ঢাকা, বুধবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

উভয় সঙ্কটে এশিয়া

জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১১
উভয় সঙ্কটে এশিয়া

ঢাকা: আগামী শতকে ভূ-রাজনৈতিক নাটকের পটভূমি হবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লড়াই। আসন্ন এই লড়াই বিবেচনায় ইতোমধ্যেই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে এশীয় দেশগুলো।

তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, এই দুই বিশ্ব শক্তির কোনটাকে অগ্রাধিকার দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের একটি বিল সিনেটে পাস হতে যাচ্ছে। এখন আমেরিকায় এই সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপ যদি কিছু সময়ের জন্য স্থগিতও রাখা হয়, তাহলেও যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বান্দ্বিক মনোভাব চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোকে উভয় সংকটে ফেলবে।

চীন এখন জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেরই সবচে বড় বাণিজ্য অংশীদার। কিন্তু এই দেশগুলোর সঙ্গে এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। কতো দিন তাদের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থ এরকম দ্বিমুখী বা নানামুখী থাকবে?

এ অবস্থা খুব বেশি দিন থাকবে না। গত সপ্তাহে চীনের সরকারি পত্রিকা পিপলস ডেইলির ওই সম্পাদকীয়তে কিন্তু সেরকম ইঙ্গিতই দিয়েছে। বলা হচ্ছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য সেই সব দেশ, যারা মনে করে যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সহায়তায় চীনের সঙ্গে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারবে ততোদিন তারা যা করতে চায় তার ব্যাপারে স্বাধীন।

এই প্রবন্ধটি খুব সম্ভবত এর আগের দিন জাপান ও ফিলিপাইনের এক বিবৃতির দ্বারা প্ররোচিত। দেশ দুটি দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ-সহযোগিতা জোরদার করবে। এই অঞ্চলে বিতর্কিত সীমানায় চীন বিস্তৃত অংশ দাবি করে আসছে।

তবে চীনের এই সতর্কবার্তা কিন্তু শুধু জাপান-ফিলিপাইনের জন্য নয়, বরং তা ভিয়েতনাম, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং তাইওয়ানের জন্যও। এই অঞ্চলে যারাই বিগত দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরকি সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোগী হয়েছে তাদের জন্যও।

মনে হচ্ছে, চীন চাতুরতাপূর্ণ ধৈর্য্যরে খেলা খেলছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি প্রতিবেশী দেশগুলোকে অপ্রতিরোদ্ধভাবে তার প্রভাব বলয়ের মধ্যে আনবে বলে ভাবছে চীন। এখন এই প্রজাতন্ত্রটি তার ক্ষমতাবহির্ভুত একটি ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, এবং চীন বিরোধী জোট গঠনকে সে একই সঙ্গে ভয় পাচ্ছে আবার নিন্দাও করছে।

অপেক্ষাকৃত ধীরস্থির কৌশল দেখে চীনের ব্যাপারে এমন ধারণা করা যায়, ২০২০ সালের মধ্যে দেশটি বিশ্বের সবচে বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্বে সবচে কর্তৃত্বশীল সামরিক শক্তি এবং এমনকি এখনও চীনের পেছনের দিকে প্রশান্ত মহাসাগরে এর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।

কিন্তু যেহেতু রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক শক্তিকেই অনুসরণ করে, সেহেতু প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাব নিদেন পক্ষে টেকসই হবে না। ঠিক এই বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করেছে পিপলস ডেইলি।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার এক ডলার ব্যয় করলে তার মধ্যে ৪০ সেন্টই থাকে ঋণের অর্থ। আর চীন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচে বড় বিদেশি ঋণদাতা। এক দিক দিয়ে বলতে গেলে, প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বে পরোক্ষভাবে অর্থ জোগান দিচ্ছে চীন। যদিও এ অঞ্চলে মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার তালে আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা এই ভেবে ভীত যে, অর্থ সংকটই হয়ত যুক্তরাষ্ট্রকে একদিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্ষীণবীর্য করবে।

ঠিক একই সময়ে চীন কিন্তু তার নিজস্ব সামরিক শক্তির উন্নয়ন করছে। আমেরিকার পরিকল্পনাকারীরা চীনের নতুন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত আমেরিকার বিমানঘাঁটি এবং বিমানবাহী জাহাজের জন্য রীতিমতো হুমকি।

চীনের প্রতিবেশীরা অবশ্য দেশটির ক্রমবর্ধমান পেশীশক্তি এবং তা বাড়ানোর অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়েও শঙ্কিত। গত দুবছরে সমুদ্রে বিতর্কিত সীমা নিয়ে ভিয়েতনাম ও জাপানের সঙ্গে চীনের তিক্ততা বেড়েছে। সমুদ্রে এই মুখোমখি অবস্থান তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটিয়েছে। ভারত বলছে, ভারতীয় সীমান্তে কিছু অংশের দাবির ব্যাপারে চীন দিন দিন আরও বেশি দৃঢপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্কের কারণে দক্ষিণ কোরিয়াও চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারছে না।

চীনের কার্যক্রমের একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামরিক শক্তি এর নীতি নির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। নতুন প্রজন্ম ক্ষমতায় আসছে। তাদের বুঝানো হচ্ছে, চীন বাইরের শক্তির শিকারে পরিণত হওয়ার কারণেই দূর্বল হয়ে পড়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মধ্যে যে স্পষ্ট বৈপরিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে করে চীন আরও আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে।

আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, বিশ্বজুড়ে দেশটির অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিধি বাড়ছে যা সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর বিষয়টি তার কাছে অপরিহার্য করে তুলছে। এতে করে সে স্বার্থের ব্যাপারে আরও দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে যাচ্ছে।

চীনের দুর্বল দিক হচ্ছে, এর ক্ষুধার্ত অর্থনীতি আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। সেই সঙ্গে  নৌ শক্তিতে অনেকটা অরক্ষিত। বিমানবাহী জাহাজ ও সাবমেরিনের সঙ্কট এবং  জীবাশ্ম জ্বালানি সমৃদ্ধ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি জোরদার করা এসব বিষয় চীন সরকারের জন্য একটি আগাম সতর্কবার্তা তাতে সন্দেহ নেই।

তবে উপরের ব্যাখ্যাগুলো একেবারে নির্ভুল, তা বলা যাবে না। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের কার্যক্রম এবং মিত্রদের বিপরীত পক্ষে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করার প্রবণতা বাড়ছে। এই সব বিষয়ে পরস্পরের সাড়া দেওয়ার ভঙ্গি আরেক জনের কাছে আগ্রাসন বলে মনে হচ্ছে। এটা অবশ্য বড় শক্তিগুলোর চিরন্তন আচরণ।

অবশ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে আগামী মাসে চীনসহ এই অঞ্চলে বড় শক্তিগুলোকে নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামার মাতৃভূমি হাওয়াই দ্বীপে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা শীর্ষক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে। প্রশান্ত মহাসাগরে কৌশলগত ভুল হিসাব কতোটা বিপজ্জনক হতে পারে তা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে ওবামা খুব সম্ভবত পার্ল হারবারে একটা সফর দেবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।