নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক ঘুরে গেলেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি ‘দি আইডিয়া অব জাস্টিস: ফ্রম আইডিয়া টু অ্যাকশন’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য রাখেন।
প্রশ্ন: সম্প্রতি টাইম সাময়িকী ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গকে ২০১০ সালের পারসন অব দি ইয়ার (বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব) মনোনীত করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রগতিতে তার আবিষ্কারের জন্য তাকে এ সম্মান দেওয়া হয়েছে। আপনি কি বিশ্বাস করেন এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্মুক্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম?
অমর্ত্য সেন: আমি আপনাকে ফেসবুক সম্পর্কে অনেক কিছুই বলতে পারি। প্রথমত, আমি অনেক মানুষকেই চিনি যারা এটা ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা পরস্পরের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ রাখেন। আমি এটাকে অভিনন্দন জানাই।
দ্বিতীয়ত, আমি নিজে কখনো ফেসবুক ব্যবহার করিনি। এর জন্য কখনোই আমার সময় হয়নি।
তৃতীয়ত, ফেসবুকে একজন ঠগবাজ-জোচ্চর আছেন যিনি আমার নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এমনকি তিনিই আমার হয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দেন।
ব্যাপারটায় আমি খুব হতাশ হয়েছি, কারণ আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না। ছয় মাস ধরে এটা চলেছে। ইতালিতে একটি হোটেলে ওঠার সময় একজন পুরোহিত আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমি আপনাকে ফেসবুকে দেখি। ’ আমি বললাম, ‘আমার তো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার অ্যাকাউন্ট আছে। আমি আপনাকে প্রতিদিনই দেখি। এবং আপনার রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় আমি খুব আগ্রহী হয়েছি। আপনি বেশ ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। সেখানে এটাই ছিল। ’
এরপর তিনি আমাকে সেটা দেখালেন। আমি ফেসবুকের লোকজনের কাছে এর প্রতিবাদ জানালাম। আর তারা এ নিয়ে একেবারে কিছুই করল না।
কোনো উপায় না দেখে আমি ভারতের দ্য হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকাকে ব্যাপারটা জানাই। পরদিন নানান সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে খবর বেরোয়।
ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করার একমাত্র উপায় আমার ছিল গণমাধ্যমের আশ্রয় নেওয়া। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কিছু করার মতো অবস্থায় আছে? না।
যোগযোগ খুবই দরকার। তবে আপনি যদি ৭৭ বছর বয়সী এবং এরইমধ্যে পরিচিত কেউ হন, তার মানে দাঁড়াচ্ছে আপনার যথেষ্ট যোগাযোগ আছে। আমি এর বেশি যোগাযোগ চাই না।
প্রশ্ন: উইকিলিকস সম্পর্কে কিছু বলুন? আপনি কি মনে করেন, পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এটা একটি পথ, যে পৃথিবীতে তীব্র অসমতা রয়েছে?
অমর্ত্য সেন: উইকিলিকস ভিন্ন ব্যাপার। গোপনীয়তার পর্দা উচ্ছেদের জন্য এটা কাজ করেছে। এমন সব তথ্য প্রকাশ করেছে যা মানুষের থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। এটা একান্ততার লঙ্ঘন। তত্ত্বীয়ভাবে আমি এখানে সমস্যা দেখতে পাচ্ছি।
এটা কি খারাপের অপরিবর্তিত রূপ? না। এটা কি খারাপের হ্রাসকৃত রূপ? হ্যাঁ। এটা খারাপ, তবে এখানে কিছু ভালো ব্যাপার আছে, কারণ আমরা এখান থেকে কিছু জেনেছি।
আপনি কি এমন দুনিয়ায় বাস করতে চান যেখানে দুই ব্যক্তির কোনো কথোপকথন একান্তে সম্ভব নয়? না, আপনি চান না।
এখানে কূটনৈতিকতার একটি ব্যাপার আছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় ব্যাপারটা আছে, বহুপক্ষীয় অবস্থানের বিপরীতেই।
প্রশ্ন: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে খারাপ ঘটনা কি?
অমর্ত্য সেন: অনেক ভালো ভালো ব্যাপার ঘটছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো কাজ করছে। আপনি দেখবেন, সেখানে নারীরা এখন প্রবীণ পুরুষদের দমন থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে বেরুচ্ছে।
আমি নোবেল পুরস্কারের অর্থ দুই ভাগে ভাগ করেছি। এক অংশ গেছে বাংলাদেশে, আরেক অংশ গেছে ভারতে।
বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের জন্য আমরা একটি ট্রাস্ট গঠন করেছি।
আমার মনে হয় না, মাত্র একটা বড় ঘটনা ঘটছে পৃথিবীতে। অনেক ভালো ভালো ঘটনা আছে।
আমার জন্য একটি ভালো ব্যাপার হচ্ছে, আমি আল জাজিরা দেখি। বস্তুত একটি নেটওয়ার্ক আছে যারা পৃথিবীর সংবাদ বেশ ভালোভাবে পরিবেশন করে এবং পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে তা করে না। ব্যাপারটা ভালো।
আর খারাপ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীর বিরুদ্ধে অব্যাহত বৈষম্য। নিউইয়র্ক টাইমসে আমি একজন নারী সম্পর্কে পড়লাম যিনি ধর্ষিত হওয়ার কথা বললে তাকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। সত্যি বলতে কি, এরকম চরম নিষ্ঠুর ঘটনা পৃথিবীতে ঘটছে। এটা নতুন নয়, তবে এটা অব্যাহত রয়েছে।
প্রশ্ন: ন্যায়ের দুনিয়া কি সম্ভব?
অমর্ত্য সেন: আমার মনে হয় না এর সঙ্গে ন্যায়পরায়ণতার কোনো সম্পর্ক আছে। এর সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির সম্পর্ক রয়েছে।
প্রশ্ন: অসমতা একটি বড় সমস্যা, বিশেষ করে থাইল্যান্ডে।
অসমতা একটি ভয়ংকর ব্যাপার যা থাকবে। কিছু মানুষের জীবনের সব ভালো জিনিসে প্রবেশক্ষমতা রয়েছে, অন্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর তা নেই। পৃথিবীর অন্যতম একটি খারাপ বিষয় এটা।
অসমতা নিজেই কেবল খারাপ বিষয় না, এটা সামাজিক সংবদ্ধতা ও ঐক্য কমিয়ে দেয়। মারাত্মক অসন্তোষের সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন: আপনার মতে, থাইল্যান্ড কতটা বদলেছে?
অমর্ত্য সেন: প্রচুর। আমি এখানে প্রথম আসি ১৯৬৪ সালে। এখানে পড়াতাম আর জাতিসংঘের হয়ে পরামর্শকের কাজ করতাম।
একদিকে, আমি দেখেছি এখানে ভারতের চেয়ে দারিদ্র্য কম। আরেকদিকে, এখানে তীব্র দারিদ্র্য রয়েছে।
আমি মনে করি, এখানে বড় বড় পরিবর্তন হয়েছে, তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। পরিবর্তন হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে। তবে দারিদ্র্য কি কমেছে? এভাবেই আমি চিন্তা করি। সুবিধাভোগী ও বঞ্চিত লোকজনের মধ্যে ব্যবধান কি কমেছে? আমি জানি না। নিশ্চিতভাবেই এখানে অনেক দুঃখ-দুর্দশার চিত্র রয়েছে।
থাইল্যান্ডে গণতন্ত্র রয়েছে। পৃথিবীতে এরকম খুব কম গণতন্ত্রই আছে যেখানে বিক্ষোভকারীরা শহরের কেন্দ্রভাগ অনড় হয়ে দখল করে রাখতে পারে। এটা সহ্য করার জন্য যথেষ্ট মূল্যায়ন পায়নি থাইল্যান্ড।
একইসময়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন এতো মানুষ বেরিয়ে এসে সহিংসতায় লিপ্ত হলো? কেনই বা তাদের সহিংসতার মাধ্যমেই দমন করা হবে?
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১০