ঢাকা, বুধবার, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৮ মে ২০২৫, ০০ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

যমুনার বৈঠকে টিকে গেল সরকার, দাবি পূরণ হলো না বিএনপির

তানভীর আহমেদ ও সিফাত বিনতে ওয়াহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৫৮, মে ২৬, ২০২৫
যমুনার বৈঠকে টিকে গেল সরকার, দাবি পূরণ হলো না বিএনপির প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিদল | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই নড়বড়ে হয়ে যায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভিত। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে জুলাই আন্দোলনের পক্ষগুলো।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার গদি মজবুত করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।

তবে বিএনপির নেতারা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন কি না, তা নিয়ে ছিল দোলাচল। মূলত প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির নেতাদের সাক্ষাৎ ও তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করায় অন্তর্বর্তী সরকার এ যাত্রায় টিকে গেল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পরেও বিএনপির কোনো দাবি পূরণ হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি কর্ণপাত করেননি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে কি এবার চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে বিএনপি? দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই অস্থিরতাও কি সেই কারণে? এমন প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনাধীন কিছু উদ্যোগ নিয়ে সরকারের প্রশাসন এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে বলে বেশ কিছুদিন ধরেই গুঞ্জন চলছিল। টানাপোড়েনের খবর গণমাধ্যমের প্রকাশিত হওয়ার পর তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও নানান ডালপালা মেলে।

গত ২০ মে প্রধান উপদেষ্টা এবং দেশের তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। এরপরের দিন ২১ মে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।

একটি গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উচ্চপর্যায়ের এক সভায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এটি শুধু একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই সম্ভব, অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মাধ্যমে সম্ভব নয়। ’

সেনাপ্রধান অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনাধীন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগেরও জোরালো বিরোধিতা করেছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য একটি মানবিক করিডোর খোলা প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘এখানে কোনো করিডোর হবে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো আপস হতে পারে না। ’

একদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে টানাপোড়েনের খবর, অন্যদিকে ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে বহালের দাবিতে রাজপথের জোরালো আন্দোলনে টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার।

এরমধ্যে গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন, দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। এসব দাবি পূরণ না হলে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না বলেও বিএনপি পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

এমন সংকটময় পরিস্থিতিতেই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান হয়ে ওঠে নড়বড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। যমুনার ওই বৈঠকে বিএনপির উপস্থিতি সরকারের নড়বড়ে পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করেছে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে বৈঠকের পরেও বিএনপির দাবি পূরণ হয়নি। তাই রাজনৈতিক সংকটের সুরাহাও হয়নি বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে নেতৃত্ব দেওয়া প্রতিনিধিদলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “আমরা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের কথা একবারও বলিনি। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও আমাদের উদ্দেশ্য না। আমরা সবসময়ই এই সরকারকে সহযোগিতার কথা বলে আসছি। তবে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করে সরকার নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকেও নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে পরিষ্কারভাবে আমাদের বক্তব্য জানিয়ে এসেছি। ”

তিনি আরও বলেন, “একইসঙ্গে যেসব উপদেষ্টাদের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, তাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও আমাদের মতামত জানিয়েছি। দ্রুত নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থায় না ঠেলে দিতে চাইলে অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত। ”

নির্বাচন ডিসেম্বর না জুনে হবে, এই বিতর্কের সমঝোতা ভিত্তিক সমাধান প্রধান উপদেষ্টার কাছে চেয়েছেন জানিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলানিউজকে বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর পরস্পর স্বার্থ কেন্দ্রিক অনৈক‍্য, মতাদর্শগত বিরোধ এবং পারস্পরিক বাকবিতণ্ডা এবং ‘ব্লেইম গেম’ও সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে। আমরা মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন, সংশোধন, পরিমার্জনসহ জাতীয় ঐক‍্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে কঠোর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

এ ছাড়াও নির্বাচন, সংস্কার ও ফ‍্যাসিবাদী-খুনিদের বিচারের একটি রোডম‍্যাপও দ্রুতই ঘোষণা করা উচিত বলে মনে করেন এবি পার্টির প্রধান নেতা।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনোভাবেই আলোচনার বিষয় হতে পারে না। তার ওপর সকলেরই পূর্ণ আস্থা রয়েছে, ফলে এই মুহূর্তে তার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখা আবশ্যক। যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দূর করাও জরুরি। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। ”

তবে নির্বাচন কবে হবে, সে বিষয়েও একটা সুনির্দিষ্ট সময় ঠিক করা উচিত বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে চলমান টানাপোড়েন রাজনীতিতে বিভাজন আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধান উপদেষ্টার দক্ষতার অভাব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে সরকারের কার্যক্ষমতায়, ফলে পুরো সরকার কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এ কারণে ড. ইউনূসের সরকার এক গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। ”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপিসহ অন্য দলের বৈঠকের ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আশা করি। ”

টিএ/এসবিডব্লিউ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।