কলকাতা থেকে: বাংলাদেশের কারাগারে বন্দি থাকা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এবার সরাসরি ঢাকায় আসছেন সংগঠনটির কয়েকজন নেতা। আসাম সরকারের অনুরোধে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টির তদারকি করছে।
আসামের গুয়াহাটি ও কলকাতার একাধিক সূত্র বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছে।
১৯৭৯ সাল থেকে ‘স্বাধীন আসামে’র দাবিতে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে আসছে ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম’ (উলফা)। ভারতে একে `আলফা` নামে ডাকা হয়।
উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশে বন্দি হয়ে আছেন। গত দু’বছরে তার একাধিকবার মুক্তির কথা শোনা গেলেও নানা জটিলতায় তা আটকে আছে। তাই শান্তি আলোচনার স্বার্থে অনেকটা বাধ্য হয়েই উলফার শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে ঢাকায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী এই সংগঠনটির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই শান্তি আলোচনায় বসার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। সর্বশেষ আসামের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মূখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ উলফার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন। কংগ্রেসের এই মূখ্যমন্ত্রী আগামী ১৮ মে তৃতীয়বারের মতো মূখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। স্বভাবতই বৃহত্তর আসামের স্বার্থে শান্তি আলোচনা শুরু করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ তাকে গ্রহণ করতে হবে।
আসামে তরুণ গগৈয়ের সরকার পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় উলফার মধ্যে শান্তিকামী অংশটিও বেশ খুশি। কারণ সরকারের পরিবর্তন হলে আলোচনার প্রক্রিয়া ব্যাহত হলেও হতে পারতো। তাই তারা শান্তি আলোচনায় বসতে আগ্রহী। এই অংশে রয়েছেন উলফার সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়া।
চলতি সপ্তাহে আসামের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর অরবিন্দ রাজখোয়া স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘জয়ের জন্য গগৈকে অভিনন্দন। আসাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক সমাধানের আশাতেই মানুষ তরুণ গগৈয়ের পক্ষে কংগ্রেসকে রায় দিয়েছেন। ’
রাজখোয়া আরও বলেন, ‘আশা করি, গগৈয়ের নেতৃত্বে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উপায় বের হবে। ’
গুয়াহাটির একটি সূত্র জানায়, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী জুন মাসের মধ্যেই উলফার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হতে পারে।
গুয়াহাটির অপর একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই আলোচনায় আগ্রহী উলফার বড় অংশটির সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করেছেন তরুণ গগৈ। বিশেষ করে তিনি কথা বলেছেন উলফা নেতা অরবিন্দ রাজখোয়া, প্রদীপ গগৈ, শশধর চৌধুরী, রাজু বড়ুয়াসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক দিনক্ষণের অপেক্ষা।
আলোচনার জন্য উলফা নেতাকর্মীরাও প্রস্তুতি নিয়েছে।
হীরেন গোহাঁইয়ের নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় অধিবেশনের পক্ষ থেকে শান্তি আলোচনার দাবি-সনদ তৈরি করে এরই মধ্যে অরবিন্দ রাজখোয়ার হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
দাবিগুলি নিয়ে উলফার মধ্যে আলোচনা হলেও উলফার সবাই এটা মানতে চাইছেন না। তারা চান শীর্ষ সব নেতাকে নিয়ে আলোচনা হোক।
উলফার গঠনতন্ত্র অনুসারে সেনাধ্যক্ষ ও সাধারণ সম্পাদকের সম্মতি ছাড়া এভাবে শান্তি আলোচনায় বসা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন দলটির প্রচার সম্পাদক ও পরেশ বড়ুয়া গ্রুপের নেতা লেফটেন্যান্ট অরুণোদয় দহোতিয়া।
উলফার সেনাধ্যক্ষ পরেশ বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া। এদের মধ্যে পরেশ বড়ুয়া পালিয়ে আছেন, আর অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশের কারাগারে বন্দি।
পরেশ বড়ুয়া এখন অনেকটাই দুর্বল গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর অনুপ চেটিয়ার প্রভাব দলে এখনও অনেক বেশি।
পৃথক একটি সূত্র জানায়, কয়েক মাস আগে রাজশাহী কারাগারে আটক অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে দেখা করে গেছেন পি.সি. হালদার নামের এক মধ্যস্থতাকারী। শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে মতামত জানার জন্যই তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাই ধারণা করা হয়, উলফার তৈরি করা আলোচনার সনদে অনুপ চেটিয়ার সমর্থন রয়েছে। এখন পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ও বক্তব্য জানার জন্য শীর্ষ নেতাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হবে।
উলফার মধ্যে শান্তি আলোচনার পক্ষে আস্থা বাড়াতে রাজখোয়া চান অনুপ চেটিয়াকে পাশে রাখতে। তাই তিনি মূখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের কাছে অনুরোধ করেছেন, অনুপ চেটিয়ার ব্যাপারে কিছু একটা করতে।
গুয়াহাটির সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে অনুপ চেটিয়ার পুরোপুরি মুক্তি এখন সম্ভব নয়। কারণ গত জানুয়ারিতে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাইয়ের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, তাকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের আদালতে তার নামে এখনও মামলা চলছে।
সূত্র জানায়, উলফা নেতাদের প্রস্তাব অনুসারে তাই উলফার জ্যেষ্ঠ ও অনুপ চেটিয়াপন্থী কয়েকজন নেতাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে। যারা কারাগারেই অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবেন। আর তা অবশ্যই হবে আলোচনা শুরুর আগে।
গুয়াহাটির সূত্রটি আরও জানায়, উলফা নেতাদের বৈধপথেই বাংলাদেশে পাঠানো হবে। এজন্য পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করতে কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, ১৬টি দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুদ্রা ও স্যাটেলাইট টেলিফোনসহ বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুপ চেটিয়াকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পাসপোর্ট আইন, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ ৪টি মামলায় তার ১১ হাজার টাকা জরিমানাসহ কারদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার ওই দণ্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। বিষয়টির এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।
এদিকে সাজার মেয়াদ শেষের পরই বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা হাইকোর্টে রিট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অনুপ চেটিয়ার রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া যাবে না মর্মে নির্দেশ দেন বাংলাদেশের হাইকোর্ট। সেই থেকেই কারা প্রশাসন বিভিন্ন কারাগারে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বন্দি রাখছে।
গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, সামরিক শাখার উপ-প্রধান রাজু বড়ুয়া, পররাষ্ট্রসচিব শশধর চৌধুরী, অর্থ সচিব চিত্রবন হাজারিকা, সংস্কৃতি সচিব প্রণতি ডেকা ও তাঁদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যাসহ পরিবার-পরিজনকে ভারতের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হস্তান্তরের কথা স্বীকার করেনি।
শেখ হাসিনার সরকার উত্তরপূর্ব ভারতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে নয়াদিল্লি কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৫ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০১১