ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

হিলারি পাড়ায় চলছে গ্রামীণব্যাংক কর্মকর্তাদের ধমকাধমকি

আনোয়ারুল করিম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১০
হিলারি পাড়ায় চলছে গ্রামীণব্যাংক কর্মকর্তাদের ধমকাধমকি

যশোর থেকে: গ্রামীণ ব্যাংকের ‘ইমেজ’ ঠিক রাখতে যশোরের ‘হিলারি পাড়া’য় তৎপর গ্রামীণ ব্যাংক। ঋণ নিয়ে উপকার না পাওয়া সদস্যদের সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলতে ‘ধমক’ দিয়ে চলেছেন ব্যাংকটির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ৯ ডিসেম্বরও এই গ্রামে এসে সদস্যদের এ আদেশ দেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় এদিন পার্বতী নামের একজন সদস্য ও তার স্বামীকে বিশেষভাবে ‘ধমকানো’ হয়। বৃহস্পতিবার হিলারি পাড়া ঘুরে এ কথা জানা গেছে।

১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল কিটনের স্ত্রী বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন এসেছিলেন এই গ্রামে। সেসময় গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে শনৈ: শনৈ: উন্নতি বোঝাতে এই গ্রামের কুড়িজন নারী-সদস্যকে গৃহ নির্মাণের জন্য ঋণ দেওয়া হয়। পরে এই ঋণ অনেকেরই জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়; খেয়ে না খেয়ে এই ঋণ তাদের শোধ করতে হয় বলে ভূক্তভোগী এলাকাবাসী জানান।

নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল থেকে ড. ইউনূসের অর্থ স্থানান্তরসহ পল্লীফোনের নারীদের নিয়ে দু’টি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার হয়। এগুলোর বরাত দিয়ে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রতিবেদন প্রচার হতে থাকে।

যশোরের হিলারি পাড়া নিয়েও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বর্তমান বাস্তবতার চিত্র প্রকাশ হয়। এরপরই গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় ওই গ্রামের সদস্যদের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

হিলারি পাড়ার প্রকৃত নাম মাহিষাহাটি। যশোর ও ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তে বারোবাজারের পাশে এর অবস্থান। ওই গ্রামটিতে মূলত ঋষিদের (মুচি সম্প্রদায়) বাস।

১৯৯৫ সালের ৩ এপ্রিল হিলারি কিনটন ও তার মেয়ে চেলসিকে এই গ্রামের সদস্যদের সাফল্য দেখাতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিন গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ওই গ্রামটির নামকরণ করা হয় ‘হিলারি আদর্শ পল্লী’।     

হিলারির আগমণ উপলক্ষে গ্রামের সদস্যদের পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের জন্য ২৫ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয় এই বাড়ি নির্মাণের জন্য। অনেকেই প্রতি সপ্তাহে এ ঋণ পরিশোধে ৬২৫ টাকা করে দিতে পারেননি। এরপর এদের কয়েকজন নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়েন। সংবাদ মাধ্যমে এর কিছু কিছু বিষয় প্রকাশিতও হয়।  

বিশেষ করে এই গ্রামের ভক্ত কুমার নামের এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রী গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য পাবর্তী’র ঋণের টাকা পরিশোধে জমি ও বাড়ি বিক্রি করেছেন বলেও জানা যায়। তিনি এখন সরকারি আবাসন প্রকল্পের একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।     

সর্বশেষ ড. ইউনূসের অর্থ স্থানান্তর বিতর্কের পর বিষয়গুলো আবারও আলোচিত হয়।

এ সংবাদ প্রকাশের পর গ্রামীণব্যাংকের ঢাকায় প্রধান কার্যালয় ছাড়াও যশোর ও ঝিনাইদহ আঞ্চলিক দপ্তর থেকে ব্যাংকটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই এলাকায় আসেন। তারা এলাকার শতাধিক সদস্যদের ডেকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বাইরের কারও সঙ্গে আলোচনা না করার আদেশ দেয়।

সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বরও গ্রামীণ ব্যাংকের ঝিনাইদহ আঞ্চলিক দপ্তরের ব্যবস্থাপক আব্দুল করিম ও বারোবাজার শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুল মান্নান মহিষাহাটি গ্রামে যান। আগে থেকেই সেখানে সদস্যদের সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।

বৃহস্পতিবার ওই গ্রামে ঢোকার মুখেই সদস্যদের বহিরাগত সম্পর্কে কৌতূহূল দেখা যায়। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেও কেউ কিছু বলতে চাননি। ওই গ্রামটিতে দরিদ্রতার ছাপ খুব প্রকট। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের কারণে গ্রামের ভূমিহীনরা এখন মাথার ওপর ছাদ পেয়েছেন।

গ্রামীণব্যাংকটির কেন্দ্রে গেলেও সেখানকার কোনো সদস্য নিজেদের পরিচয় দিতে চাননি। অনেকেই বলেছেন, ‘আপনার (সাংবাদিক) সঙ্গে কথা বললে কি আমরা টাকা পাবো? আপনারা শুধু সমস্যাই করেন। ’

বৃহস্পতিবার দুপুরে সদস্যদের সঙ্গে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বৈঠকের বিষয়ে জানা যায়, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার কারণে সেখানে ভক্ত কুমার ও তার স্ত্রীকে  জবাবদিহি করতে হয়। কর্মকর্তাদের চাপের মুখে ভক্ত কুমার ও তার স্ত্রী পাবর্তী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বলেন, ‘সংবাদ মাধ্যমে আমার বরাত দিয়ে যা ছাপা হয়েছে তা ঠিক নয়। আমি তা বালিনি। ’

ভক্ত কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজের কাছে ওই বৈঠকের ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হতে চাননি। এমনকি সেখান থেকে চলে যেতে চান এবং এ প্রতিবেদককেও সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। সেখানে উপস্থিত অন্য কয়েকজন সদস্যের অনুরোধে ভক্ত কুমার বলেন, ‘স্যাররা আমাকে সত্য কথা বলতে বলেছেন। ’

তিনি আরও বলেন, ‘স্যাররা আমাকে বলেছেন, তুমি সাংবাদিকদের ছবি তুলতে দিলে কেন?’

বাড়ি ও জমি বিক্রির প্রসঙ্গে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার মেয়ের অসুখ হওয়ায় ঋণ নিতে হয়। ওই ঋণ পরিশোধ করতেই সাত/আট বছর আগে আমি বাড়িসহ জমি বিক্রি করি। ’

মাহিষাহাটি গ্রামে ভক্ত কুমারের জমি ছিল ২ শতাংশ। এর বাইরে তার আর কোনো জমি নেই। বর্তমানে তিনি বাঁশের জিনিসপত্র বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

বৈঠকের ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকটির ওই কেন্দ্রের প্রধান শেফালিও সংবাদ মাধ্যমের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘শুধু শুধু আমাদের ঋণ নেওয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে আসেন। ’

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভক্ত ও পার্বতীকে স্যাররা বলেছেন, সত্য কথা বলবে। ’

হিলারি আদর্শ গ্রামে সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে বারোবাজার শাখা ব্যবস্থাপক আব্দুল মান্নান নিজ দপ্তরে বসে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সদস্যদের কোনো সমস্যা আছে কী না তা দেখতেই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। ’

তিনি জানান, গত মঙ্গলবার ঢাকা থেকেও একটি তদন্ত দল ওই গ্রামে গিয়েছিল।

আব্দুল মান্নান জানান, ঢাকা থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা অনুসারে আঞ্চলিক দপ্তর থেকে হিলারি পল্লী নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিভ্রান্তিকর’ সংবাদের প্রতিবাদ তৈরি করা হবে।  

তিনি বলেন, ‘ঋণ নিয়ে যদি সমস্যাই হয় তবে ভক্ত কুমারের স্ত্রী পার্বতী এখনও সদস্য আছেন কেন? তাকে তো এরপরও আমরা ঋণ দিয়েছি। ’  

ভক্ত কুমার ও তার স্ত্রীসহ অন্যদের ‘ধমক’ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক এসে তাদের সমস্যার কথা জানতে চেয়েছেন। ’

তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, আপনারা সত্য কথাটা বলুন। কারও কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের জানান। ’

এভাবে তারা না বুঝে ব্যাংকের ইমেজ নষ্ট করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।  

বারোবাজার শাখার ব্যবস্থাপক ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘কোনো সদস্য ঋণ নেওয়ার পর সমস্যায় পড়লে তার কিস্তির পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে কোনো অবস্থাতেই ঋণ মওকুফ বা কিস্তি দেওয়া বন্ধ করা যাবে না। ’

তিনি বলেন, ‘হিলারি পাড়ায় দু’টি সমিতিতে (কেন্দ্র) শতাধিক সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ভক্ত কুমারের স্ত্রী পার্বতী যে কেন্দ্রে (১৫ নম্বর কেন্দ্র) সেখানে ৫৬ জন ঋণগ্রহীতা রয়েছেন। ’  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।