ঢাকা, বুধবার, ১২ আষাঢ় ১৪৩২, ২৫ জুন ২০২৫, ২৮ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ইসরায়েল কার্যত হেরে গেছে, ১২ ঘণ্টায় পাওয়া যায়নি সংঘাতের খবর

আশরাফুর রহমান আকন্দ, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪৮, জুন ২৪, ২০২৫
ইসরায়েল কার্যত হেরে গেছে, ১২ ঘণ্টায় পাওয়া যায়নি সংঘাতের খবর

ইসরায়েলের সঙ্গে উত্তপ্ত সংঘাতের মধ্যেই দেশটির মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কয়েকটি পারমানবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। প্রতিশোধ নিতে কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান।

তবে হঠাৎ করেই থেমে যায় সংঘর্ষ। ইসরায়েল জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির আহ্বান তারা মেনে নিচ্ছে। অপরদিকে তেহরান জানায়, দখলদার ইসরায়েল আগ্রাসন বন্ধ রাখলে তারাও হামলা বন্ধ রাখবে। দুই দেশের মধ্যে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক শান্তি চুক্তি হয়নি। ইরানও ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো চুক্তি করবে না। কেননা, দেশটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতিই দেয়নি।

ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ও ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবন্ধের কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে গত ১২ ঘণ্টায় দুই পক্ষে কোনো হামলা পাল্টা হামলার খবরও মেলেনি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল থানির মধ্যস্থতায় ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।  

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের আমিরকে ফোন করে জানান, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে এবং ইরানকে রাজি করাতে দোহাকে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ করেন। এরপর কাতারের প্রধানমন্ত্রী ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইরানের সম্মতি আদায় করেন। এই সমঝোতা হয় সোমবার রাতে আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এও জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর দুই পক্ষের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু কোনো পক্ষই এ ঘটনা স্বীকার করেনি।

ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে কার অবস্থান কোথায়?
কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পর ইসরায়েলের অষ্টম সর্বোচ্চ জনবহুল শহর বিইরসেবায় ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ ঘটনায় নিহত হন ১৫ জন। নিহতদের মধ্যে চারজন ছিলেন ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা।

মূলত, এই ঘটনার ১২ ঘণ্টা পর দুই পক্ষের কোনো হামলার খবর পাওয়া যায়নি। যদিও ইসরায়েল অভিযোগ করেছে, ইরান যুদ্ধবিরতি ভেঙে হামলা চালিয়েছে। তবে তেহরান সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে এই সংঘাতে ‘ইসরায়েল কার্যত হেরে গেছে’। যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায়, দখলদার রাষ্ট্রটি সুবিধাজনক স্থানে নেই।

মধ্যস্থতায় কাতার, সমঝোতায় যুক্তরাষ্ট্র, চুক্তি কার সঙ্গে
ইরানের মিত্র রাশিয়া ও চীনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চাচ্ছে। তা ছাড়া কাতারের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমিত করতে চাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কাতার এরইমধ্যে তেহরানের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেছে। তবে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাই নেই। কেননা, ইরান ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তেহরানের দৃষ্টিতে ইসরায়েল একটি দখলদার রাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষই পুরো ভূখণ্ডের বৈধ সরকার। ফলে কোনো চুক্তি হলে, তা ইসরায়েল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হতে পারে।

ইসরায়েল হারল যেখানে
ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করা। একইসঙ্গে তারা চেয়েছিল তেহরানের ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত করে একটি রেজিম চেঞ্জের বাস্তবতা তৈরি করতে। আর কৌশলগতভাবে ইরানকেও গাজার পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিপ্রায় ছিল তেল আবিবের। কিন্তু বাস্তবে কোনো লক্ষ্যই সফল হয়নি।

ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি। পারেনি দেশটির সরকার পতন ঘটাতে, বরং দেশটির জনগণের সঙ্গে সরকারের একটি ঐক্য দেখা গেছে। ইরানও গাজার মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি। তারচেয়ে বরং নিজস্ব প্রতিরক্ষা ও আক্রমণশক্তির প্রমাণ দিয়ে ইরান পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়।

অন্যদিকে ইরানের অর্জন ছোট নয়, বরং কৌশলগত দিক থেকে তারা ইসরায়েলের প্রচণ্ড সামরিক হামলাকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করেছে ‘ইসরায়েল অজেয় নয়’। ইসরায়েল ‘ভয়ংকর এক শক্তি’ এই মিথও ভেঙে দিয়েছে ইরান। তেল আবিব এখন নিজেই গাজার মতো আতঙ্কের শহর।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে রক্ষা করতে পেরেছে। এতে করে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের যেকোনো আগ্রাসনের জবাবে নিজেদের পারমাণবিক শক্তি প্রয়োগের নৈতিক ও কৌশলগত ভিত্তি ইরান পেয়ে গেছে। ফলে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইরান এখন আর শুধু একটি আক্রমণকারী রাষ্ট্র নয়, বরং আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে একটি পরিণত শক্তি।

এই সংঘাতে ইসরায়েল শুধু সামরিকভাবেই নয়, কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবেও পরাজিত হয়েছে। আর ইরান, যুদ্ধের ময়দান থেকে শুরু করে জনমত, সবখানেই শক্তিমত্তার নতুন ব্যাখ্যা তৈরি করেছে।

দুই দেশের ক্ষয়ক্ষতি কত
ইসরায়েলের হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইরানের রাজধানী তেহরান। শহরটি ২২টি পৌর জেলায় বিভক্ত হলেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন তেমন পাওয়া যায়নি। তবে, গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েলি হামলায় ইরানে ৬০৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এদিকে, ইসরায়েল সরকার জানিয়েছে, ইরানের হামলায় তাদের ২৮ নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে আইডিএফ বলছে, এ সংখ্যা কয়েকশ হতে পারে, যা এখনো যাচাইাধীন। নির্দিষ্ট করে আহতের কোনো সংখ্যা জানায়নি আইডিএফ।

ইসরায়েলের বিইরসেবা শহরে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের ঘটনায় গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এবং একাধিক আহতের খবর পাওয়া গেছে। বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর, লজিস্টিকস ঘাঁটি, বিভিন্ন স্তরের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বায়োলজিক্যাল সেন্টারে হামলা চালিয়েছে তেহরান। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে তেল আবিব, নেস সিয়োনা ও হাইফার আবাসিক এলাকাতেও।

ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নেস জিওনা শহরে। সেখানকার ইসরায়েল ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ (আইআইবিআর) সেন্টারে আঘাত করে ইরান। এটি ইসরায়েলের সামরিক ও কৌশলগত ক্ষমতার অন্যতম গোপন গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। আইআইবিআর একটি উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন গবেষণা কেন্দ্র, যা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্র উন্নয়নের গোপন ঘাঁটি হিসেবে কাজ করছিল।

তেহরানের পরিস্থিতি স্বাভাবিকের পথে
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর তেহরানের রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। গণপরিবহনও ছিল প্রায় শূন্য। গত কয়েকদিন ধরে স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মানুষ শহর ছেড়ে নিজ নিজ গ্রামে চলে গিয়েছিল। তারা ফিরতে শুরু করায় তেহরান আগের মতো জনমানুষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। মঙ্গলবার, বাসগুলোয় সিট পাওয়ায় কষ্টকর হয়ে পড়েছিল।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।