যশোর থেকে: ঋণ পরিশোধের পরই আবার ঋণ নিতে সদস্যদের বাধ্য করে গ্রামীণব্যাংক। এ কারণে অনেক সদস্যই তাদের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।
যশোর ও ঝিনাইদহ এলাকা ঘুরে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
গ্রামীণব্যাংকের গ্রাহকরা মূলত নারী। গরু কেনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে ঋণ নেন তারা। এ ঋণের টাকা দিয়ে তাদের কাজ হলো কি হলো না, তা চিন্তা না করে তাদের নতুন করে ঋণের জালে জড়াতে ফাঁদ পেতে থাকে গ্রামীণব্যাংক। তাই সময় মতো কিস্তি দিয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করেও এসব উদ্যোগী নারীর মুক্তি নেই।
ঋণগ্রহীতা এসব নারীর অভিযোগ, গ্রামীণব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ঋণ নেওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী ৪৪ সপ্তাহের মধ্যেই সে ঋণ পরিশোধ হয়ে যায়। কিন্তু এরপর এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই ফের ঋণ নেওয়ার জন্য সদস্যদের চাপাচাপি শুরু করে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। ঋণ নিতে না চাইলে সঞ্চয়ী হিসাবেও টাকা জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে অনেকেই সদস্য হিসেবে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন।
যশোর সাতমাইল এলাকার বাসিন্দা চায়না বেগম। মধ্য চল্লিশের এই নারী গ্রামীণব্যাংকের একজন সাবেক সদস্য। ঋণ নেওয়ার চাপে পড়ে তিনিও আর ওই ব্যাংকের সদস্য নন।
চায়না বেগম যশোরের মথুরাপুর শাখার সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে গ্রামীণব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
চায়না বেগম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এর আগে দুই বার ঋণ নিয়েছি। প্রথমবার ঋণ নিয়ে কাজে লাগিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার গ্রামীণ ব্যাংক আমাকে ঋণ নিতে চাপ দেয়। ফলে আমি নতুন করে আবারও ঋণ নিতে বাধ্য হই। ’
তিনি বলেন, ‘আমি শুধু সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা জমা রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এতে ব্যাংক থেকে বলা হয়, এভাবে শুধু সঞ্চয় জমা রাখা যাবে না। ’
তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন হলে অবশ্যই ঋণ নেব। কিন্তু অপ্রয়োজনে শুধু শুধু ঋণ নিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধের জ্বালা ভালো লাগে না। ’
তবে বিষয়টি চায়নার মতো আরও অনেক ঋণগ্রহীতার জন্য যন্ত্রণাকর হলেও গ্রামীণব্যাংক সেটা বুঝতে চায়নি। তাই বাধ্য হয়েই গ্রামীণব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন চায়না।
তবে সম্পর্ক ছিন্ন করার দায়ভার হিসেবে ক্ষতিপূরণটাও গুনতে হয় চায়নাকেই।
চায়না বেগম বলেন, ‘বাধ্য হয়েই নাম কাটাই। এজন্য আমার হিসাব থেকে গ্রামীণব্যাংক টাকা কেটে রেখেছে। ’
চায়না বেগমের মতোই হোরিবতপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আয়রা খাতুনও গ্রামীণব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ঋণ নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ায় তিনিও আর সদস্য থাকতে পারেননি।
সাতমাইল এলাকার চায়না বেগম ও হোরিবতপুরের আয়রা খাতুনের মতো এখনও সরে দাঁড়াননি যশোর উপশহরের বাসিন্দা অনিন্দা মজুমদার। তবে ঋণ নেওয়ার জন্য গ্রামীণ যেভাবে চাপ তৈরি করছে তাতে তিনিও আর বেশিদিন থাকতে পারবেন না।
অনিন্দা বাংলানিউজকে জানান, সদস্য হওয়ার পর এক দফা ঋণ নেন। দ্বিতীয়বারও তাকে চাপ দিয়ে ঋণ দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘এবার ঋণ শেষ হলে যদি শুধু সঞ্চয়ী হিসাবে টাকা রাখতে না দেয় তবে আর সদস্য থাকবো না। ’
অনিন্দা মজুমদার আরও বলেন, ‘নানা হিসাব দিয়ে তারা (ব্যাংক) ঠিকই তাদের টাকা তুলে নেয়। ’
সদস্যদের এসব অভিযোগ নিয়ে কথা হয় গ্রামীণ ব্যাংকের যশোর জোনের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মাশরুর রহমানের সঙ্গে।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘শুধু টাকা জমা রাখা তো গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ নয়। গ্রাহকদের টাকা জমা রাখলে (ডিপিএস) ব্যাংকের লোকসান। কারণ এতে তো গ্রাহকদের অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। ’
তবে ঋণ দিতে ‘চাপ’ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে মাশরুর রহমান বলেন, ‘চাপ কেন দেওয়া হবে? চাপ দিলে তো এই জোনে ১৭৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া যেত না। ’
তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনও সদস্যের ঋণের ২৩ কিস্তি (অর্ধেক পরিশোধ) শেষ হলেই তিনি ফের ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবেন। ’
গ্রাহকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই ২০০০ সালে এই নিয়ম করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ব্যাংকটির যশোর অঞ্চলের ম্যানেজার আরও বলেন, ‘একটি কেন্দ্রের দুই/চারজন সদস্য হয়তো কোনও কারণে ঋণ নিতে চায় না। তারাই ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেন। ’
তিনি বলেন, ‘হত দরিদ্রদের এই ব্যাংকে শুধু সঞ্চয় রাখলে তো ব্যাংক চলবে না। কারণ ব্যাংকের খরচ আছে, সেগুলো আসবে কোথায় থেকে?’
যশোর অঞ্চলে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের হার ৯৯ শতাংশ বলেও জানান মাশরুর রহমান।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১০