গত বছরের জুলাই আন্দোলনে ব্লক রেইডের মাধ্যমে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া, গুম করা, সীমাহীন নির্যাতন করা, অপহরণ করা, বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং গণগ্রেপ্তার পরিচালনা করা হয়।
এ সকল ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছে শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র ও নিরীহ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পথচারী, শিক্ষক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং রিকশাচালকের মতো দিনমজুররাও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছে।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনের নৃশংস ঘটনাগুলোর সঙ্গে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ইতোমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
নথি ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) কর্তৃক প্রণীত প্রতিবেদনে এই সময়কালে তৎকালীন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা চলমান আন্দোলনে সারা দেশব্যাপী ব্লক রেইডের মাধ্যমে সাধারণ ছাত্র জনতাকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া, গুম করা, সীমাহীন নির্যাতন করা, অপহরণ করা, বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং গণ-গ্রেপ্তার পরিচালনা করার নির্মম দৃশ্যপট অত্যন্ত বিশদভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
গণহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে যে দমননীতির প্রয়োগ করেছে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচারের নীতি লঙ্ঘন করে, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক কার্যক্রম চালিয়েছে এবং পুরুষ ও নারীদের ওপর নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করেছে। এ সকল ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছে শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র ও নিরীহ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পথচারী, শিক্ষক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং রিকশাচালকের মতো দিনমজুররাও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছে। এমনকি এই প্রহসনমূলক কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি শিশুরাও।
জাতীয় দৈনিকের একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, অভিযানে আটককৃতদের প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল সাধারণ নাগরিক ও শিক্ষার্থী, আর ১৫ শতাংশ ছিল বিরোধী দলের ব্যক্তি। শুধুমাত্র আন্দোলনস্থলের আশেপাশে অবস্থান করার জন্য, মোবাইলে আন্দোলনের ছবি বা ভিডিও রাখার জন্য, এমনকি হাসপাতালে যাওয়ার কারণেও বা অফিসে যাওয়ার জন্য বা বাসায় ফেরার পথে বিশেষ করে তরুণদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গ্রেপ্তার চালিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তাদেরকে রাস্তা থেকে ধরে, হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তোলা হয়েছে, কিন্তু তাদের গ্রেপ্তারের কারণ পর্যন্ত জানানো হয়নি। কেবলমাত্র একটি লাঠি তুলতে যাওয়ায় এক শিশুকেও আটক করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক চলমান নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেও কোনো মামলায় নাম না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দিয়ে অসংখ্য ছাত্র জনতাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়। সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার নিয়ম থাকলেও খুবই কম সংখ্যক বন্দিকে আদালতে তোলা হয়। এক শিক্ষার্থীকে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে কোনো কারণ না দেখিয়ে তিনদিন অজ্ঞাত স্থানে আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তারপর আদালতে হাজির করা হয়। নামযুক্ত ও অজ্ঞাতনামা অসংখ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিতের মতো কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও এ সকল গণমামলার ভিত্তিতে পুলিশের আবেদনে আদালত রিমান্ডের আবেদন পর্যন্ত নাকচ করেননি।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ১০ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের মধ্যে ২৫ জন নারী ও ৬৩ জন শিশুও রয়েছে। জাতিসংঘ তার অনুসন্ধানে এমন একটি ঘটনা পাননি যেখানে গ্রেপ্তারের পেছনে কোনো বৈধ ও যৌক্তিক কারণ ছিল এবং যেখানে ন্যায় বিচার অনুসরণ করা হয়েছে; যা ইঙ্গিত দেয় যে, ঘোষিত গ্রেপ্তারের প্রায় সবগুলোই ছিল নির্বিচারের গ্রেপ্তার।
নির্বিচারে গ্রেপ্তারের এসব ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধ (১২৭ নং) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/এসআইএস