ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিশ্ব জলাভূমি দিবস

হুমকিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলাভূমি সুন্দরবন

রহমান মাসুদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১১
হুমকিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলাভূমি সুন্দরবন

ঢাকা: বিশ্ব জলাভূমি দিবস ২ ফেব্রুয়ারি। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো এ বছর জলাভূমি দিবসের সঙ্গে বনের সম্পর্ক তুলে ধরেছে।

এবারের বিশ্ব জলাভূমি দিবসের স্লোগান ‘বনের জন্য পানি ও জলাভূমি’। ১৯৭১ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি তারিখে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ জলাভূমি সুন্দরবন। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আজ এ বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ হিসেবে সুন্দরবনের সামনে হাজির হয়েছে বাংলাদেশের উজানে দেওয়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে মিঠাপানি কমে গিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। সুন্দরবন অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ার আরেক কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। লবণাক্ততার ক্রমাগত এ আগ্রাসনে মরতে বসেছে সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের  অন্যতম সম্পদ সুন্দরী গাছ।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার লবণপানি পানের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে প্রাণঘাতী লিভার সিরোসিস রোগে। হারিয়ে যেতে বসেছে সুন্দবনের পুরো ইকো সিস্টেম। ধারণা করা হচ্ছে এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে নিশ্চহ্ন হয়ে যাবে সুন্দরবন। এতে নিরাপত্তাহীনতায় পড়বে সমগ্র উপকূল।

সুন্দরবনের এ দুরবস্থার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করেছেন গঙ্গা নদীতে দেওয়া ভারতের ফারাক্কা বাঁধকে।

আর্ন্তজাতিক নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা প্রথম বেড়েছিল ফরাক্কা বাধঁ নির্মাণের পর। কিন্তু মানুষই তা ভুলে গেছে।

তিনি বলেন, ‘উজানের মিঠা পানির সঙ্গে এখন সুন্দরবনের নদীগুলোর তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। কেবল জলাঙ্গী ও মাথাভাঙ্গা থেকে এখনও বর্ষায় সামান্য কিছু পানি আসে। তাই ১৯৭৫ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। ’

ড. আইনুন নিশাত বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ অবস্থার থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন গড়াই, মধুমতি, কুমার, কপোতাক্ষ, ভৈরব, চিত্রা, নবগঙ্গার মতো নদীগুলো খনন করে ভাটিতে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়ানো। ’

তিনি বলেন, ‘উজানে মিঠাপানির প্রবাহ বাড়ালে ওই পানির চাপে লবণপানির প্রবাহ কমে যাবে। ’

সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, কুমির, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, অজগর, সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, ধুন্দল, বাইন, হেঁতাল, গোলপাতাসহ হাজার প্রজাতির জীবজন্তু, বৃক্ষ, লতা-গুল্ম, সরীসৃপের মায়াবী বাদা বন। ১০ হাজার ২৮০ বর্গ কিলোমিটারের এ বন দুষ্টু বানর ও বন মোরগের বন নামেও পরিচিত।

দেশের অস্তিত্ব, অর্থনীতি ও সৌন্দের্যের লীলাভূমি এ বন। সুন্দরবনের চার শতাধিক নদী, হাজার হাজার খালে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ প্রভৃতির কারণে ৪০ বছর ধরে নীরবে ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবন।

করমজল রেঞ্জ উপ-বনকর্মকর্তা আব্দুর রব বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ বনের ৭৩ ভাগই সুন্দরী বৃক্ষ। কিন্তু অন্যতম এ গাছ এখন ধ্বংসের মুখে। বনের বেশির ভাগ সুন্দরীই এখন এক অজানা রোগে শুকিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আছে পরিচিত আগামরা রোগ। তবে ধারণা করা হয় এখানকার নদী এবং খালে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণেই এ রোগ দেখা দিয়েছে। ’
 
তিনি বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনকে বাচাঁনোর সব ধরনের চেষ্টা করছি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, নদী ও খালে নোনা পানির আগ্রাসন, বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ মানুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগে তা সফল হচ্ছে না। তাই সুন্দরবনের এ গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন হারাচ্ছে তার স্বাভাবিকতা ও সৌন্দর্য। হারিয়ে যাচ্ছে তার ঐতিহ্যবাহী প্রাণীকুল। সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ন অঞ্চল। ’

তিনি জানান, নদী ভাঙ্গনের ফলে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের হাজার হাজার খাল ও চার শতাধিক নদী। ফলে ভরা অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে গেলেও ভাটায় সে পানি সরে যায় না।   এতে তৈরি হচ্ছে নোনা পানির বদ্ধতা।

এতে স্বভাব অনুযায়ী ম্যানোগ্রোভ গাছ শ্বাস ছাড়তে না পেরে বিলীন হচ্ছে, অন্য দিকে বংশ বিস্তারও করতে পারছে না। ফলে বনবিবির আদরের ধন গাজী-কালু, চম্পাবতী, মৌয়াল, বাওয়ালী, সুন্দরী, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, হরিণ, বানর, বনমোরগ সহ হাজার প্রজাতির প্রাণ-স্পন্দনের উৎস সুন্দরবন হারিয়ে যাওয়ার হুমকিতে আছে।

ডেপুটি রেঞ্জার আব্দুর রব আরো জানান, আনুমানিক ৪০ বছর আগেই সুন্দরবনের এ বিলীন হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তখন তা এতই ক্ষীণ ছিল যে, উদ্বেগের কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু এখন তা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। সুন্দরী গাছের প্রায় সবই কালো হয়ে মরে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এ বনের প্রায় ৭৩ ভাগ গাছই সুন্দরী। সুন্দরী ছাড়াও সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ আছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এ বনের ৭৩ ভাগ ভূমিই গাছশূন্য হয়ে যাবে। ’

উল্লেখ্য, সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ও জলমগ্ন বনভূমি হিসেবে অখণ্ড বন। যা বিশ্বে সর্ববৃহৎ। অববাহিকার সমুদ্রমুখি সীমানা এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত।

১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো এ বনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। পুরো পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে সুন্দরবনের অবস্থান অত্যন্ত জটিল। ভারত-বাংলাদেশ দুই প্রতিবেশী দেশে অবস্থিত সুন্দরবনের ৬২ শতাংশের মালিকানা বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।