ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বাংলা বর্ণ ব্যবহারের সুফল

ড. মোঃ আজিজুল হক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১১
ক্ষুদ্র  নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় বাংলা বর্ণ ব্যবহারের সুফল

কিছুদিন আগে হাইকোর্টের রায়ের ফলে সংবিধান সংশোধের জন্য গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ,সরকারের সাহসী পদক্ষেপ।

অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক নিরসনে সরকার যেহেতু একটি সময়োপযোগী ও বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, এ কারণে তাদের কাছে আরেকটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য লেখকের বিনীত উপস্থাপন।  

ইতিপূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী তাদের নিজস্ব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য, উপজাতীয় শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া এবং ‘ড্রপ আউট’ রোধ করা। স্থানীয় পার্বত্য পরিষদের তত্ত্বাবধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় গ্রন্থ রচনায় নিয়োজিত হয়েছেন স্থানীয় ‘উপজাতীয় কালচারাল ইনস্টিটিউট’ এবং ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় গ্রন্থ রচনা কওে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম শুরু হয়েছে উপজাতি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠদান প্রক্রিয়া, যা নিঃসন্দেহে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি সাহসী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল।
বাংলাদেশে বসবাসরত অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা নাই। উত্তরাঞ্চলের সব উপজাতি যেমন সাঁওতাল (দ্বিতীয় বৃহত্তম), উঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, পাহাড়ি, মাহাতো, পাহান, রাজবংশী, কোঁচ, কৈর্বত্যসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বসবাসরত গারো, লুসাই, মুরং, খ্যাং, খুমি ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা মূলত কথ্য ভাষা, লিখিত ভাষা নয়। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে লিপিবদ্ধ করে লিখিত রূপ দেবার মতো কোনো অক্ষরই উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নেই। সহজ কথায় এরা বর্ণহীন পরিবারের সদস্য। এ কারণে বাংলাদেশে বসবাসরত অধিকাংশ উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ, এমনকি ধর্মীয় গ্রন্থও নেই। মারমা, ম্রোদের ভাষা বর্মীদলের অর্ন্তগত। তারা বর্মী বর্ণ ব্যবহার করে। ত্রিপুরাদের নিজস্ব ভাষা আছে, যা ককবরোক বলে পরিচিত। এরা বোডো দলের অন্তর্ভুক্ত। গবেষকদের মতে, চাকমাদের মূল ভাষা বাংলা হলেও এটি বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ মাত্র। তাদের মতে, চাকমাদের ভাষা বাংলা নয়, আবার আরাকানিও নয়, তবে এর নাম দেয়া যায় ‘চাকমা-বাংলা’।

সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান ক্ষুদ্র জাতি হলো সাঁওতাল, উত্তরাঞ্চলে এরাই প্রধান উপজাতি। ভারতে তারা তৃতীয় প্রধান আদিবাসী। বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনার সুবিধার্থে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী বলতে কেস স্টাডি হিসেবে সাঁওতালদের ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বিশেষত সাঁওতালরা মূলত দ্বি-ভাষী। একটি তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা বা সাঁওতালী ভাষা, যা তারা পারিবারিক ও নিজস্ব পরিম-লে ব্যবহার করে, অন্যটি ভিন্ন কোনো জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বৈষয়িক জীবনে ও বাস্তব প্রয়োজনে প্রতিবেশী বৃহত্তর সমাজের সংস্পর্শে আসতে বাধ্য হওয়ায় সাঁওতালরা অঞ্চলভিত্তিতে বাংলা, হিন্দি, উড়িয়া, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষা সমান দক্ষতার সাথে শিখেছে।

বর্তমান রচনায় বাংলা ভাষা ও সাঁওতালী ভাষার মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের ধরন ও ভাষাগত পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে। সেই আলোকে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাপ্রদানের সরকারি উদ্যোগ সমর্থনের পাশাপাশি বাংলা বর্ণমালা গ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

বর্তমানে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবাধ ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া, কিছু বিদেশী বিতর্কিত এনজিওর অপতৎপরতা ও কার্যক্রম, বৃহৎ ও সবল জাতিগোষ্ঠী বাঙালিদের সাথে সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, প্রাকৃতিক উৎস শেষ হওয়া, আকাশ সংস্কৃতি ও বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে উপজাতীয় চিরায়ত সংস্কৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান নিজস্ব মাতৃভাষা রক্ষা ও অবিকৃত রাখার ব্যাপারে উপজাতীয়রা, বিশেষত ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর যুব বয়সীরা যথেষ্ট সচেষ্ট ও আন্তরিক নয় বলে বর্তমান গবেষকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য উদাহরণ দেওয়া যায়। উত্তরাঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলো পাহাড়িয়া বা পাহাড়ি। এদের প্রায় শতভাগ ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান এবং অধিকাংশ পাহাড়িই তাদের মাতৃভাষা ‘পাহাড়ি ভাষা’ জানে না। বর্তমান লেখক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজশাহী বিভাগীয় শহরে ‘উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি’র পরিচালক পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় গভীর উদ্বেগের সাথে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছেন।

যারা নিজের ভাষা জানে না, চিরায়ত ধর্ম মানে না, চিরায়ত সংস্কৃতির শতভাগ পরিবর্তন করেছে, যারা এ দেশে বহিরাগত তারাই আবার নিজেদের আদিবাসি বলে স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছে। এরা কোন যুক্তিতে আদিবাসী এবং বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠী কেন আদিবাসী নয়, এর কোনো ব্যাখ্যা নাই। বাঙালিরা কি এ দেশে বহিরাগত? তারা কি এদেশের আদি-বাসিন্দা নয়?

অনুরুপভাবে ধর্মান্তরিত শিক্ষিত উপজাতীয় পরিবারের অনেকেই তাদের পারিবারিক পরিম-লে নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলেন না, নিজস্ব ভাষার চর্চা করেন না। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের অনেকেই নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন না এবং এদের মধ্যে নিজস্ব জাতিগত পরিচয় দিতে অনীহা দেখা যায়।

কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে জীবিত প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে চার হাজারেরও বেশি ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ ভাষাগুলো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য হবে বিপর্যয়কর ও দুর্ভাগ্যজনক। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণ কেবল ওই গোষ্ঠীর জন্যই নয়, বরং তা সমগ্র দেশ ও জাতির জন্যই সম্মান ও গৌরব বয়ে আনতে পারে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণে বাংলা একাডেমী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ফোকলোর বিভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি’ উদযাপন উপলক্ষে উত্তরাঞ্চলের সাঁওতালদের একটি সংগঠন একটি পোস্টার ছেপেছিল, যার মূল বক্তব্য ছিল রাজনৈতিক। পোস্টারের মূল আবেদনে একটি দাবিই উচ্চারিত হয়েছে, তা হলো, ‘আমি আমার ভাষায় কথা বলব’। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো সাঁওতালদের নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। ফলে তারা ঠিক কোন বর্ণকে নিজেদের ভাষায় প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করবেন, তা বিচার্য। বর্তমানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খ্রিস্টান মিশনারি অথবা কোনো সংগঠন কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত উপজাতীয় বিষয়ে বুলেটিন-পত্রিকা-ম্যাগাজিন ইত্যাদি বাংলা ভাষায় রচিত হচ্ছে। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার বর্ষাপাড়ায় একটি উপজাতীয় সংগঠনের উদ্যোগে সম্প্রতি ‘আদিবাসী স্কুল’ চালু হয়েছে। এখানে সাঁওতালী ভাষায় ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার আর্থিক সহায়তায় বাংলা অক্ষর ব্যবহার করে সাঁওতালী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয়েছে। নিজ ভাষায় শিক্ষাদানের এ অভিনব কৌশল সাঁওতালদের অনুপ্রাণিত করছে এবং তারা খুবই খুশি হয়েছে। অন্যদিকে ভারতে বাংলার পাশাপাশি পণ্ডিত রঘুনাথ র্মুর্মু আবিষ্কৃত ‘অল’ লিপি বা অলচিকির মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছে । ফলে সাঁওতালদের মধ্যে ত্রিবিধ ধারা ও মতের সৃষ্টি হয়েছে। ধারা তিনটি হলো : বাংলা অক্ষর, রোমান অক্ষর ও অলচিকি ব্যবহারের পক্ষ-বিপক্ষ মতামত নিয়ে সৃষ্ট একটি ধারা। খ্রিস্টান মিশন খ্রিস্টধর্মীয় গ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বা ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এ ব্যবহৃত বর্ণ হিসেবে স্বাভাবিক কারণে এবং মিশন পরিচালিত এনজিওসহ ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সাঁওতালদের কিছু অংশ রোমান অক্ষর ব্যবহারের পক্ষ নিলেও অধিকাংশ সাঁওতাল, বিশেষত চিরায়ত সাঁওতালরা বাংলা বর্ণ ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অলচিকির ব্যবহার পশ্চিম বাংলায় সীমিত পরিসরে চালু হলেও জনপ্রিয়তা পায়নি এবং বাংলাদেশে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়নি।

একটি জনগোষ্ঠীর ‘জাতি’ হিসেবে পরিপূর্ণ বিকাশের অপরিহার্য শর্ত নিজস্ব ‘বর্ণমালা’ না থাকার কারণে তারা ‘জাতি’ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত হয়নি। জাতি হিসেবে স্বীকৃতি ও বিকাশের প্রয়োজনেই তাদের যে কোনো বর্ণমালাকে গ্রহণ করতে হবে এবং আপাতত এর কোনো বিকল্প নেই।

এ কথা ঠিক যে, এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি বাংলা জানেন না কিংবা বোঝেন না। এর কারণ হলো, তারা বাংলাদেশে বসবাস করেন এবং এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী হলো বাঙালি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং ভারতের পশ্চিমবাংলা, আসাম, উড়িষ্যাতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলো বাঙালিদের দ্বারা পরিব্যাপ্ত হয়ে বসবাস করছেন। বাঙালিরা এদের নিকটতম প্রতিবেশী, বিপদে-আপদে বাঙালিরাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদের সঙ্গেই মিশতে হয় এবং বাঙালিদের জমিতেই তারা কাজ করেন। ফলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করেও ব্যবহারিক প্রয়োজনে সাঁওতালসহ সকল নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাংলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতসমূহের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। সরকারের অন্যতম নীতি হলো, ‘সবার জন্য শিক্ষা এবং ২০১৫ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ’। এ কারণে বর্তমান ও বিগত সকল সরকারের বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল শিক্ষা খাতে। বাংলাদেশের সমগ্র জনশক্তির মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যা প্রায় দুই শতাংশ। সুতরাং তাদের নিরক্ষর রেখে বাংলাদেশকে নিরক্ষরমুক্ত দেশ করা সম্ভব নয়। বিশেষত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। এ কারণে সার্বিক বিবেচনায় সরকারের সব কর্মসূচিতে বা শিক্ষানীতিতে সব উপজাতির মানুষরাও অন্তর্ভুক্ত। শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বর্তমান সরকার মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করছে। স্কুলে যায় না এমন শিশুকে উদ্বুদ্ধ এবং পিতামাতাকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করার জন্য ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘শিক্ষার বিনিময়ে নগদ অর্থ’ কর্মসূচি চালু হয়েছে। একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে এবং দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমান লেখকের ব্যক্তিগত গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মতো সাঁওতালরাও শিক্ষা কর্মসূচিতে অধিক হারে নিজেদের স¤পৃক্ত করছে। ফলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করেও ব্যবহারিক প্রয়োজনে সাঁওতালরা বাংলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এ দেশের প্রায় সব ক্ষুদ্র জাতিই তাদের নিজস্ব ভাষার শব্দসম্ভারে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বহু শব্দ হুবহু অথবা সামান্য বিকৃত উচ্চারণে নিজস্ব কায়দায় গ্রহণ করেছে।

বর্তমান লেখকের পিএইচডি থিসিসের গবেষণাধীন এলাকায় সাঁওতালদের গড় শিক্ষার হার শতকরা ৭৮.৪১ এবং উচ্চশিক্ষার হার শতকরা ২ ভাগের কম (হক, ২০০৬)। সর্বজনীন শিক্ষার হার আশানুরূপ হলেও উচ্চশিক্ষার হার খুবই কম এবং রীতিমতো উদ্বেগজনক। খ্রিস্টান মিশনগুলি এ ব্যাপারে আগ্রহী ও তৎপর নয় বলে গবেষণায় প্রাথমিকভাবে অনুমিত হয়েছে। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের অধিকাংশই এ বিষয়ে লেখকের কাছে অভিযোগ করেছেন। কর্মরত বিভিন্ন খ্রিস্টান মিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নন-খ্রিস্টান উপজাতীয় ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা গ্রহণে আর্থিক সাহায্য করেছে এমন কোনো নজির বর্তমান লেখক খুঁজে পাননি।

এ কথা সত্য যে, শিক্ষা বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন সুবিধা ঘোষণার পরও প্রাথমিক পর্যায়ে উপজাতীয় শিশুদের মধ্যে ‘ড্রপ আউট’-এর হার বাঙালিদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। বর্তমান গবেষকের মতে, এর অন্যতম কারণ হলো শিশু অবস্থায় প্রাথমিক স্কুলে উপজাতীয় শিশুদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং বাংলা ভাষায় পাঠ রপ্ত করতে না পারা। উপজাতীয় শিশুরা যে পর্যায়ে স্কুলে আসে, সে সময়ে পারিবারিক পরিম-লে নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলা শিখে নিজের জাতিগত ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। এ সময়ে তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে না, বাংলা জানে না এবং বাঙালিদের সংস্পর্শে খুব বেশি আসে না। ফলে বাঙালি শিক্ষক যখন বাংলায় পাঠদান করেন, তখন শিশুরা বাংলা বোঝে না এবং শ্রেণীকক্ষে আনন্দ পায় না। শিশুরা স্কুলে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। অশিক্ষিত পিতা-মাতাও শিশুকে শিক্ষা দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে বাংলা বর্ণ ব্যবহার করে নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করলে তা যত সহজ ও কম কষ্টসাধ্য হবে তা অন্য ভাষায় হবে না। বিদেশী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য যে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, শ্রম ও মেধা প্রয়োজন তা বেশ কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জন্য তা যুক্তিসঙ্গত এবং সমীচীন হবে না। বাংলা অক্ষর ব্যবহার করে উপজাতীয় ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হলে শিক্ষিত উপজাতীয় যুবসমাজ দক্ষতার সাথে শিশুদের শিক্ষাদান করাতে পারবে।  

বর্তমান গবেষক তার পিএইচডি গবেষণাকর্মের প্রয়োজনে দীর্ঘদিন জয়পুরহাট ও রাজশাহী জেলায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন। সে সুবাদে স্থানীয় সাঁওতালদের স্থানিক বাংলা কথ্য ভাষাতে বিশেষ পারদর্শিতা পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করেছেন। গবেষণাধীন অনেক পরিবার, বিশেষ করে যারা অনূর্ধ্ব ত্রিশ বছর বয়সী, তারা যতো সুন্দর বাংলা জানে ও বলে, অনেক ক্ষেত্রে ততোটা সাঁওতালী ভাষা বলতে পাওে না। বিশেষ করে খ্রিস্টান সাঁওতাল পরিবার ও খ্রিস্টান স্কুল-কলেজের ছাত্রাবাসসহ বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এ কথা খুবই প্রযোজ্য। আর্য অথবা অনার্য ভাষাগোষ্ঠীর প্রভাবে সাঁওতালী ভাষা ধ্বনিকৌশল, উচ্চারণভঙ্গি এবং ভাষার অবিমিশ্রতা হারিয়ে মৃতপ্রায় এবং মিশ্র ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। এ অবস্থা কোনো জাতির জন্যই কাম্য হতে পারে না। এজন্য যুগ-যুগ ধরে লোকমুখে প্রচলিত উপজাতীয় বর্ণাঢ্য সাহিত্য উপকরণ সংরক্ষণ ও লিখিত রূপ দেওয়া জরুরি। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ‘জীবন্ত ইতিহাস’ খ্যাত প্রবীণ মানুষগুলো হারিয়ে গেলে সংস্কৃতির অনেক উপাদান হারিয়ে যাবে এবং কখনোই আর তা উদঘাটন করা সম্ভব হবে না।

সম্প্রতি ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান উপজাতিরা বিদেশী খ্রিস্টান মিশনারিদের সহায়তায় তাদের মাতৃভাষাকে রোমান বর্ণমালার সাহায্যে লিখতে ও পড়তে শুরু করেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের স্বার্থে উপজাতীয় সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মকে রোমান ভাষায় গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছে আর একেই বর্তমানের শিক্ষিত খ্রিস্টান সাঁওতাল ও অন্যরা নিজ ভাষা বলতে এবং পরিচয় দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তারা যে বর্ণহীন ভাষা পরিবারের সদস্য তা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে বা ভুলতে চাচ্ছে অথবা খ্রিস্টধর্ম-প্রীতির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তা করছে। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বাংলা বর্ণ গ্রহণের পরিবর্তে রোমান হরফপ্রীতি খ্রিস্টান মিশনারিদের ইচ্ছা হলেও চিরায়ত উপজাতীয় জনগণ এ ব্যাপারে একমত নন। প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টান মিশন পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ও ছাত্রাবাসে অবস্থানরত অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ রোমান ভাষা জানেন না। চিরায়ত উপজাতি জনগোষ্ঠীর রোমান অক্ষর গ্রহণে বিরোধিতার প্রধান কারণ হলো এটি।

বর্তমানে উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় গান, কবিতা, নাটক, ছড়া ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে লেখাপড়ার কাজ করতে পারে। রাজশাহী অঞ্চলের সাঁওতালরা ‘উলগুধ্বনি’ নামে বাংলা ভাষায় একটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজ প্রকাশ করছে। উপজাতি শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই বাংলা গানে সুনাম অর্জন করেছেন। সাঁওতালী ভাষায় কেবল যে বাংলা ভাষাই অনুপ্রবেশ করেছে তা নয় বরং উপমহাদেশের অন্যান্য অনেক প্রধান বা আঞ্চলিক ভাষা-উপভাষাও প্রবেশ করেছে।

পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শ্রুতিমধুর ভাষা হলো বাংলা, যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এর ফলে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া এ দেশের নাগরিকরা যুগপৎ বাঙালি ও বাংলাদেশী। মনের ভাব প্রকাশ ও যে কোনো বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষা যতটা সহজসাধ্য, তা অন্য কোনো ভাষার জন্য প্রযোজ্য নয়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অক্ষর লেখা ও আয়ত্ত করা বেশ সহজ। এ অর্থে যে কোনো শিশুর পক্ষেই বাংলা ভাষা আয়ত্ত করা সহজসাধ্য হবে এবং বাংলা বর্ণে সাঁওতালী ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক কোমলমতি শিশুর জন্য সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে। পক্ষান্তরে ‘রোমান’ বা ‘অলচিকি’ শিখতে হলে একজন ছাত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে এবং শিশু শিক্ষাগ্রহণে নিরুৎসাহিত হতে পারে। তাছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণের জন্য রচিত গ্রন্থটি শুধু পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং পরে বাংলাদেশে ঐ পুস্তকের বা সে ভাষার উপযোগিতা থাকবে না। যেহেতু উপজাতি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণ বা অক্ষর নেই এবং মাতৃভাষা চর্চার জন্য যে কোনো একটি ভাষার বর্ণমালাকে গ্রহণ করতে হবে, তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ দেশের বর্ণমালাকেই গ্রহণ করা সঙ্গত ও অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে। এতে করে স্বদেশ প্রেম প্রমাণিত হবে এবং বৃহৎ বাঙালি জাতির সাথে অধিকতর সুসম্পর্ক সৃষ্টিতে স্থায়ী ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে।  

ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের ঝরে পরা রোধসহ জনশক্তিকে শিক্ষিত জনসম্পদে পরিণত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান ভাষা বাংলার বর্ণমালা গ্রহণ করার মধ্যে তাৎক্ষণিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

লেখক : আঞ্চলিক পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।   ([email protected])

বাংলাদেশ সময় ২০৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।