমান অধিকার পাচ্ছে।
এছাড়া নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ (সিডও বা কনভেনশন অন দি এলিমিনেশন অব অল ফরমস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন) সনদ বাস্তবায়নসহ ১৯৯৭ সালের প্রায় সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নতুন নীতিমালায়।
১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ন নীতিমালায় বলা হয়, অর্জিত সম্পদসহ ভূমির ওপর অধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ ও সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হবে। কিন্ত এদেশে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিও পরিবর্তন হয়। এতে নারী উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে।
সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ধারা বাতিল করতে একটি কট্টরপন্থি মুসলিম গ্রুপ কাজ করছে। নারীর অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিল। আশাকরি সম্পদে নারীর সমান অধিকার আইনটি বাস্তবায়ন হবে। বাবার সম্পদে মেয়েরা সমান ভাগ না পেয়ে ভাতিজা বা অন্যরা পাবে এটা মেনে নেয়ার মতো না।
তবে ভারত বা পকিস্তানের চেয়ে আমাদের দেশের নারীরা অনেক বেশি অধিকার ভোগ করছে। ভারতে দলিত নারীরা কোন অধিকারই পাচ্ছে না। অর্থনৈতিভাবে বড় ভারতের চেয়ে আমাদের অগ্রগতি আশাপ্রদ। তবে নেপাল ও ভুটানে ঐতিহ্যগতভাবে নারীরা অনেক অধিকার ভোগ করে।
বাংলানিউজ: শুধু কি নারী আন্দোলন দিয়ে সমাজে শান্তি আসবে? আপনারা পুরুষের ভূমিকা, ধর্ম, মূল্যবোধ এসবের মূল্যায়ন করেন কিভাবে? লেখিকা তসলিমা নাসরীনের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কি?
রোকেয়া কবীর: নারী আন্দোলন কিন্তু পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের জন্য নারী আন্দোলন। সমাজের সব ব্যাপারেই উন্নয়নের মাধ্যমে শান্তি আসবে।
তসলিমা নাসরীনের ব্যপারে বলবো, আমরা আমাদের সব কথা সহজে জানাতে পারি না। তিনি পারেন। একজন লেখকের অধিকার রয়েছে নিজের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার। তিনিও তাই করেছেন। তার লেখাতে কারো সম্মানহানি হলে বা মিথ্যে থাকলে তার প্রমাণ দিন। কিন্ত তাকে বাধা দেওয়া অনুচিত। আমরা সব মেয়েই কমবেশি নানাভাবে নানা সময়ে পরিবার, আত্মীয়, সহপাঠী, কলিগদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হই। সবাই প্রকাশ করি না। তসলিমা নাসরীন লেখার মাধ্যমে সেই সত্যকে প্রকাশ করেছেন। তিনিও লেখার মাধ্যমে নারী আন্দালন করছেন।
বাংলানিউজ: নারীমুক্তির জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে নারীদের অন্তরায় মনে করেন কি? যেমন পর্ন ইন্ডাস্ট্রি, অশ্লীল সিনেমা তৈরি, উগ্র প্রসাধন- এসব কি নারীদের উন্নতির পথে অন্তরায়?
রোকেয়া কবীর: ব্যপারটা হলো নারীনেত্রী হয়ে আমি স্লিভলেস ব্লাউজ পরলে সমালোচনা হয়। গ্ল্যামার জগতের নারীরা কি করে সেটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। কিন্ত বস্তিবাসী একটি মেয়ে সবার সামনে যখন গোসল করে, অভাবের তাড়নায় যখন একটি মেয়ে রাতে নিজের দেহ বিক্রি করে--- সেটাকে আপনি পতিতাবৃত্তি না শ্রম বিক্রি হিসেবে দেখবেন তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
গরিব মেয়েরা টাকার অভাবে কাপড় পড়তে পারে না তখন কিন্ত সমালোচনাকারীরা কাপড়ের ব্যবস্থা করে না। তাই দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর এসবের মুল্যায়ণ হবে। তবে নারীকে পণ্য বানানো অবশ্যই নারীদের জন্য ক্ষতিকর ও উন্নতির অন্তরায়। কারণ নারী বড় হয় মেধা বা কর্মদক্ষতা দিয়ে। রুপচর্চা, অশ্লীলতা বা নগ্নতা নারীকে বড় করে না। নারীও একজন মানুষ। মানুষের যেভাবে মূল্যায়ন হয় নারীরও সেভাবেই মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
বাংলানিউজ: দীর্ঘ সময় দেবার জন্য অপনাকে ধন্যবাদ।
রোকেয়া কবীর: আপনাকেও ধন্যবাদ।
রোকেয়া কবীরের জীবন বৃত্তান্ত
অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ(এডাব) চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের ( বিএনপিএস)প্রতিষ্ঠাতা রোকেয়া কবীর। জন্ম ১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনায়। মা সাইয়্যেদা বদরুন্নেসা, বাবা সৈয়দ মোহাম্মদ খান। মার্কুস ওয়ালডভোগেলকে জীবনসঙ্গী করেছেন তিনি। নেত্রকোনা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল ও ঢাকার সরকারি বদরুন্নেছা কলেজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। বদরুন্নেছা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী সংসদেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
রোকেয়া কবীর একাত্তরে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। নিজে প্রশিক্ষণ নিয়ে একাত্তরের মে পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে, পরবর্তী সময়ে আগরতলায় ক্যাম্পে ক্যাম্পে মেয়েদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান থেকে শুরু করে ক্যাম্পের যাবতীয় কাজ করেছেন পর্যায়ক্রমে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময় অস্ত্র সমর্পণের পর নারী মুক্তযোদ্ধা প্ল্যাটুনের কমান্ডার রোকেয়া কবীরের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেন মুক্তিযোদ্ধারা।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের সঙ্গে এদেশের তৃণমূল নারীদের যোগসূত্র স্থাপনের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। তৃণমূল সংগ্রামগুলোর বৈশ্বিক যোগাযোগের জন্য তিনি এবং আরো কয়েকজন নারী আন্দোলনের কর্মী মিলে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ। নানা সংকট সত্ত্বেও তিনি নারী অধিকার, সংখ্যালঘু ইস্যু এবং মৌলবাদের বিপক্ষে কাজ করছেন।
বাংলার মানুষ যে ধরনের একটি দেশের স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছিলো সেই স্বপ্নের দেশের প্রত্যাশা করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১২
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]