ঢাকা: ২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এই দিনই ক্রসফায়ার নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সুয়োমটো রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
র্যাবের মহাপরিচালক, স্বরাষ্ট্র সচিব ও র্যাব-৮ এর অধিনায়ককে রুলের জবাব দিতে ৪৮ ঘন্টা সময় বেধে দিয়েছিলেন আদালত। রুলের জবাবে ক্রসফায়ারের অভিযোগ অস্বীকার করে আইন শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী।
২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর শুনানি শুরুর কথা ছিলো এ রুলের। তবে ওই দিন বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের হাইকোর্ট বেঞ্চে সময় আবেদন নিয়ে হাজির হন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে ২০১০ এর ৩ জানুয়ারি শুনানি মূলতবী রাখতে বলেছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা।
ক্রসফায়ার বন্ধ রাখার মৌখিক নির্দেশ দিয়ে ওই সময় পর্যন্ত শুনানি মূলতবী করেন হাইকোর্ট। অ্যাটর্নি জেনারেল আশ্বস্ত করেছিলেন আর ক্রসফায়ার হবে না।
বার্ষিক অবকাশ শেষে ৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালত খোলার পর দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম পূর্নগঠন করেন বেঞ্চ। ভেঙ্গে দেওয়া হয় বিচারপতি এএফএম আবদুর রহমান ও মো. ইমদাদুল হক আজাদের বেঞ্চ। যে কারণে এখন পর্যন্ত এ সুয়োমটো রুলের শুনানি শুরু হতে পারেনি। অথচ হাইকোর্ট নিজ থেকে এ রুল ইস্যু করায় আশা করা হয়েছিলো, ক্রসফায়ারের বৈধতার আইনী প্রশ্নের একটা চূড়ান্ত ফয়সালা হবে।
ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভুত হত্যাকা- নিয়ে হাইকোর্টে আরও তিনটি রিট রয়েছে।
২০০৬ সালে জারি করা দুইটি রুলের শুনানিও এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। ২০০৯ সালেও হাইকোর্ট এ নিয়ে রুল জারি করেছিলো।
এ অবস্থায় কেউই বলতে পারছেন না ক্রসফায়ারের বৈধতার প্রশ্নের সুরাহা হবে কবে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের দায়ের করা রিট আবেদনটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় এসেছিলো। পরে হাইকোর্টের বেঞ্চ পূর্নগঠনের পর তা কার্যতালিকা থেকে বাদ যায়। এখন নতুন করে কার্যতালিকায় না আসা পর্যন্ত ওই রুলের শুনানি শুরু হচ্ছে না। ’
‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-’ নিয়ে প্রথম রিট আবেদনটি দায়ের করা হয় ২০০৬ সালের ২৫মে। পুলিশের হেফাজতে কথিত ক্রসফায়ারে টুন্ডা ইসমাইলের নিহত হওয়া নিয়ে এ রিট দায়ের করা হয়।
ক্রসফায়ারে টুন্ডা ইসমাইল হত্যার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্ট ওই সময় রুল জারি করেছিলেন। বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলী ও বিচারপতি জিনাত আরার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই রুল জারি করেন।
‘বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট আরও একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মামনুন রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ ওই রুল জারি করেন।
রুলে জানতে চাওয়া হয়েছিলো আইন শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা হবে না।
আদালত এ রুলটিও জারি করেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে।
‘বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে আরেকটি রিট আবেদন দায়ের করা হয় ২০০৯ সালের ২৯ জুন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও কর্মজীবী নারী যৌথভাবে রিট আবেদনটি করে।
এ আবেদনেও হাইকোর্ট ক্রসফায়ার কেন অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
ওদিকে, মাদারীপুর সদর উপজেলার লুৎফর খালাসী ও খায়রুল খালাসী নামে দুই সহোদর ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনায় সুয়োমোটো রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
রুলে দুই সহোদরকে ক্রসফায়ারে হত্যা কেন অবৈধ ও বেআইনী ঘোষণা করা হবে না ও দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।
২০০৯ এর ১৪ ডিসেম্বর এ রুলের শুনানি শুরুর দিনে অ্যাটর্নি জেনারেল সময় চাওয়ায় হাইকোর্ট কিছু মন্তব্য করেন।
ওই দিন র্যাবের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্রসফায়ার বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছিলেন হাইকোর্ট।
এছাড়াও হাইকোর্ট বলেছিলেন, জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দিলে হয়তো আরও ৫০ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হতে পারে। আমরা এ রুল জারির পর কতজনকে ক্রসফায়ারে মারা হচ্ছে তার হিসাব রাখছি। এ মামলায় দুই জন ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। যে কেউ এ ক্রসফায়ারের শিকার হতে পারেন। আমরা সরকারের বিপে নই। আমরা বিচার বহির্ভুত কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে বারবার বলেছেন বিচার বহির্ভুত হত্যাকা- বন্ধ করা হবে। তারপরও এ বাহিনী (র্যাব) প্রধানমন্ত্রীর কথা উপো করে তাদের বিজনেস কন্টিনিউ করছে। এ বাহিনীতে কিছু ব্ল্যাকশিপ রয়েছে। তাদের মধ্যে কাউকে শাস্তি দিলে এ ঘটনা আর ঘটবে না। তারা সচেতন হবে। বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য বিচার বহির্ভুত হত্যা বন্ধ হওয়া উচিত। আমরা এ দেশের মুক্ত নাগরিক। আমাদের মধ্য থেকে কাউকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হবে এটা কেমন কথা।
আদালতের বাইরে বিভিন্ন মহলেও ক্রসফায়ার নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই বিতর্ক চলে আসছে। গত কয়েকবছরে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি মানুষ বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্টে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্রসফায়ার বন্ধ করার কথা বলা হলেও তা এখনও চলছে।
মাববাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিচার বর্হিভুত হত্যাকা- বন্ধে সরকার বার বার প্রতিশ্রুতি দিলেও ২০১০ সাল জুড়েই তা অব্যাহত ছিল এবং ২০১১ তেও তা রয়েছে।
অধিকারের হিসাবে, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৮৬ ব্যাক্তি বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এ সময় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন ভঙ্গ করে সন্দেহভাজন ব্যাক্তি, আত্মগোপনে থাকা বিপ্লবী বামপন্থী ও নিরীহ ব্যাক্তিদের হত্যা করেছে।
ক্রসফায়ার ইস্যুতে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যেও বিভিন্ন সময়ই ভিন্নতা লক্ষ করা গেছে। সম্প্রতি লন্ডন সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নেতাদের মুখোমুখি হয়েও এ নিয়ে কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোকে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তার সরকার ক্রসফায়ার বন্ধ চায়। তবে তার জন্য সময় লাগবে।
বৃহষ্পতিবার তার সরকারী বাসভবন গনভবনে সাংবাদিক সম্মেলনেও এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। এসময়ও তিনি বলেন, ‘আমরা এর সমর্থন করি না। যখন এটা চালু হয় তখন আমিই এর বিরোধিতা করেছিলাম। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসায় এটি বন্ধ হতে সময় লাগবে। ’
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ২০০৯ সালে বলেছিলেন, বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ডে বাংলাদেশ “জিরো টলারেন্স” ঘোষণা করছে।
তবে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই অপরাধটিকে বরাবরই প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। গত ২৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিচার বর্হিভুত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে যাই বলুক, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করে যাবে। আত্মরক্ষায় তাদের ছোড়া গুলিতে সন্ত্রাসীদের মরাই স্বাভাবিক। ’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য সর্ম্পূণ রূপে প্রত্যাখান করছে বলে বাংলানিউজকে জানান সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসিরউদ্দিন এলান।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিচারবর্হিভুত হত্যাকাণ্ডের প্রশ্নে সরকারের অবস্থানকেই তুলে ধরে।
তিনি আরও বলেন, যারা এই ধরনের হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের কোন ধরনের সাজা হয়না বলেই হরহামেশা এই কাজটি সংগঠিত হয়ে যাচ্ছে। তারা ‘সেল্ফ ডিফেন্স’ এর কথা বলে এই হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে।
‘চাঁদার জন্য, অন্যের জায়গা, সম্পত্তির বিষয়ে এক পক্ষ থেকে টাকা খেয়ে আরেক পক্ষকে হত্যা করা, একই নামের আরেক জনকে হত্যা করা এখন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যতম কাজ’ বললেন নাসির উদ্দিন।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টেও ক্রসফায়ার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময় ২০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১১