চিলমারী, কুড়িগ্রাম থেকে: চিলমারী উপজেলায় নারীদের হাতে নেই গ্রামীণ ব্যাংকের পল্লীফোন। শুধুমাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের কাগজপত্রেই পল্লীফোন নারীদের হাতে।
স্থানীয় গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছেন, এ পর্যন্ত যত পল্লী ফোন দেওয়া হয়েছে তার ৭৫ শতাংশই নারীদের দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ গ্রাহকই এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন। তবে বৃহস্পতিবার সরেজমিনে চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র।
যারা পল্লীফোন নিয়েছেন লোকসান গুনে শেষ পর্যন্ত অনেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছেন। সম্পর্ক ছিন্ন করে পল্লীফোনের গ্রাহকদের কেউ কেউ পেশাও বদলেছেন।
উপজেলার রমনা ইউনিয়নের পুরাতন জোড়বাজার এলাকার আনোয়ারা বেগম নিজের নামে পল্লীফোন নিয়ে তা তুলে দিয়েছিলেন ছেলে আবুল কালাম আজাদ আর মেয়েজামাই দুলাল মিয়ার হাতে। ২০০৩ সালে এই ব্যবসা শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তারা ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হন। আনোয়ারা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, লাভের বদলে শেষ পর্যন্ত লোকসানে পড়ে যান তিনি। তাই বিকল্প চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
আনোয়ারা বেগম জানান, পল্লীফোনের ভরসায় বসে থাকলে এতদিন তাকে না খেয়ে মরতে হতো। শুরুর দিকেই অবস্থা খারাপ দেখে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান তিনি। শেষ পর্যন্ত ছেলে আবুল কালাম আজাদ পুলিশের কনস্টেবলের চাকরি পেয়ে যায়। আর মেয়ে-জামাই উপায়ন্তর না পেয়ে পেটের দায়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নেন। এরপর গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করেন আনোয়ার।
তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য থাকলেই ঋণ নিতে হয়। যা তিনি চান না। তাছাড়া ছেলে, মেয়ে-জামাই নিয়ে অনেক ভালো আছেন এখন তিনি।
রমনা ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের ফুলমিয়া, সবুজপাড়া গ্রামের মো. বাদল, ইবাদুল, আজিমুদ্দিন, আবদুল ওয়াহাব, থানাহাটের হাফিজুর রহমানসহ অনেক যুবকই কোন না কোনো নারীর নামে পল্লীফোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। লোকসান দিয়ে এদের সবাই পল্লীফোনের ব্যবসা ছেড়ে দেন। সরকার পাড়ার ফুলমিয়া জানান, লোকসান দিতে দিতে ব্যবসা ছেড়ে দিতে তিনি বাধ্য হন। তিনি জানান, ২০০৬ সাল পর্যন্ত ব্যবসা মোটামুটি চললেও এরপর আর ব্যবসা চালানো সম্ভব হচ্ছিল না।
তিনি বলেন, আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় তিনি ব্যবসা বন্ধ করে দেন। হাফিজুর রহমানের কথা লোকসান দিয়ে কে ব্যবসা চালাবে। জোড়বাজারের পল্লীফোনের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যতিক্রমী একজনকে পাওয়া গেল। তার নাম মো: মানিক মিয়া। ২০০৩ সালে তার মা রেজিয়া বেগমের নামে ১৬ হাজার টাকা পল্লীফোন নিয়ে বাজার এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। দোকান দিয়ে ভালোই ব্যবসা করছেন।
তার কথা প্রথম দিকে তিনি পল্লীফোন ব্যবসা মোটামুটি চললেও পরে আর আর ব্যবসা হচ্ছিল না। দু’বছর আগে থেকেই তিনি পল্লীফোনের ব্যবসার পাশাপাশি ফেক্সিলোড, মোবাইল সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসা ধরে রেখেছেন। নতুবা পল্লীফোনের ব্যবসা দিয়ে এতদিন টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
পুরাতন জোড়বাজারের জাহাঙ্গীর মিয়াও ২০০৩ সালে পল্লীফোনের ব্যবসা শুরু করেন। এখনো তার কাছে পল্লীফোন রয়েছে। তবে তিনিও এখন আর মোবাইল ফোনের ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছেন না। এর পাশাপাশি তিনি মোবাইল দোকানে বিভিন্ন দ্রব্য তুলেছেন। এভাবে চলছে তার ব্যবসা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, পুরাতন জোড়বাজার, থানাহাট বাজার ও নতুন জোড়বাজারের এলাকায় যারাই ব্যবসা করেছেন কারোই নিজের নামে পল্লীফোন ছিল না। কারো মা, কেউ বোন, কিংবা খালার নামে কিংবা পরিচিত কাউকে ধরে মোবাইল ফোনটি নিয়েছেন।
মো: মানিক মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের লোকেরা এ নিয়ে মাঝে মধ্যে তদন্ত করতেও এসেছে। খবর পেয়ে আগে থেকে মা, খালা বা বোনকে হাজির করে রাখত। যাতে করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের এই অনিয়ম ধরতে না পারে।
পল্লীফোনের গ্রাহকরা এ ধরনের বক্তব্য দিলেও চিলমারী উপজেলা শাখার গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ফারুক-ই আজম বাংলানিউজকে বলেন, পল্লীফোনের গ্রাহক হতে হলে তাকে শুধুমাত্র নারী হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যে-কেউ তাদের গ্রাহক হতে পারবে। পল্লীফোনের বর্তমান বেহাল দশা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের ব্যবসা যে আগের মতো চলছে না এটা সত্যি। তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এখনো পল্লীফোন ব্যবহার করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পল্লীফোনের কার্যক্রম বন্ধ নেই। কিন্তু গ্রাহকরা যদি না নেয় তো কি করার আছে। তারপরেও আমরা লোকজনকে বোঝাচ্ছি, পল্লীফোন নিতে উদ্বুদ্ধ করছি। ’
স্থানীয় সময়: ১১২৭ ঘন্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১০