ঢাকা: হাইকোর্টের আদেশের পর প্রায় সাত মাস পার হলেও নিরাপত্তা হেফাজতের নামে দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটককৃতদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়নি। নিম্ন আদালত থেকে মামলার সারমর্ম (সিনপসিস) না আসায় তদন্ত শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
চলতি বা আগামী সপ্তাহেই বিষয়টি পুনরায় আদালতের দৃষ্টিতে আনা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মীজানুর রহমানও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
২০১০ সালের বছরের ২৭ জুলাই নিরাপত্তা হেফাজতের নামে দেশের ২৯টি জেলার কারাগারে আটক ১২৪ জন নারী-পুরুষের ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এ লক্ষে মানবাধিকার কমিশন তদন্ত কমিটিও গঠন করে।
হাইকোর্টের নির্দেশেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আদলতের আদেশ হাতে পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে এ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
আদালত একই সাথে মামলার সারমর্ম পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ারও নির্দেশ দেন তদন্ত কমিটিকে।
এ বিষয়ে আদালতকে সহযোগিতা করার জন্য ড. এম জাহির, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহাম্মুদ, মাহামুদুল হাছান এবং ব্যারিস্টার তানিয়া আমিরকে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে কাজ করার জন্য অনুরোধ করতেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। এছাড়া আইন ও সলিশ কেন্দ্র, ব্রাক, ব্লাস্ট, মহিলা পরিষদ, মহিলা আইনজীবী সমিতির সহযোগিতা নেওয়ার কথা বলা হয়।
ঐ আদেশ অনুযায়ী ১৬ আগস্ট কমিশনের অবৈতনিক সদস্য অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তা আদলতে জমা দেওয়া হয় বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছে কমিশন সুত্র।
তদন্ত কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী আবু ওবায়দুর রহমান ও ফরিদা ইয়াসমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ, সাংবাদিক ইকবাল সোবাহান চৌধুরী ও ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন ঢাকার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেন খান।
এ সম্পর্কে জাতীয় মাধবাধিকার কমিশনে সার্বক্ষণিক সদস্য কাজী রেজাউল হক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা অনেক আগেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমরা এতোদিন ধরে আদালত থেকে কারাগারে আটক নারী-পুরুষদের মামলার সংক্ষিপ্তসারের জন্য অপেক্ষা করেছি।
উল্লেখ্য ওই নির্দেশে আদালত ২৯ জেলার মুখ্য বিচারিক হাকিম এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের ১৬ আগস্টের মধ্যে এসব মামলার বিষয়ে সংক্ষিপ্তসার জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কেন তাদেরকে নিরপত্তা হেফাজতের নামে কারাগারে পাঠানো হলো, কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ এ ধরনের হেফাজতের জন্য আবেদন করেছেন, কোন আইন বলে এ ধরনের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের আটক রাখার মেয়াদকাল, তাদের বয়স ও অভিভাবক সম্পর্কিত তথ্য, অভিভাবকদের মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো কিনা, কারাগার ছাড়া তাদেরকে অন্য নিরাপদ আশ্রয় স্থলের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছিলো কিনা প্রভৃতি বিষয় সিনপসিসে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে কাজী রেজাউল হক বলেন, ঐসব মামলার সিনোপসিস পাওয়ার পর প্রত্যেকটিকে আলাদা আদালাভাবে পর্যবেক্ষণ করে হাইকোর্ট নির্দেশানুযায়ী এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার কথা ছিলো। কিন্তু সিনোপসিস না আসায় তা এখনো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া প্রতিবেদনের সাথে কিছু মতামতও দেবে তদন্ত কমিটি।
নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কারাগারে আটক থাকা সম্পর্কে তিনি বলেন- নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কাউকে কারাগারে আটক না রেখে তাদেরকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিয়ে পরিবার, আত্মীয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সেফ শেল্টার বা বেসরকারি সংস্থার (আদালত অনুমোদিত) সেফ হোমে রাখা যেতে পারে। এতে করে ভুক্তভোগীদের দুর্দশা যেমন কমবে তেমনি তাদের মানবাধিকার লংঘনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
এ সম্পর্কে অ্যাডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, নিন্ম আদালত থেকে সিনোপসিস না আসার কারণই আমরা এ তদন্ত শুরু করতে পারছি না। তবে আদালত থেকে সিনোপসিস না এলে আমরা নিজ উদ্যেগেই তদন্ত শুরু করবো।
তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই হয়তো ১০-১২টি কারাগার পরিদর্শন করে তাদের বর্তমান অবস্থার সম্পর্কে তথ্য এবং আমাদের মতামত আদালতের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
এ সম্পর্কে পিটিশনকারী ব্যারিস্টার মাহাবুব শফিক বলেন, নিন্ম আদালত থেকে সিনোপসিস আসছে না সে বিষয় আমরা আদালতের নজরের আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ সপ্তাহেই অথবা আগামী সপ্তাহে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহামন বলেন, একটা ভালো কাজ করার সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। তদন্তের মাধ্যমে হয়তো এইসব মানুষের দঃখ কিছুটা হলেও লাঘব করতে পরতাম। কিন্তু সিনোপসিস না আসায় সেটি স্তিমিত হয়ে গেছে। এটা আমরা কামনা করিনি।
তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা আমাকে জানিয়েছে কেন নিন্ম আদালত থেকে সিনোপসিস আসতে দেরি হচ্ছে তা জানতে শীঘ্রই তারা আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
উল্লেখ্য গত ৪ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে ‘রংপুরে তরুনীকে ১০ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে যুবলীগ নেতা’ এমন সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক এর বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করলে হাইকোর্ট ওই আদেশ দেন।
বাংলাদশে সময়: ২০৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১১