ঢাকা, সোমবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২, ০৭ জুলাই ২০২৫, ১১ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

যেখানে সময়ের নেই কোনো মানে

রকিবুল সুলভ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:৪৯, জুলাই ৬, ২০২৫
যেখানে সময়ের নেই কোনো মানে

‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’—নচিকেতার গাওয়া এই গানটি শুনেছেন নিশ্চয়ই। কিংবা কখনো প্রেমিকার চোখের গভীরে হারিয়ে গিয়ে আপনি নিজেও অনুভব করেছেন, যেন সময় থেমে গেছে।

এসব নিয়ে ভাবতে বসলে মনে হয়, সময় কি সত্যিই থেমে যেতে পারে? অথবা সময় কি কখনো তার মানে হারিয়ে ফেলে?

এই ভাবনা নিয়ে আজ আমরা পাড়ি দেবো পৃথিবীর এক অদ্ভুত প্রান্তে—উত্তর মেরুতে, যেখানে সময়ের নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন, যেখানে দিনের সূর্যোদয় কিংবা রাতের আঁধার কোনো অর্থ রাখে না। যেখানে পৃথিবীর ২৪টি সময় অঞ্চলের সব মিলেমিশে একাকার, আর কোনো সময়ের সীমানা নেই।

সেই জগতে সময় শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি একটি রহস্যময় বাস্তবতা, যা আমাদের ধ্যান-জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে। সেখানে প্রতিটি মুহূর্ত যেন নিজেই একটি কাব্য, যেখানে সময়ের কাঁটা না গড়ায়, আর দিন-রাতের বিভাজন যেন দীর্ঘ একরাশ নীরবতা। চলুন, সেই অদ্ভুত পৃথিবীর দরজায় কড়া নাড়ি, যেখানে সময়ের থেমে যাওয়াই প্রকৃতির এক নিঃসঙ্গ কাব্য।  

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। আরভি পোলারস্টার্ন নামে বরফ কাটার একটি জাহাজ ঘন বরফের মাঝে আটকে গিয়েছিল আর্কটিক মহাসাগরের একেবারে মাঝখানে। চারপাশে শুধু বরফ আর শূন্যতা, সেই বিশাল বরফের রাজ্যের মধ্যে ওই জাহাজটিই ছিল একমাত্র দেখা যাওয়ার মতো বস্তু।

এরপর আকাদেমিক ফেদোরোভ নামে বরফ কাটার আরেকটি জাহাজ ধীরে ধীরে ওই জাহাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই জাহাজটি সঙ্গে করে খাবার, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর নতুন কিছু মানুষ নিয়ে যাচ্ছিল। দুই জাহাজের বিজ্ঞানী ও কর্মীরা নিজেদের জাহাজের বারান্দায় সারি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।  

বরফে জমে যাওয়া রেলিং ধরে তারা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তারা দেখতে পাচ্ছিলেন—তাদের বন্ধু ও সহকর্মীরা খুব কাছেই, মাত্র কয়েক কদম দূরে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, এত কাছে থাকার পরও তাদের সময় ছিল আলাদা। তারা ছিলেন দুই ভিন্ন সময়ের মধ্যে।  

উত্তর মেরু এমন এক জায়গা, যেখানে পৃথিবীর ২৪টি সময় অঞ্চল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, যার ফলে সময়ের কোনো নির্দিষ্ট অর্থ থাকে না। অর্থাৎ, সেখানে একইসঙ্গে সব টাইম জোন (সময় অঞ্চল) আছে, আবার যেন কোনো টাইম জোনই নেই।  

সেখানে কোনো সীমানা নেই, কারণ কোনো স্থলভূমি বা মানুষ নেই। সূর্য বছরে মাত্র একবার উঠে এবং একবার ডুবে যায়, তাই সেখানে ‘দিনের সময়’বা সকাল-বিকেলের কোনো গুরুত্ব নেই।

পৃথিবীর আরেক মেরু, অর্থাৎ দক্ষিণ মেরুতে সময়ের হিসাব একটু জটিল হলেও তা কাজে লাগে। সেখানে মাটি আছে, আর বিশাল এলাকাজুড়ে অনেকগুলো গবেষণাকেন্দ্র ছড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ কেন্দ্রে স্থায়ী ঘরবাড়ি থাকে, যেখানে গবেষণার জন্য ল্যাব, থাকার ঘর আর সামাজিক মেলামেশার জায়গা থাকে। যে দেশ যে গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করে, সেটি সেই দেশের সময় অনুযায়ীই চলে।

কিন্তু উত্তর মেরু একেবারেই আলাদা। সেখানে চারদিকে শুধু বরফঢাকা সমুদ্র। মাঝেমধ্যে কোনো গবেষণা জাহাজ বা পথভ্রষ্ট কোনো মালবাহী জাহাজ সেখানে যায়। ওই অঞ্চলে সময় ঠিক করার দায়িত্ব থাকে জাহাজের ক্যাপ্টেনের হাতে। কেউ আশেপাশের দেশের সময় ধরে রাখেন, কেউ আবার নিজের কাজের সুবিধামতো সময় বদলান। ভাবতে অবাক লাগে—এমন জায়গা আছে, যেখানে একজন মানুষ চাইলেই নিজের মতো করে নতুন সময় বানিয়ে নিতে পারে!

অভিযানের সময় পোলারস্টার্ন জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টা করে সময় পেছাতে থাকেন প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে। কারণ, সেখানে যাওয়া রুশ জাহাজগুলো মস্কোর সময় মেনে চলে, তাদের সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিতে এ কাজ করা হয়।  

প্রতিবার সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের চারপাশে থাকা সব ঘড়ির সময় ঠিক করে নিতে হতো। গবেষকরা থেমে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখতেন—ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে উল্টো দিকে ঘুরছে।

প্রতিবার সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে বরফের ওপর বসানো যন্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগ, জাহাজের কাজ, আর দূরে থাকা পরিবার-পরিজন ও সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের সময়ের হিসাব নতুন করে ঠিক করতে হয়। সময়ের এই পরিবর্তনেই প্রতিবার একটু করে নড়ে যায় এই সূক্ষ্ম যোগাযোগের ভারসাম্য।

জাহাজের লোকেরা এমনিতেই বিচ্ছিন্ন, কারণ উত্তর মেরুতে সময় অঞ্চল (যেমন আমাদের দেশের সময়, বিদেশের সময় এসব ভাগ) ঠিকমতো কাজ করে না। তার ওপর আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো—সেখানে দিনের সময় অর্থাৎ সকাল, দুপুর, বিকেল বা রাত—এমনভাবে সময়কে ভাগ করাও যায় না।  

কারণ সূর্য পুরো বছরের মধ্যে একবার ওঠে আর একবার ডোবে। তাই সেখানে সময় বোঝার বা দিন-রাতের মতো যে পরিচিত ধারণা আছে, সেটি একেবারে অর্থহীন। মনে প্রশ্ন জাগে, উত্তর মেরুতে কি তাহলে একদিনের সময় চলে মাসের পর মাস? নাকি এক বছর আসলে শুধুই একদিন?

পোলারস্টার্ন জাহাজ যখন বরফে আটকে ছিল, তখন সূর্য তিন সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে ডুবে গিয়ে পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে দেয়। তখনই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে (দক্ষিণ মেরুতে) সূর্য উঠতে শুরু করে, সেখানেও সূর্য উঠতে উঠতে তিন সপ্তাহ সময় লেগে যায়। এই সূর্য ওঠে কয়েক মাসের অন্ধকার কাটিয়ে।

যখন মেরুর রাত শুরু হয়, তখন চারপাশে শুধুই অন্ধকার বিরাজ করে, শেষ নেই সেই অন্ধকারের। জাহাজের ডেক থেকে চারদিকে তাকালে দেখা যায় সীমাহীন শূন্যতা। কোথাও কোথাও হয়তো কয়েকজন মানুষকে কাজ করতে দেখা যায়, তাদের হেডল্যাম্পের ছোট ছোট আলো অনেক দূরে ঝিলমিল করে জ্বলে—পুরো দৃশ্যটা এমন, যেন কেউ চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

জাহাজের ভেতরের পরিবেশটাও একই রকম অদ্ভুত। দিন নেই, রাত নেই, সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই—তাহলে সেখানে শখানেক মানুষ কীভাবে নিজেদের কাজ চালিয়ে যান?

ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর জাহাজের মাইকে ভেসে আসে। তাকে বলতে শোনা যায়, সকাল ৮টা, সবাইকে উঠতে হবে। কিন্তু সেখানে ‘সকাল ৮টা’ মানে আসলে ঠিক কোন সময়? সেখানে সময়টা শুধু নামেই। সময় মেনে সবাই তখন নির্দিষ্ট নিয়মে খাবার খেতে চলে যান। অবশ্য এসব সময় আগেই ঠিক করে রাখা থাকে। বিজ্ঞানীরা সে অনুযায়ীই বরফের ওপর যন্ত্র পরীক্ষা করতে বের হন বা ল্যাবরেটরিতে সে অনুযায়ীই কাজ করেন।
 
উত্তর মেরুতে জাহাজ এমন একটি খেলনার মতো যা হাতে ঘুরিয়ে চালাতে হয়, পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, যা সাধারণত সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে। সেখানে ‘সময়’ কেবল একটি রুটিনের অংশ, যা নিয়মিত কাজকর্ম চালিয়ে নেওয়ার বাহানা। বাস্তবে সেখানে সময়ের কোনো প্রকৃত চলাচল নেই, শুধু নির্ধারিত কাজগুলো নিয়মমাফিক চালানোর জন্য সময়কে ধরে রাখা হয়।  
 
জাহাজের বিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে খুব সীমিত বার্তা পাঠান দূরের পৃথিবীতে। কিন্তু তাদের বন্ধু বা পরিবারের লোকেরা তো ভিন্ন ভিন্ন টাইম জোনে থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে সময়ের হিসাবটা জটিল হয়ে যায়। এতে মনে হয়, জাহাজের লোকেরা যেন পুরোপুরি সময়ের বাইরে স্থির হয়ে আছেন। এমন ক্ষণিকের বার্তা শুধু সাময়িকভাবে তাদের দূরের পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করে।

উত্তর মেরুতে সপ্তাহ আর মাস গুলিয়ে যায়। সেখানে নেই টেলিভিশন, নেই খবরের কাগজ, কেউ হেঁটে পাশ দিয়ে যায় না। উৎসবের সময় এলে কোথাও দোকানে সাজানো জিনিস দেখা যায় না, গাড়ির রেডিওতে শোনা যায় না উৎসবের গান। ‘ডিসেম্বর’ শব্দটাও সেখানে যেন বানানো বলে মনে হয়। ঘুমের মাঝে নিয়মিত যে কাজগুলো হয়, প্রতিবার তা একই রকম অনুভূত হয়, যেন বারবার একই ‘দিন’ জীবনে ফিরে আসছে।

জাহাজে থাকা দলকে সময়ের বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়া একমাত্র কাজ হলো তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ। জাহাজের চারপাশের বরফে অনেক যন্ত্র বসানো থাকে, যা বরফ, সমুদ্র আর আকাশের বিভিন্ন তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ করে। এসব কাজ চলে নির্দিষ্ট ওয়ার্ল্ড টাইম অনুযায়ী, যেটি আসলে সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।

জাহাজে থাকা লোকেরা তথ্য পর্যবেক্ষণ করে সময়ের চলতে থাকা বুঝতে পারেন। আর যদি তথ্য না থাকে, তাহলে সময় বোঝা যায় শুধু দুইভাবে। দাড়ি বড় হওয়া দেখে বোঝা যায় সময় গড়াচ্ছে। আর যখন জাহাজে গরম রুটির গন্ধ পাওয়া যায়, তখন সবাই বলে ‘আজ রোববার’ (ছুটির দিন)।

যখন বিজ্ঞানীরা জাহাজ থেকে বেরিয়ে বরফের ওপর যান, তখন তারা সত্যিকারের সময়ের বাইরে চলে যান। কিছু যন্ত্র বরফের ওপর অনেক দূরে বসানো হয়, যেখানে হেলিকপ্টার ছাড়া যাওয়া যায় না।

হেলিকপ্টারে যাওয়ার সময় এত অন্ধকার থাকে যে, জানালা দিয়ে তাকালে বোঝাই যায় না বরফ কতটা নিচে। হেলিকপ্টার গবেষকদের নামিয়ে দিয়ে গেলে প্রপেলারের শব্দ দূরে গিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তখন চারপাশে নেমে আসে সুনশান নীরবতা, আর সময়ের কোনো ধারণাই থাকে না।

গবেষকরা বরফের ওপর একসঙ্গে জড়ো হন, তাদের হেডল্যাম্পের আলো অন্ধকারে ছোট একটি আলোর মতো জ্বলজ্বল করে। পুরো দৃশ্যটা দেখলে মনে হবে যেন মহাকাশচারীরা মহাকাশে ভাসছেন। ঠান্ডার জন্য তাদের মাথা ভালো করে ঢেকে রাখা থাকে, তাই তারা শুধু নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পান। এই হৃদস্পন্দনই তাদের সময় বোঝার একমাত্র মাধ্যম।

গবেষকদের সঙ্গে একটি মেরুভালুকও থাকে পাহারাদার হিসেবে, যেটা আঁধারে ঢাকা বরফের এলাকায় ঘোরাফেরা করে। কিন্তু এই ভালুকেরও সময়ের কোনো ধারণা নেই। হয়তো সে শুধু পৃথিবীর ঘূর্ণনের ছন্দ অনুভব করে।

জাহাজের গবেষকদের সঙ্গে ফোনে যুক্ত হওয়ার কাজটা কঠিন। কারণ জাহাজের সময় যেকোনো মুহূর্তে বদলে যেতে পারে। পুরো কাজটা এমন, যেন চোখ বন্ধ করে একটা নড়তে থাকা লক্ষ্যবস্তুর দিকে তীর ছোড়া।

আরএইচ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।