ঢাকা, বুধবার, ৯ বৈশাখ ১৪৩২, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

দুই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে জামায়াত

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
দুই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে জামায়াত

ঢাকা: ২০১৩ সাল থেকে নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পলায়নের আট মাস পরেও দলটি ফিরে পায়নি নিবন্ধন ও প্রতীক।

শুধু তাই নয়, আট মাস পেরিয়ে গেলেও নিষ্পত্তি হয়নি জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষ নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের মামলা।

এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন সময় দলীয় কর্মসূচিও পালন করেছে। বার বার হতাশাও প্রকাশ করেছেন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিয়েছে দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। তবে বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী দলটির আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

এ আইনজীবীর মতে, সময় যা লেগেছে সবই আইনগত প্রক্রিয়ার কারণে। দ্রুতই এ আইনগত প্রক্রিয়া শেষে জামায়াতে ইসলামী প্রতীকসহ নিবন্ধন ফিরে পাবে। তখন হতাশা দূর হয়ে যাবে। আর এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা দ্রুত শুনানি হবে বলে আশা করছেন আইনজীবী শিশির মনির।

জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন।

রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। তারা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আরজি জানান।

এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসর গেছেন) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের (বর্তমানে অবসর) হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।

হাইকোর্টের রায়
২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হয়। একই বছরের ১ আগস্ট  জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়ে ৫ আগস্টের পর পদত্যাগ) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের (১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন) সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।

সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে ওই রায়ের বিষয়ে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।

আপিল বিভাগের রায়
২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের ওই আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এদিন আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমীর ও আহসানুল করীম। জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর (পরে প্রয়াত) পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জিয়াউর রহমান।

ওইদিন আইনজীবী জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধা ছিল। আর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনও অনুপস্থিত ছিলেন। এই ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে ছয় সপ্তাহ সময় চেয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের আইনজীবীরা উপস্থিত নেই, সেহেতু আদালত এটা ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ করেছেন। অর্থাৎ আইনজীবী উপস্থিত না থাকার কারণে খারিজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আইনি সুযোগ কী আছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রিস্টোর (পুনরায় শুনানির জন্য) আবেদনের সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে এটা আদালতের এখতিয়ার।

এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ফের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। গত জুলাই মাস থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। এ আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ছাত্র-জনতা সরকার পদত্যাগের দাবি তোলে। এর মধ্যে ১ আগস্ট সরকার অঙ্গসংগঠনসহ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের আবেদন বাতিলের উদ্যোগ নেয়। গত ২৮ আগস্ট সরকার আগের নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে।

আপিলের পুনরুজ্জীবন
এরপর আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করে জামায়াতে ইসলামী। গত ২২ অক্টোবর আদালত বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি শুনানির জন্য রিস্টোর করেছেন। অর্থাৎ পুনরুজ্জীবিত করেছেন। পরে ৩ ডিসেম্বর থেকে শুনানি শুরু হয়। এর মধ্যে একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকায় মামলাটি আর শুনানি হয়নি।

আদালতে জামায়াতের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী শিশির মনির। ইসির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।

আইনজীবীর বক্তব্য
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে মামলাটি আংশিক শ্রুত (আপিল শুনানি চলমান) হিসেবে ছিলো। বেঞ্চের একজন বিচারপতি হঠাৎ করে অসুস্থ হন। তিনি প্রায় এক মাস কোর্টে আসতে পারেননি। তারপর আবার আদালত এক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আমরা আশা করেছিলাম শুনানি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করে বিচারপতি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে শেষ করা যায়নি। এখন কোর্ট খুলছে (২০এপ্রিল )। আশা করি দ্রুতই নিষ্পত্তি হবে। আমরা এই মামলায় ভালো রেজাল্ট পাবো বলে প্রত্যাশা করি।

দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশার বিষয়ে তিনি বলেন, যদিও একটু বিলম্ব হচ্ছে অসন্তুষ্টি হতে পারে। দেশে বিদেশে জামায়াতের কর্মী, সাথী, সমর্থক কোটি কোটি মানুষ আছে। সকলের দৃষ্টিভঙ্গি তো আর এক রকম হবে না। উদ্বিগ্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তাদের উদ্বেগকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখি। তারপরও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সঠিক নিয়মে জামায়াত যখন তার রেজিস্ট্রেশন ফিরে পাবে আশা করি, সকলেরই হতাশা দুর হবে এবং খুশি হবে।

দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে এ আইনজীবী বলেন, অনেকের মধ্যে সন্দেহ প্রতীক পাবে কি না। আমরা এরকম আইনি উদ্যোগ নিচ্ছি যে প্রতীক ফেরত পাওয়া যাবে, একইসাথে রেজিস্ট্রেশনও পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

এটিএম আজহারুল ইসলাম
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা-হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো ৯ ধরনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রটারি জেনারেল এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে।

ট্রাইব্যুনালের রায়
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে ২ নম্বর, ৩ নম্বর এবং ৪ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পান আজহারুল ইসলাম। এ ছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অমানবিক অপরাধের দায়ে ২৫ বছর ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

আপিল বিভাগের রায়
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে শুনানির পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। আপিল বিভাগের রায়ে ২, ৩, ৪ (সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে) ও ৬ নম্বর অভিযোগের দণ্ড বহাল রাখা হয়। আর ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়।

ওই দিন আদালতে আসামিপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী (প্রয়াত) খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন (প্রয়াত) অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

রিভিউ
২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। ওই রায়ের রিভিউ চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট আবেদন করেছিলেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। ২৩ পৃষ্ঠার পুনর্বিবেচনার এ আবেদনে মোট ১৪টি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।

ওই পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এটিএম আজহারুল ইসলামকে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এছাড়া দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দিতে বলেছেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক ও আইনজীবী শিশির মনির।

আইনজীবীর বক্তব্য
শিশির মনির বলেন, লিভ মঞ্জুর (পুনরায় আপিল শুনানির জন্য) হয়েছিলো। সে আদেশ স্বাক্ষর হয়েছে। আগামী ২০ তারিখের মধ্যে আপিলের সব আনুষ্ঠানিকতা (সার সংক্ষেপ জমা ও আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত করা) শেষ হয়ে যাবে। আশা করি ২১ এপ্রিল আদালতে উপস্থাপন করতে পারবো যথারীতি যেন ২২ তারিখে এটি শুনানির জন্য ওপরের দিকে থাকে। এ জন্য আদালতের কাছে আমরা প্রত্যাশী ২২ তারিখ যেন শুনানি হয়। আমি খুব আশাবাদী।

বাংলাদেশ সময়: ০০০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
ইএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।