এক.
এক ভদ্রলোক রিকশা করে তাঁর গন্তব্যে যাচ্ছেন। হাতে একটা ব্যাগ আর সাথে একটা বাক্স যার ভিতরে সদ্য কেনা একটি ল্যাপটপ।
দুই.
পয়েণ্ট ক এর মোড় হতে গ থানার দূরত্ব ১০০ ফুটও নয়। রাস্তাটা পার হলেই থানার প্রবেশ পথ। থানার ভিতর থেকে উপরের ঘটনা ছায়াছবির দৃশ্যের মত দেখাও যেতে পারে। ভদ্রলোক একটু সম্বিৎ ফিরে পেয়েই দ্রুত থানায় গেলেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে চাইলেন। এইখানেই হল বিপত্তি। কর্তব্যরত পুলিশ মহোদয় তাঁর পুরো ঘটনার অর্ধেক শুনেই তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, যে তিনি যা বলছেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। থানার সামনে থেকে এইভাবে দিনেদুপরে ছিনতাই হতেই পারে না। একটা রিকশা কেমন করে তার সামনে দিয়ে তারই ল্যাপটপ নিয়ে চলে যেতে পারে? ভদ্রলোক মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে পুলিশ মহোদয়কে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তাঁর পক্ষে একটা মিথ্যা অভিযোগ দেবার কি কারণ থাকতে পারে? আর যদি মিথ্যা হয়েই থাকে তাও তার অভিযোগ তো নিতে হবে। পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে তিনি না হয় শাস্তি পাবেন! তখন পুলিশ মহোদয় মোক্ষম যুক্তি দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনাটা রাস্তার ডিভাইডারের অপর পাশে ঘটেছে কিনা। ভদ্রলোক সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই, পুলিশ মহোদয় বললেন, ডিভাইডারের এই পাশ হল গ থানার আওতাভুক্ত; অপর পাশে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটি চ থানার এখতিয়ার। সুতরাং ভদ্রলোকের উচিৎ হবে চ থানায় গিয়ে অভিযোগ দাখিল করা।
তিন.
এই আষাঢ়ে গল্পের কোনো চরিত্রই আসলে কাল্পনিক নয়। এটি পুরোপুরিই একটি বাস্তব ঘটনা। এবং অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে আমরা প্রতিদিনই এই রকম ঘটনার স্বীকার হই। পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করার ব্যাপারে কম বেশি সকলেরই খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমার মনে আছে এরশাদ সাহেবের আমলে, কোনো একটি বিষয়ে অভিযোগ করতে হবে জেনে আমাদের পরিবারের এক শুভানুধ্যায়ী আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আগে সামরিক বাহিনীর চেনা কেউ থাকলে তাকে দিয়ে থানায় ফোন করিয়ে নিতে। নতুবা তারা জিডি নিতে চাইবে না; ঝামেলা করবে। আমরাও তাই করেছিলাম। এখনো অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়না। আমার আইন ভাল জানা নেই; কিন্তু কেউ অভিযোগ দায়ের করতে গেলে পুলিশ অভিযোগ নেবে না এটা কি বেআইনী নয়? এর জন্য কি শাস্তির বিধান নেই? যদি অভিযোগ মিথ্যাও হয় আগেতো অভিযোগ নিতে হবে! আর আরেকটা ব্যাপারও পরিস্কার হওয়া দরকার। একজন মানুষ থানায় পুলিশের সেবা নিতে গেলে সে কোন থানার মানুষ কিংবা ঘটনা কোন থানায় ঘটেছে এইটা কেন বিবেচ্য হবে? এই জন্যেই কি আমরা মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর সব ঘটনার সময় পুলিশকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি? আমরা হয়তো আসলে খামোখাই পুলিশকে দোষ দিয়ে ফেলি- ভয়ঙ্কর ঘটনাটি হয়তো তার থেকে দুইফুট দূরে ঘটলেও অন্য থানায় ঘটেছে! সুতরাং দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাদের কোনো গতিই নেই! আমার মন হয় এই রকম আইন হওয়া উচিৎ যে যখনই কোনো মানুষ পুলিশের কাছে তার সেবা নিতে যাবে, কিংবা কোনো অভিযোগ করতে যাবে, তখনই সেই অভিযোগ অবশ্যই লিপিবিদ্ধ করে রাখতে হবে। যদি সেই অভিযোগের বিষয় ঐ থানার এখতিয়ারভুক্ত না হয়, তবে পরবর্তীতে ওই থানা অপর (সঠিক) থানার সাথে যোগাযোগ করে ঐ বিষয়টির দায়িত্ব হস্তান্তর করবে। কিন্তু সেবা নিতে আসা মানুষটিকে ঠিকই তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দিতেই হবে। এইরূপ যদি না করা হয় তাহলে অসংখ্য দক্ষ এবং নিষ্ঠাবান পুলিশের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই গুটিকতক পুলিশের নিষ্ঠাহীনতা পুরো পুলিশ বিভাগটিকেই মানুষের বন্ধুর পরিবর্তে শত্রু বানিয়ে রাখবে।
পাদটীকা ১। গল্পটার স্থান কাল (কাল অবশ্য প্রকাশ করে ফেলেছি) পাত্র সব প্রকাশ করাই যেত। কিন্তু যিনি এই গল্পের হতভাগ্য নায়ক তাকে বিপদে ফেলতে চাই না বলেই এই ভাবেই লিখলাম।
পাদটীকা ২। আষাঢ় মাস আসতে এখনো কয়েকদিন বাকী। কিন্তু ইদানীং এই রূপ আষাঢ়ে গল্প প্রায়ই কানে আসছে।
লেখক : ড. মো. সোহেল রহমান, অধ্যাপক, বুয়েট