বলা হয়ে থাকে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। এই মাছের মধ্যে আবার জাতীয় মাছ ‘ইলিশ’।
ঢাকার বর্তমান বাজারচিত্র অনুসারে, বিগত যেকোনো সময়ের থেকে এবার ইলিশের দাম বেশি। ছোট, বড় ও মাঝারি ইলিশের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বর্তমানে বাজারে একটি ইলিশের দাম দিয়ে দুই মাসের গ্যাস বিল ও পোশাক খাতের একজন শ্রমিকের প্রায় ছয় দিনের মজুরির দেওয়া যায়। ঢাকায় এক থেকে সোয়া কেজি ওজনের একটি ইলিশের দাম প্রায় আড়াই হাজার টাকা, মাঝারি আকারের (৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম) এক কেজি ইলিশের দাম ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। আর ছোট আকারের ইলিশ (৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম) এক কেজির দাম দেড় হাজার টাকার ওপরে। অবশ্য সাগরের ইলিশের দাম এর থেকে কিছুটা কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধি শুধু সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়, অনেক দিন ধরেই ইলিশের দাম চড়া। নদী বা সাগর থেকে ইলিশ আহরণের পর ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে কয়েকটি হাত ঘোরে ইলিশ। প্রথমত জেলের কাছ থেকে যায় মহাজনের হাতে। এরপর আড়তদার হয়ে যায় পাইকারদের কাছে। সর্বশেষ যখন খুচরা ব্যবসায়ী কিংবা পাড়া-মহল্লার বাজারে পৌঁছায়, তখন ইলিশের দাম এমন পর্যায়ে ওঠে যে, তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ১৯ জুন এক কেজি ইলিশের দাম ছিল আকারভেদে এক হাজার থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। ২০১৫ সালে দেশে খুচরা পর্যায়ে ইলিশের গড় দাম ছিল ৫৯০ টাকা। একই সময়ে রুই ও তেলাপিয়ার দাম বাড়েনি। কাতলা ও পাঙাশের দামও কমেছে। ফলে বলার সুযোগ নেই যে অন্য মাছের সরবরাহে ঘাটতির কারণে ইলিশের দাম বাড়তি।
ভোলা-পটুয়াখালী-বরিশাল-চাঁদপুর-ঢাকা: কোথায় কত দাম
গত মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) ভোলার আড়তে জাটকা ইলিশের হালি বিক্রি হচ্ছিল ৬০০-৭০০ টাকা। মাঝারি আকারের প্রতি হালি ইলিশ ১০-১২ হাজার টাকা, আর বড় আকারের হালি বিক্রি হচ্ছিল ১৪-১৫ হাজার টাকায়।
বরিশালের ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) জানান, এদিন বাজারে ৩০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকা (কেজি ১১২৫ টাকা প্রায়)। ৩০০ গ্রামের কম ওজনের গোটলা ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে ৩২ হাজার টাকা। জাটকা ইলিশের মণ ২৭ হাজার ২৮ হাজার টাকা; ৭৫০ থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ ৯০ হাজার টাকা, এক কেজি ওজনের ইলিশের মণ ৯৫ হাজার টাকা, আর এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হচ্ছে এক লাখ দুই হাজার থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার (কেজি ২৬শ টাকা প্রায়) টাকা পর্যন্ত।
অপরদিকে পটুয়াখালীর আলীপুর-মহিপুর বন্দরে দেখা গেছে, এক কেজি থেকে তার ওপরে প্রতিমণ ইলিশ বিক্রি হয় ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা দরে। এ হিসেবে প্রতিকেজি বিক্রি হয় ১৭৫০ থেকে ১৮৭৫ টাকা পর্যন্ত। ৬০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম আকারের ইলিশ বিক্রি হয় ৫৮ হাজার টাকায় (প্রতিকেজি ১৪৫০ টাকা)। এছাড়া ৩০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রামের গোটলা ইলিশ বিক্রি হয় ২১ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে (কেজি প্রায় সাড়ে ৫০০ টাকা)।
ইলিশের রাজধানী বলা হয়ে থাকে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থলের জেলা চাঁদপুরকে। এখানকার ইলিশই তুলনামূলক স্বাদ বেশি। জেলার হরিণা মাছঘাটের ইলিশের আড়তদার সিরাজুল ইসলাম সৈয়াল বলেন, এখন এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪শ’ থেকে ২৬শ’ টাকা। আহরণ বাড়লে দাম কিছুটা কমবে। চাঁদপুরের স্থানীয় ইলিশের চাহিদা বেশি থাকার কারণে সব সময়ই দাম একটু বেশি হয়। কারণ হচ্ছে জেলেরা সরাসরি আড়তে নিয়ে আসে ইলিশ। বরফ দেওয়া থাকে না।
তিনি বলেন, ছোট আকারের ইলিশ পাওয়া যায় বেশি। ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। এসব ইলিশ কেজিতে নয়, হালিতে বিক্রি হয়। প্রতি হালি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর মাঝারি আকারের ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ নেই বললে চলে।
চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পাইকারি ইলিশ বিক্রেতা শামীম হোসেন বলেন, আহরণ কম হওয়ায় স্থানীয় ইলিশের দাম সব সময় বেশি হয়। অবশ্য নোয়াখালী হাতিয়ার ইলিশ প্রতিকেজি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়।
ঢাকার বাজারে ইলিশ যত বড়, তার দর তত বেশি। এখানে সাগর বা কোনো জেলার ইলিশ বলে আলাদা ব্র্যান্ডিং থাকে না। বেশিরভাগ বিক্রেতাই দাম বাড়তি নিতে সব ইলিশকেই পদ্মার বা চাঁদপুরের ইলিশ বলে থাকেন।
ঢাকায় বরিশাল অঞ্চলের এক কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনের ইলিশ আড়তে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই মাছ খুচরায় ২৪শ’ থেকে ২৬শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর পাইকারিতে ১৪শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা, যা খুচরায় বিক্রি হয় ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দর পাইকারিতে কেজি এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা, যা খুচরা বাজারে ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া খুচরায় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ পাইকারিতে ১১শ’ টাকা কেজি, খুচরায় ১৪শ’ টাকা কেজি এবং ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের ইলিশের পাইকারিতে কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে এবং খুচরা বাজারে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে সাগরের বা চট্টগ্রামের বড় আকারের এক থেকে সোয়া কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ১৬শ’ টাকা, ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রামের ইলিশের কেজি ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা এবং ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি এক হাজার থেকে ১৩শ’ টাকা রাখা হচ্ছে। ডিমসহ মাছের দাম এর থেকে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম।
ঢাকায় পৌঁছাতে কোথায় খরচ বাড়ে
ভোলার ইলিশা এলাকার আড়তদার ইউসুফ ব্যাপারী বলেন, প্রতি ঝুড়ি ইলিশ ভোলা থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজার পৌঁছতে ব্যয় হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। ফলে এক কেজি ওজনের এক হালি ইলিশ ঘাটে যদি বিক্রি হয় আট হাজার টাকায়, তাহলে ঢাকায় গিয়ে সেই মাছের দাম বেড়ে হয় ৯-১০ হাজার টাকা।
চাঁদপুর মাছঘাটের পিউর ইলিশ নামে আড়ত থেকে অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবে ইলিশ বিক্রি হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সুলতান মাহমুদ হাসান বলেন, ইলিশ ৫ থেকে ১০ কেজির মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের যে কোনো স্থানে পাঠাতে কুরিয়ার খরচ হয় ৬০০-৭০০ টাকা। আর পরিমাণ বাড়লে খরচও বাড়বে।
অপরদিকে পটুয়াখালীর আলিপুরের ব্যবসায়ীরা জানান, বরফ, প্যাকেজিং ও লেবার খরচ দিয়ে ঢাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি কেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ যুক্ত হয়।
যদিও বরিশাল পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন জানান, কর্কশিট, পলিথিন, বরফ, লেবার খরচসহ এক মণ ইলিশের প্যাকেজিংয়ে ৭৭০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এরপর তা সড়কপথে ঢাকার নিউমার্কেট বা কারওয়ান বাজার পর্যন্ত শুধু পৌঁছাতে আরও ৪৫০ টাকা খরচ হয়। দূরত্ব বাড়লে এ খরচ আরও বাড়ে।
জেলে-বিক্রেতাদের ভাষ্যে চড়া দামের কারণ
বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধির জন্য চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত আহরণ বা সরবরাহকে দায়ী করছেন জেলেসহ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ইলিশ নদী বা সাগর থেকে বাজারে আনতে খরচের তুলনায় কম ধরা পড়ছে, যেজন্য দাম বাড়ছে।
বরিশালের মৎস্য ব্যবসায়ী রাজিব শেখ জানান, গত বছর এ সময়ে যে ইলিশ মাছ ছিল বাজারে, এ বছর তাও নেই। কয়েকদিন আগে এর থেকেও খারাপ অবস্থা ছিল, এখন পরিস্থিতির উন্নতি হলেও চাহিদা অনুযায়ী ইলিশের আমদানি এখনও ঘটছে না, তাই বাজারে ইলিশের দামও কমছে না।
রাজিব শেখ বলছেন, গোটা দেশের পাইকার বাজারে সাগরের মাছ ও স্থানীয় নদীর মাছের দাম আলাদা। সেক্ষেত্রে এখন সাগর থেকে মাছ আহরণ হওয়ায় সেগুলোর দাম কিছুটা কমেছে, তবে আহরণ কম হওয়ায় নদীর মাছের দাম এখনো বেশি। আর সেই সুযোগে অসাধুরা সাগরের মাছ নদীর বলে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।
বরগুনা পৌর শহরের খুচরা ইলিশ বিক্রেতা কামাল বাংলানিউজকে বলেন, এখন ইলিশের মৌসুম চলছে। তবে বাজারে যে পরিমাণ মাছ সরবরাহ থাকার কথা সেই তুলনায় অনেকটা কম সরবরাহ হয়েছে ইলিশ। সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কিছুটা কম থাকে এবং সরবরাহ কম থাকলে ইলিশের দাম বৃদ্ধি পায়। আর খুচরো বাজারে মাছের দাম নির্ধারণ হয় পাইকারি বাজারের দাম অনুসারে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি পরিমাণ মাছ আহরণ করে বাজারে নিয়ে আসবেন জেলেরা, তখন দামও কমবে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার হারিণা ফেরিঘাট সংলগ্ন ইলিশের আড়তদার ইব্রাহীম মিয়া। তিনি বলেন, এ বছর পদ্মা-মেঘনায় বড় আকারের ইলিশ কম ছিল। যার ফলে বছরের শুরু থেকেই এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এখন ভরা মৌসুমে একই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৪শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকা। যদি স্থানীয় ইলিশের আহরণ বাড়ে তাহলে দাম আরও কমবে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর-মহিপুরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যত বেশি সাগরে ইলিশ ধরা পড়বে ততো বাজার দর নিম্নমুখী হবে। মহিপুর আলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রাজা মিয়া জানান, জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। ইতোমধ্যে মৌসুমের অর্ধেকটা শেষ হলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সাগরে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাননি জেলেরা।
অপরদিকে ভোলার লালমোহন উপজেলার জেলেরা জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় আড়তেই দাম বাড়তে থাকে। আর জেলের পর আড়তদার এবং পাইকারসহ কয়েক হাত ঘুরে খুচরো বাজারে গিয়ে ইলশের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
তবে মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দীন শেখ বাংলানিউজকে বলেন, আগে মাছঘাটের সংখ্যা নির্ধারিত থাকলেও এখন যেমন জেলের সংখ্যা বেড়েছে তেমনি মাছঘাটের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই বড়বাজার বা অবতরণ কেন্দ্রে এখন প্রচুর মাছের দেখা মিলে না, সেজন্য দামও হয়তো কমে না।
কেন কম ধরা পড়ছে ইলিশ
মাছ কম ধরা পড়ছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মির্জা ওমর ফারুক বাংলানিউজকে জানান, ইলিশের প্রাপ্যতা কমের পেছনে পদ্মা-মেঘনার পানিতে দূষণ, নাব্যতা সংকট এবং চর জেগে ওঠা কারণ হিসেবে আছে। এককথায় ইলিশ যখন সাগর থেকে নদীতে আসে তখন চলার পথে বাধাগ্রস্ত হয়। মূলত ইলিশের চলার পথ সুগম করা একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া বুড়িগঙ্গার কল কারখানার দূষিত পানি এসেও মেঘনা নদীর তলদেশের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
ইলিশ ছোট অর্থাৎ জাটকার আকার পর্যন্ত পানির উপরিভাগে থাকলেও বড় হলে নিচের দিকে চলাচল করে জানিয়ে মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দীন শেখ বাংলানিউজকে বলেন, সাগরে প্রতিনিয়ত ইলিশ ধরা পড়ছে, তবে নদীতে কমে গেছে। সবমিলিয়ে কী কী কারণে এখন ইলিশ মাছ কম ধরা পড়ছে এটি নির্ধারণ করতে হলে গবেষণার প্রয়োজন আছে। তবে প্রাথমিকভাবে কিছু কারণের মধ্যে নদীর তলদেশে প্রচুর পলি পড়া এবং গভীরতা কমে যাওয়া একটি কারণ রয়েছে। এর ফলে ইলিশের চলাচলের রাস্তার গভীরতা কমে গেছে। এজন্য ওরা চলাচলের রাস্তা পরিবর্তন করতে পারে। আবার দূষণের ফলে ইলিশের প্রাপ্তি কম হতে পারে, দূষণের কারণে তারা মারা গিয়ে থাকতে পারে কিংবা দূষিত এলাকায় আসছে না এমনও হতে পারে। সেইসঙ্গে খাবার সংকটও হতে পারে। এছাড়াও বৃষ্টিপাত বেশি হলে নদী-সাগরের পানির তাপমাত্রা সহনশীল হয়, আর ওইসময় ইলিশ মাইগ্রেশন (আবাস পরিবর্তন) করে এবং মাইগ্রেশন করার জন্য নদীতে আসে। তবে তাপমাত্রা সহনশীল না হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হয়।
যদিও ভিন্ন কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। বরিশাল নগরের পোর্ট রোড পাইকার বাজারের ব্যবসায়ী রেজাউল করিম জানান, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অবৈধ ছোট ফাঁসের জালের ব্যবহারের ফলে ইলিশের পোনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে সরকারি আইন অমান্য করে অসাধু জেলেরা যেভাবে বছরজুড়ে জাটকা ধরে তাতে বড় ইলিশের উৎপাদনই তো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার বন্ধ করার পাশাপাশি জাটকা আহরণ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।
ইলিশ আহরণ কম হওয়ার কারণ হিসেবে জেলেরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে ডিম ছাড়ার জন্য প্রচুর ইলিশ সাগর থেকে নদীতে আসে। আর ডিম ছেড়ে সাগরে ফেরার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়বে এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময় বছরে বছরে হালনাগাদ না করার কারণে এখন আর মৌসুমেও সেইরকম ইলিশ ধরা পড়ছে না।
এ দাবির বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে মৎস্য কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, ইলিশের মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকতেই হবে। তা না হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কারণে ইলিশ আহরণ কমবে।
পটুয়াখালীর চর কাজল এলাকার বাসিন্দা ও জেলে করিম মাঝি বলেন, এসব কিছুর বাইরে নদীর মোহনায় প্রচুর জালের ব্যবহার ইলিশের উৎপাদন কমিয়েছে। ওই জালের কারণে ইলিশ সাগর থেকে নদীতে ঢোকার মুখেই বাধার মুখে পড়ছে। এছাড়া উপকূলীয় নিকটবর্তী এলাকায় বাণিজ্যিক জাহাজ কিংবা ট্রলিং ফিশিং বোটের মাছ শিকারও ইলিশের উৎপাদন করছে। এছাড়া অবৈধ গড়া জাল, গোভ জালও ইলিশের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করছে।
দাদন-সিন্ডিকেটকে দুষছেন মৎস্য কর্মকর্তারা
তবে শুধু আহরণ কমের কারণে বাজারে মাছের দাম যে বেশি, তা মানতে নারাজ মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দাদন বা মহাজনি প্রথাসহ নানা স্তরে সিন্ডিকেটের প্রথা ইলিশের দাম বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে। এর পেছনে জেলে মাছ ধরা থেকে শুরু করে ভোক্তা ক্রয়ের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের অনিয়ম বড় বিষয়। যার মধ্যে তেলের দাম না কমা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও ট্রান্সপোর্ট খরচ না কমা, আবার কৃত্রিম পরিবহন সংকট দেখানো, বরফের কৃত্রিম সংকট দেখানোসহ পাইকার বাজারের আড়তদারদের মূল্য নির্ধারণ সিন্ডিকেট বড় ভূমিকা পালন করছে।
বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে পাথরঘাটা বিএফডিসি ঘাটে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলেরা বলছেন, ঘাটে এসেই চড়া দামে বিক্রি হয় ইলিশ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তেলসহ রসদ সামগ্রীর মূল্য দিন দিন বেড়ে যাওয়া, ঘাটে পাইকার এবং আড়ৎদারদের সিন্ডিকেট, সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য নির্ধারণ না করা ইত্যাদি।
শুধু ইলিশের দামই বিষয় নয়, দাদন ও মহাজনি প্রথার কারণে জেলেরাও নিঃস্ব হয়ে যান বলে জানিয়েছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের পরিচালক মো. আলফাজ উদ্দীন শেখ বাংলানিউজকে বলেন, ইলিশের দাম মূলত নির্ধারণ হয় বাজারে। তাই বাজার অনেক বেশি হওয়ায় এখন দাদন কিংবা মহাজনি প্রথা তেমনভাবে দরের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তবে এ প্রথা জেলেদের আর ঘুরে দাঁড়াতে দেয় না। কারণ এ প্রথার কারণে জেলেরা সহজেই নৌকা ও জাল পেলেও ঋণ থেকেই যায়।
চাঁদপুরের আনন্দ বাজার এলাকার জেলে মো. মানিক বলেন, আমাদের জেলে পাড়ায় প্রায় ৩শ’ নিবন্ধিত জেলে রয়েছে, তবে সবাই মাছ ধরে না। এর মধ্যে নৌকা আছে প্রায় ৭০টি। যারা নৌকার মালিক তারা সবাই প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাদন নেয় মাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এই টাকা ইলিশ মৌসুমে অল্প অল্প করে পরিশোধ করে। দাদনের কারণে ইলিশের দামে কোনো প্রভাব পড়ে না। যিনি আমাদের দাদন দেন তিনি আমাদের ইলিশ কিনেন এবং অন্য ব্যবসায়ীরাও কিনেন।
যদিও ভিন্ন কথা জানিয়েছেন ভোলার জেলেরা। তুলাতলী এলাকার জেলে বশির মাঝি জানান, দাদন প্রথা না থাকলে বেশি উপকৃত হবে জেলেরই। তারা নিদিষ্ট আড়তে বিক্রি না করে ইচ্ছেমত যে কোনো জায়গায় মাছ বিক্রি করতে পারবে। এতে দাম সরাসরি জেলেরা বেশি পাবে।
পটুয়াখালীর মহিপুর মৎস্যবন্দরের আ. জলিল হাওলাদার জানান, দাদন বা মহাজনি প্রথা না থাকলে জেলেরা সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে পারতেন। এতে দাম প্রায় ১৫–২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারত, কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের কমিশন ও অতিরিক্ত লাভ বাদ যেত।
অপরদিকে বরগুনার উপকূলীয় জেলা পাথরঘাটার জেলেরা বলছেন, দাদন প্রথা বহু বছর ধরে চলে আসছে। দাদনের জালে অসংখ্য জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ পেশা ছাড়তে পারছে না। একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাদনের জাল থেকে তারা বের হতে পারছেন না। মাছ ধরে আড়ৎদারদের কাছেই বিক্রি করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে।
যদিও আড়ৎদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহু বছর ধরেই দাদন টাকার বিপরীতে লাখপ্রতি ৬ থেকে ৮ টাকা নেওয়া হয়। যা এখনো চলমান। বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি হলেও বহু বছরের পুরাতন কমিশন বাড়েনি।
‘ফ্যাক্টর’ মাছ ধরার খরচ
বিগত সময়ের থেকে ইলিশ আহরণ ও পরিবহনে খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় খুচরো বাজারে ইলিশের দর বেশি বলে মনে করেন অনেকে। চাঁদপুর সদর উপজেলার আনন্দ বাজার এলাকার জেলে ইসমাইল হোসেন বলেন, ইলিশ ধরার জন্য ছোট এবং বড় নৌকা আছে। ছোট এক নৌকায় ৩-৪ জন জেলে থাকেন। একবার নদীতে গেলে জ্বালানিসহ খরচ হয় এক হাজার টাকা। আর বড় নৌকায় ৫-৭ জন গেলে খরচ হয় কমপক্ষে দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যায়, তা দিয়ে খরচ তুলতে হয়। তবে এখন ভরা মৌসুম হওয়ার কারণে ছোট-বড় ইলিশ পাওয়া যায়। এতে মোটামুটি খরচ উঠে সংসার চলে।
একই কথা বললেন ভোলার তুলাতলী এলাকার জেলে বশির মাঝি বলেন, প্রতিবার মাছ শিকারে ৪/৫ জন জেলের নদীতে যেতে খরচ হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। কিন্তু যে পরিমাণ মাছ পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই দায়। কিন্তু ১০ বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। তখন খরচের থেকে উপার্জন ভালো ছিল।
অপরদিকে গভীর সমুদ্রের মাছ শিকার করতে যান উপকূলের জেলেরা। তারা জানান, ১৮ থেকে ২২ জনের ট্রলারে কমপক্ষে ৪ থেকে ৭ লাখ টাকার বাজার সদাইয়ে খরচ হয়। আবার ১২ থেকে ১৮ জনের ট্রলারে বাজার সদাইয়ে খরচ হয় গড়ে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা।
আলীপুরের খান ফিশের সুমন জানান, জ্বালানি তেল, বরফ, খাবার, জাল মেরামত—সব মিলিয়ে তাদের প্রতি ট্রলারের এক ট্রিপে খরচ প্রায় পৌনে দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা। সেইসাথে সাগরে যত বেশিদিন এসব ট্রলার থাকবে তত খরচ বাড়বে। আর মাছ না পড়লে এই খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হয় মালিকদের।
এক দশকে বেড়েছে ইলিশ উৎপাদন, জিডিপিতে অবদান ১ শতাংশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে একক প্রজাতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় ইলিশ। আর বিশ্বে যত ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার ৮০ শতাংশের বেশি ধরা পড়ে বাংলাদেশে। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ ইলিশ। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। জেলেরা বছরে প্রায় ছয় লাখ টন ইলিশ আহরণ করেন, যার বেশির ভাগই আসে সাগর থেকে।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক দশকে ইলিশ উৎপাদন বেশ বেড়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর উৎপাদন হচ্ছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নদী ও সাগরে ৫ লাখ ২৯ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়েছে। অন্যদিকে ইলিশের চেয়ে পাঙাশ (৪ লাখ টন), তেলাপিয়ার (৪ লাখ ২১ হাজার টন) উৎপাদন কম। যদিও উৎপাদনের এ হিসাব নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।
এ বছর ইলিশ সরবরাহ কমের বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার সহকারী পরিচালক এম ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেন, ইলিশের মাইগ্রেশন রুটের (চলাচলের পথ) পরিবর্তন ও প্রজনন ঠিকমতো না হলে উৎপাদনে প্রভাব পড়ে। ফলে এ বছর ইলিশ সরবরাহ কমেছে।
ইলিশ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. আনিছুর রহমান বলেন, মে ও জুন মাস থেকে একটু বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে। জুনের দ্বিতীয় ভাগে ইলিশের কেজিপ্রতি দর আড়াই হাজার টাকা এটা অস্বাভাবিক। ইলিশের এত বেশি দাম কোনোভাবেই যৌক্তিক না।
তিনি বলেন, ইলিশ উৎপাদনে কোনো খরচ নেই। খরচ যা হয়, তা ধরার পেছনে হয়। চাষের মাছ উৎপাদনে খরচ অনেক। তারপরও চাষের মাছের তুলনায় ইলিশের দাম বহুগুণ। যেমন বাজারে এক কেজি চাষের পাঙাশের দাম এখন ২০০ টাকার আশপাশে। যা ইলিশের দামের ১০ গুণের বেশি।
চাঁদাবাজি বন্ধ ও ডিজেলের দাম কমানোর চিন্তায় সরকার
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ইলিশের দাম এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। ঢাকায় এক কেজির কম ওজনের ইলিশ ২০০০ টাকার বেশি। এই দাম ১৫০০ টাকার মধ্যে থাকা উচিত। সরবরাহের ঘাটতি ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্মের কারণে ভরা মৌসুমেও ইলিশ মাছের দাম ক্রেতাদের বাইরে।
এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে জেলেদের একসাথে সমুদ্রে মৎস্য শিকারে যেতে না পারাকেও দাম বাড়তি হওয়ার একটি কারণ বলেছেন তিনি
উপদেষ্টা বলেন, বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়লে দামও নাগালের মধ্যে আশবে। একই সঙ্গে ইলিশের দাম কমানোর জন্য ব্যবসায়ীদের পরামর্শ অনুযায়ী চাঁদাবাজি লাঘব, ডিজেলের দাম কমানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইলিশের বাড়ি হিসেবে খ্যাত চাঁদপুরসহ যেসব জেলায় ইলিশ মাছ বেশি ধরা পড়ে, সেসব জেলায় দাম নির্ধারণের প্রস্তাবের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া অবৈধ পথেও ইলিশ যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই বিষয়টি বিজিবি, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে নজরে রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজার তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
(প্রতিবেদনটি সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট গৌতম ঘোষ ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মুশফিক সৌরভের সমন্বয়ে মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ছোটন সাহা, জাহিদুল ইসলাম মেহেদী, জহিরুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলাম খোকন তৈরি করেছেন)
এইচএ/