ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

গ্রামীণের ঋণ গ্রহীতারা দিশেহারা: আমানতকারীরা আতঙ্কে

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১০
গ্রামীণের ঋণ গ্রহীতারা দিশেহারা: আমানতকারীরা আতঙ্কে

রাজশাহীর বেড়পাড়া সীমান্ত থেকে ফিরে: শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে গ্রামীণব্যাংকের তহবিল সরানোসহ আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পর গ্রাম-গঞ্জের মেহনতি মানুষের মাঝে নেমে এসেছে হতাশা। একদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতারা হয়ে পড়েছেন দিশেহারা, অন্যদিকে সঞ্চয় ও মেয়াদি আমানত জমা রাখা নারীদের মধ্যে ভর করেছে আতঙ্ক।

জমা রাখা টাকা আদৌ ফেরত না পাওয়া যাবে কিনা সে শঙ্কা তাদের মনে।

রাজশাহীর বেড়পাড়া সীমান্ত এলাকায় পরিচালিত গ্রামীণব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনার পাশাপাশি ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

বাংলানিউজের কাছে খাটাপাড়া গ্রামের টুলু বেগম (৫২) তার আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় শাখা কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে।

তিনি বলেন, ‘আমার তো ম্যালা টাকা ব্যাংকে থুইয়েছি-এখন কি হবে ? টাকাগুলো হাইরে‌্য গেলে আমার কোনো উপায় থাইকবে না যে...। ’

কিছুদিন আগে টুলু বেগমের জমা রাখা টাকার বিপরীতে গ্রামীণব্যাংক থেকে দেওয়া ‘জমা বই’ কর্মকর্তারা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তার জমা বইটা আর ফেরত না দেওয়ায় টুলু বেগমের আশঙ্কা আরো প্রবল হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার টাকা আমি জমা থুইয়েছি-এখন আমার কাছে টাকা থুওয়ার কোনো প্রমাণ পর্যন্ত নাই। বারবার মাস্টারের কাছে বই চাহাছি, তাও ‘জমার বই’ ফেরত পাছি না-গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসার বুইল্যাছে, ম্যালা খোঁজাখুঁজি কইরেও বইডা নাকি পাছে না। ’

কেবল টুলু বেগমের মতো সঞ্চয় ও ডিপিএস হিসেবে টাকা জমা রেখে হরিপুরের সুফিয়া বেগম, নাসিমা, সোনাইকান্দির লতিফা, পূর্বপাড়ার সামসুন্নাহার, বেড়পাড়ার শ্যামলীসহ অনেকেই এখন বিপাকে পড়েছেন।

দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এসব নারী ভাগ্য পরিবর্তনের অদম্য আশা নিয়ে ২০/২২ বছর আগে সঞ্চয়ী সদস্য হিসেবে গ্রামীণব্যাংকে নাম লিখিয়েছিলেন।

বাংলানিউজকে তারা জানান, এ দীর্ঘ সময়ে বছর বছর ঋণ নেওয়া আর চড়া সুদসহ তা পরিশোধ করার ঘূর্ণিপাকেই আটকে আছে তাদের জীবন। জীবনযাত্রার মান পাল্টানো দূরের কথা, তারা আজও দু’মুঠো খাবারের নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে পারেননি। বরং দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে, মাথায় চেপেছে ঋণের বোঝা।

‘ঋণ পেয়েও কেন ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারলেন না?’- এ প্রশ্নের জবাবে পূর্বপাড়ার বীনা বেগম (৩৫) বাংলানিউজকে বলেন, ‘গ্রামীণের লোন লিয়ে কেউ দাঁড়াতে পারেনি-পারবেও না। ক্যাম্নে দাঁড়াবে বুলেন? ১০ হাজার টাকা লোন দিলে এটা-ওটার নামে এক হাজার টাকা তো হাতেই কেটে লেয়। আর লোন লেয়ার দিন থেক্যেই শুরু হয় কিস্তির জাকান্দানি (তাগাদা)। মাস্টারদের গালিবুলি শুনতে না চাইলে কিস্তির জন্য ২/৩ হাজার টাকা আলাদা রাখা লাগে। বাকি ৫/৬ হাজার টাকা দিয়ে কি হবে-আপনেই বুলেন ?’

বেড়পাড়ার (পূর্বপাড়া) বাসিন্দা বাবু মিয়ার স্ত্রী বীনা বেগম লক্ষাধিক টাকার ঋণ মাথায় নিয়ে রীতিমত ফেরারি জীবনযাপন করছেন।

বীনা বেগম প্রসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওই মহিলা গ্রামীণ ছাড়াও ৫টি সংস্থা থেকে লাখ লাখ টাকা ঋণ তুলে শুধু অপচয়ই করেছে। সপ্তায় সপ্তায় কিস্তি না দিলে ঋণের বোঝা তো বাড়বেই। ’

এ সময় ঋণ নিয়ে যারা সফল হয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন শাখা ব্যবস্থাপক।

কিন্তু তার কাছে সফল নারীদের তালিকা চাইলে বিভিন্ন নথিপত্র পরীক্ষা করে তিন হাজার সদস্যের মধ্য থেকে বেদেনা বেগম ও টুলু বেগম নামে দু’জনের উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। তবে তার বর্ণনা অনুযায়ী সরেজমিনে বেদেনা বেগমের জীবনযাত্রার কিছুটা মিল পাওয়া গেলেও টুলু বেগমের ক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থাপকের দাবির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সফলতার নথিতে ব্যর্থতার খতিয়ান

হরিপুর গ্রামেই বেদেনা বেগমের (৪২) বাড়ি। তার স্বামীর নাম মতি মিয়া (৪৮)। স্বামী ও তার এক ছেলে সিএনজি ট্যাক্সি চালিয়ে উপার্জন করেন। বাড়িতে সব মিলিয়ে তিন সদস্যের বসবাস।

বাংলানিউজকে বেদেনা জানান, সংসারের টানাপোড়েন না থাকায় গ্রামীণের ঋণ নিয়ে আয় বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন খাতেই লাগিয়েছেন তিনি। ট্যাক্সির উপার্জিত টাকায় নিয়মিত কিস্তিও শোধ করা সম্ভব হয়েছে। ঋণের টাকা সংসার খরচ করতে হয়নি বলে বেদেনা ছোট আকারে একটি পোল্ট্রি খামার করতে পেরেছেন, গাভী পালনও করছেন তিনটি। এখন একটি গাড়ি কেনার প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। তবে এটুকু সফলতা অর্জন করতে বেদেনা বেগমকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকে সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের নথিপত্রে আছে-‘টুলু বেগম (৫২) এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গবাদিপশুর চমৎকার একটি খামার গড়েছেন, তিনি এখন পুরোপুরি স্বনির্ভর নারী। ’

তাকে সফল খামারি ও ভাগ্য পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত বলেও গর্ব করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

কিন্তু বাস্তবে খাটাপাড়া গ্রামে টুলু বেগমের বাড়ি পৌঁছে গর্বভরা দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। তার বাড়িতে গবাদিপশুর কোনো খামারও নেই।

তবে টুলু বেগম বাংলানিউজকে জানান, ‘ঋণের এক লাখ টাকা আল্লাম মিয়ার (প্রতিবেশী) গরু খামারে লাগিয়েছি। ’

তার কথা শুনে আল্লাম মিয়ার বাড়ি গিয়েও গাভীর অস্তিত্ব দেখা যায়নি। সেখানে আল্লাম মিয়া গবাদিপশু পালনের উপযোগী খামার ঘর তৈরি করেছেন ঠিকই-তবে তা ফাঁকা পড়ে আছে।

স্থানীয়রা জানান, ব্যবসায়ী আল্লাম একটা খামার ঘর বানিয়েই টুলু বেগমসহ ৭ জন সদস্যার মাধ্যমে গ্রামীণ থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ তুলিয়েছেন। তাদের ‘লাভের লোভ দেখিয়ে’ সে টাকা নিজের পকেটস্থ করেছেন আল্লাম।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।