ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

রাজউকে চলছে দুর্নীতির মচ্ছব

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১১
রাজউকে চলছে দুর্নীতির মচ্ছব

ঢাকা: দুর্নীতির মহোৎসব চলছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কার্যালয়ে। সংস্থাটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মুহাম্মদ নুরুল হুদার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি চক্র এ কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে সূত্র জানায়।



 মৃত ব্যক্তির নামে চলছে প্লট-বাণিজ্য, চেক জালিয়াতি, লটারি জালিয়াতি, প্লট পরিবর্তন ইত্যাদি। আর এর মাধ্যমে চলছে হাজার কোটি টাকার লুটপাট।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজউকের এমন কোনও বিষয় বা বিভাগ নেই, যেখানে দুর্নীতি আর লুটপাটের প্রমাণ  নেই। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সবাই কোনো না কোনো পর্যায়ে দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত।

এ সমন্বিত চক্র একদিকে প্রকাশ্যে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, অন্য দিকে নগরবাসীকে করে রেখেছে জিম্মি। রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী-কর্মকর্তারা লাখ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে ঢাকাকে একটি অপরিকল্পিত নগরীতে পরিণত করেছে এবং হাজার হাজার নিয়ম বর্হিভূত ভবন তৈরিতে সহায়তা করেছে। এছাড়াও রাজউকে কর্মরত সুইপার থেকে চেয়ারম্যান পর্যন্ত সবাই কোটার জোরে সরকারি প্লটের মালিক হয়েছে।

দেখা গেছে, রাজউকের আরেকটি জমজমাট দুর্নীতির ক্ষেত্র হলো প্লট পরিবর্তন। এই বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে রাজউক চত্বরে গড়ে উঠেছে একাধিক দালাল চক্র। চেয়ারম্যানসহ রাজউকের শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মচারী-কর্মকর্তাই প্লট পরিবর্তন বাণিজ্যে জড়িত। এ চক্র এরই মধ্যে রাজউক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের নামে শত কোটি টাকা লোপাট করেছে।

নিকুঞ্জ সেন্টারের নামে ৩৩ কাঠা জমি হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এছাড়া পরিত্যক্ত প্লট জালিয়াতির মাধ্যমেও তারা চালাচ্ছে লুটপাট। বিদেশে অবস্থানরত কিংবা মৃত ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দকৃত প্লট- পরিত্যক্ত দেখিয়ে বিনা নোটিসে বাতিল করে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে অন্যের নামে বরাদ্দ দিচ্ছে তারা। আবার কখনো প্লটের মালিক থাকা সত্ত্বেও পরিত্যক্ত দেখিয়ে ভুয়া নামে একাধিক প্লটের মালিক বনে গেছেন এদেরই কেউ কেউ। অথচ রাজউকের বিধি অনুযায়ী এক ব্যক্তির একাধিক প্লট থাকা দন্ডনীয় অপরাধ।

টেন্ডারের মাধ্যমে মাটি ভরাটের ক্ষেত্রেও সীমাহীন দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। এতেও জড়িত রয়েছে শত কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে সৎ ও আগ্রহী ঠিকাদারদের নানা পন্থায় টেন্ডারে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়। পরে চাহিদার তুলনায় ৪/৫ গুণ মাটি বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ রাজউকের চেয়ারম্যানসহ অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। এক্ষেত্রে টেন্ডারকৃত মাটির রেটও অতিরিক্ত হারে ধরা হয়।

রাজউকের অসংখ্য প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের চাইতে ২০/৩০ এমনকি ৪০ বছর ধরে চলছে। ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্পগুলো ঝুলিয়ে রেখে নিজস্ব জনবল নিয়োগসহ সরকারের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট বরাদ্দের নামেও রাজউকে চলছে বেপরোয়া দুর্নীতি। বিধি অনুযায়ী ১৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ হয়েছে এমন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে সরকারি প্লট পায়। অথচ ৩ কাঠার ক্ষতিগ্রস্তকে পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে আবার যাদের ১০ কাঠা জমি অধিগ্রহন হয়েছে তারা বছরের পর বছর ঘুরেও ক্ষতিপূরণের প্লট পাননি।

রাজউকের এ দুষ্টুচক্র চেক জালিয়াতির মাধ্যমে বছরের পর বছর রাষ্ট্র ও জনগণের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিক মামলা বিচারাধীন আছে। চেক জালিয়াতিকে কেন্দ্র করে রাজউকের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে ভুয়া সিল পার্টি। এই জালিয়াতির সাথে সিবিএ নেতা, ব্যাংক কর্মচারী, রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূমি মালিকেরও জড়িত থাকার প্রমাণ আছে।

দুর্নীতির অপর ক্ষেত্র হলো বাড়ির নকশা অনুমোদন। রাজউকের বিধি অনুযায়ী কোনো ইমারতের নকশা অনুমোদনের আগে সেখানে বাধ্যতামূলক ১২ ফুট চওড়া রাস্তা থাকতে হবে, এক্ষেত্রে ইমারত পরিদর্শকরা মোটা উৎকোচ নিয়ে ৮ ফুট রাস্তা কাগজে-কলমে বড় দেখিয়ে ইমারতের নকশার অনুমোদন দিয়েছে। এখন আবার আইন ভাঙ্গার অপরাধে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে উচ্ছেদ, মামলা এবং জরিমানা করা হচ্ছে। এ ধরনের কেসের সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি।

রাজউকের ফান্ড সম্পর্কে কারোই কোনো স্পষ্ট ধারনা নেই। রাজউকের শত প্রকল্পের অর্থ একটি একাউন্টে জমা রাখা হয়। এ পর্যন্ত রাজউক ফান্ডের আয়-ব্যয় এবং জমাকৃত অর্থের সঠিক হিসেব নেই বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টদের ধারনা রাজউকের চেয়ারম্যানকে দেওয়া একচ্ছত্র ক্ষমতা রাজউকের নীতিমালাকে খর্ব করে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি নকশা বা কোন প্রকল্প ত্রুটিপূর্ণ হলে চেয়ারম্যান যদি তা সঠিক মনে করেন, তবে তিনি তার বিশেষ ক্ষমতায় তা অনুমোদন করতে পারেন। সাংবিধানিকভাবেই চেয়ারম্যানকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাংবিধানিক এই বিশেষ ক্ষমতাই অনেক ক্ষেত্রে রাজউককে বিপথে ঠেলে দিয়েছে বলে ও মন্তব্য তাদের।

রাজউকের এ অবস্থা স্বীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। তিনি বলেন, ‘রাজউকের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হুমকি-ধমকির কারণে দুই বছর দুর্নীতি কিছুটা কমেছিল, এখন আবার বেড়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘এখন কাজ করাতে গেলে প্রিমিয়াম বেশি দিতে হয়। জমির নামজারি করতে গেলে বিভিন্ন টেবিলে ঘুরতে হয়। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল যেতে ঘুষ দিতে হয়। তা না হলে কাজ করানো যায় না বলেই শোনা যায়। ’

২০০৭ সালে ত্রিশ সদস্যের টাস্কফোর্সের অনুসন্ধানেও এমন চিত্র ধরা পড়ে। দুর্নীতি ও অনিয়মের যে ভয়াবহ  চিত্র প্রকাশিত হয় সেগুলো হলো- প্লট বাণিজ্য, ঘুষ ও চেক জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, মৃত ব্যক্তির নামে প্লট বাণিজ্য ইত্যাদি। ওই সময় ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাসপেন্ড ও ১ জনকে গ্রেফতার করা হলেও ২৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হলেও আরো ৩৫ জন পলাতক থাকে।

বাংলাদেশ সময় ১৪০৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।